মানুষের প্রতিদিন কতটুকু প্রোটিন খাওয়া দরকার
সুপারশপে গিয়ে একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, প্রায় সব কিছুতেই এখন প্রোটিন ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। স্ন্যাক বার, দই, আইসক্রিম—এমনকি বোতলজাত পানিতেও নাকি এখন বাড়তি প্রোটিন!
ফিটনেস ইনফ্লুয়েন্সাররা ইনস্টাগ্রামে বলছেন, ‘পেশি বানাতে চান? দীর্ঘজীবী হতে চান? তাহলে মুঠো মুঠো প্রোটিন খান!’ প্রোটিন সাপ্লিমেন্টের এই বাজার এখন হাজার কোটি টাকার। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমাদের শরীরের আসলে ঠিক কতটুকু প্রোটিন দরকার?
বিজ্ঞানীরা বলছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই প্রোটিন নিয়ে মাতামাতি আর বাস্তবতার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। তাহলে আপনি এখন কার কথা শুনবেন? ইনফ্লুয়েন্সার নাকি বিজ্ঞানী?
বিষয়টা বেশ গোলমেলে। একদিকে বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্য সংস্থাগুলোর গাইডলাইন বলছে, একজন সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের শরীরের প্রতি কেজি ওজনের জন্য ০.৮ গ্রাম প্রোটিন দরকার। অর্থাৎ, আপনার ওজন যদি ৭০ কেজি হয়, তবে দিনে আপনার প্রোটিন দরকার মাত্র ৫৬-৬০ গ্রাম। এখানে জানিয়ে রাখি, ২৫০ গ্রাম রান্না করা মুরগির মাংসে প্রায় ৬৮ গ্রাম প্রোটিন থাকে।
অন্যদিকে, ফিটনেস ট্রেনাররা বলছেন এই হিসাবের চেয়ে দ্বিগুণ বা তিন গুণ প্রোটিন খেতে! বিজ্ঞানীরা আছেন এই দুইয়ের মাঝখানে। নিউজিল্যান্ডের ওটাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টিবিদ ক্যাথরিন ব্ল্যাক বলছেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যা চলছে, তা হতাশাজনক। সবাই সব খাবারে প্রোটিন পাউডার মেশাচ্ছে, অথচ এত প্রোটিনের কোনো দরকার নেই।’
বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্য সংস্থাগুলোর গাইডলাইন বলছে, একজন সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের শরীরের প্রতি কেজি ওজনের জন্য ০.৮ গ্রাম প্রোটিন দরকার।
প্রোটিনের চাহিদার এই হিসাব-নিকাশ কিন্তু নতুন নয়। সেই ১৮৪০ সালে রসায়নবিদ জাস্টাস ভন লিবিগ প্রথম এর হিসাব করেছিলেন।
সমস্যা হলো, বর্তমানে যে আরডিএ (RDA) বা সুপারিশকৃত মাত্রা কেজিতে ০.৮ গ্রাম ঠিক করা আছে, সেটা হলো ন্যূনতম চাহিদা। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডোনাল্ড লেম্যান বলছেন, ‘এই পরিমাণ প্রোটিন খেলে আপনি হয়তো অপুষ্টিতে ভুগবেন না, এটা ঠিক। কিন্তু তার মানে এই নয় যে এটাই সেরা বা এর চেয়ে বেশি প্রোটিন খাওয়া যাবে না।’
গবেষকদের মতে, শরীরের সুস্থতার জন্য সবচেয়ে ভালো প্রোটিনের মাত্রা হলো, প্রতি কেজি ওজনের জন্য ১.২ থেকে ১.৬ গ্রাম।
তবে সবার জন্য একই নিয়ম খাটে না। বয়স বাড়লে মানুষের পেশি ক্ষয়ে যেতে থাকে। ২ হাজার ৬৬ জন বয়স্ক মানুষের ওপর করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁরা বেশি প্রোটিন খেয়েছেন, তাঁদের পেশি ক্ষয়ের হার অন্যদের চেয়ে ৪০ শতাংশ কম। এখানে বেশি প্রোটিন বলতে কেজিতে ১.১ বা ১.২ গ্রাম বোঝানো হচ্ছে।
আবার যাঁরা ভারোত্তোলন বা জিমে ভারী ব্যায়াম করেন, তাঁদের পেশি গঠনের জন্য একটু বেশি প্রোটিন দরকার। তবে সেটাও ১.৬ গ্রামের বেশি হলে আর কোনো বাড়তি লাভ হয় না। মানে আপনার ওজন যদি ৭০ কেজি হয় এবং আপনি যদি জিমে গিয়ে ১১২ গ্রামের বেশি প্রোটিন খান, তাতে অতিরিক্ত কোনো লাভ পাবেন না।
২ হাজার ৬৬ জন বয়স্ক মানুষের ওপর করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁরা বেশি প্রোটিন খেয়েছেন, তাঁদের পেশি ক্ষয়ের হার অন্যদের চেয়ে ৪০ শতাংশ কম।
এখন প্রশ্ন হলো, বেশি প্রোটিন খেলে কি ক্ষতি আছে? কিছু ফিটনেস ট্রেনার পরামর্শ দেন, প্রতি কেজিতে ২.২ গ্রাম প্রোটিন খেতে। এটা কি ঠিক? গবেষক নিকোলাস বার্ডের মতে, এটা অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। যাদের কিডনির সমস্যা আছে, তাদের জন্য তা বিপজ্জনক।
আর সুস্থ মানুষের ক্ষেত্রেও এত প্রোটিন খাওয়া উচিত নয়। কারণ, আপনার শরীর তখন দামি খাবারকে আবর্জনায় পরিণত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। অর্থাৎ, শরীর বাড়তি প্রোটিন গ্রহণ করবে না, বর্জ্য হিসেবে বের করে দেবে।
আরও একটা বিষয় জানিয়ে রাখা দরকার। সব প্রোটিন কিন্তু এক নয়। প্রোটিন তৈরি হয় অ্যামিনো অ্যাসিড দিয়ে। আমাদের শরীরের জন্য ২০টি অ্যামিনো অ্যাসিড দরকার, যার মধ্যে ৯টি শরীর নিজে তৈরি করতে পারে না। এগুলো খাবারের মাধ্যমেই পেতে হয়।
মাছ, মাংস ও ডিমের মতো প্রাণিজ প্রোটিনে এই ৯টি অ্যামিনো অ্যাসিড সঠিক অনুপাতে থাকে। কিন্তু ডাল বা বাদামের মতো উদ্ভিজ্জ প্রোটিনে একেকটায় একেক রকম ঘাটতি থাকে।
কিছু ফিটনেস ট্রেনার পরামর্শ দেন, প্রতি কেজিতে ২.২ গ্রাম প্রোটিন খেতে। তবে গবেষক নিকোলাস বার্ডের মতে, এটা অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়।
একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। অনেকের মতে, ২৮ গ্রাম মুরগির মাংসের বদলে ১৪ গ্রাম কাঠবাদাম খেলেই চলে। কিন্তু গবেষক লেম্যান বলছেন, এটা ভুল! অ্যামিনো অ্যাসিডের গুণগত মান বিচার করলে দেখা যায়, ২৮ গ্রাম মুরগির মাংসের সমান পুষ্টি পেতে আপনাকে ১১৫ গ্রামের বেশি কাঠবাদাম খেতে হবে!
তার মানে এই নয় যে আপনাকে শুধু মাংসই খেতে হবে। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন বলছে, হার্ট ভালো রাখতে এবং পরিবেশ বাঁচাতে উদ্ভিজ্জ প্রোটিন খাওয়া দরকার। তবে সে ক্ষেত্রে আপনাকে ডাল, বীজ বা বাদামের মতো বিভিন্ন ধরনের খাবার মিলিয়ে খেতে হবে, যাতে সব অ্যামিনো অ্যাসিড পাওয়া যায়।
ব্রাজিলের এক গবেষণায় দেখা গেছে, কম আয়ের মানুষেরাও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশের চেয়ে বেশি প্রোটিন খায়। অর্থাৎ, আমাদের শরীরে প্রোটিনের অভাব খুব একটা হয় না।