শুধু মাংস খাওয়া কি স্বাস্থ্যসম্মত, নাকি ক্ষতিকর

শুধু মাংস খেয়ে বাঁচাকে বলে কার্নিভোর ডায়েট।ছবি: মিডজার্নির সাহায্যে

শুধু নিরামিষ খেয়ে অনেকেই জীবন কাটান। সামাজিক বা ধর্মীয় নানা কারণে অনেকে নিরামিষ খান। আবার কেউ কেউ জলবায়ুর প্রতি সুবিচারের জন্যও শুধু নিরামিষ খেয়ে জীবন কাটিয়ে দেন। নিরামিষাশীর বিপরীতে আছে মাংসাশী ডায়েট।কিছু মানুষ আছেন, শুধু মাংস খেয়ে বেঁচে থাকেন। এভাবে শুধু মাংস খেয়ে বাঁচাকে বলে কার্নিভোর ডায়েট।এই ডায়েট দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, শুধু মাংস খেয়ে কি বেঁচে থাকা যায়? কিংবা শুধু মাংস খেলে দেহে কী পরিবর্তন হবে?

অনেকের কাছে মাংস খুব সুস্বাদু খাবার। শরীরে শক্তি পাওয়ার জন্য অনেকে মাংস খেতে চান। সাধারণত আমাদের খাদ্যতালিকায় কেবল মাংসই থাকে না, অন্যান্য খাদ্যও থাকে। তবে আমরা যদি শুধু মাংস খাই, তাহলে দেহে কী ঘটবে, এটা জানা প্রয়োজন। কথাটা আরেকটু ব্যাখ্যা করি। এই ডায়েট বা খাদ্যাভ্যাসে শুধু মাংস থাকবে, ভাত, শাকসবজি, ফল বা শস্য—কিছুই থাকবে না। 

সম্প্রতি কার্নিভোর ডায়েট বা শুধু প্রাণিজ আমিষ খাওয়ার প্রবণতা নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। কেউ কেউ দাবি করেন, এতে ওজন কমে, ত্বক ভালো থাকে, পেটের সমস্যা কমে। আবার অনেকে বলেন, এর মাধ্যমে প্রাচীন মানুষের খাদ্যাভ্যাসে ফিরে যাওয়া যায়। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিষয়টি এত সরল নয়।

অনেকেই ‘লো-কার্ব’ ডায়েট অনুসরণ করেন। স্টেপল ফুড, যেমন ভাত বা রুটি কম খান। লো কার্ব ডায়েটের চরম রূপ হলো কার্নিভোর ডায়েট। এই ডায়েটে সব উদ্ভিজ্জ খাবার বাদ দিয়ে শুধু মাংস, ডিম আর দুগ্ধজাত খাবার খাওয়া হয়। কেউ কেউ শুধু গরু বা ভেড়ার মাংসই খান, আর কিছু খান না।

আরও পড়ুন
গবেষণায় দেখা গেছে, আঁশ ও ফল-সবজিসমৃদ্ধ খাদ্যাভ্যাস মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বাড়ায়। বিষণ্নতার ঝুঁকি প্রায় ১৯ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়।

অনেকে কার্নিভোর ডায়েটকে তুলনা করেন প্রাচীন শিকারিদের ডায়েটের সঙ্গে। কিন্তু আধুনিক সময়ে খামার ও শিল্পে উৎপাদন করা প্রাণীর সঙ্গে শিকার করা প্রাণীর তুলনা চলে না। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে মোট গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ আসে খাদ্য উৎপাদন থেকে। এর সবচেয়ে বড় অংশের দায় মাংসশিল্পের। স্বাস্থ্যের জন্য এই ডায়েট যেমন নেতিবাচক হতে পারে, পরিবেশের দিক থেকেও এই ডায়েট নিয়ে চিন্তার কারণ আছে।

কার্নিভোর ডায়েটে পেটের মধ্যে যা ঘটে

কার্নিভোর ডায়েট শুরু করার পর অনেকে বলেন, পেট ফেঁপে থাকা বা গ্যাসের সমস্যা কমে গেছে। পেট ফাঁপার কারণ হতে পারে উচ্চ-ফুডম্যাপ জাতীয় কিছু খাবার। যেমন গম, ডাল, বা নির্দিষ্ট সবজি। এগুলো খেলে অনেকের হজমে সমস্যা হয়। এগুলো ডায়েট থেকে বাদ পড়লে পেট ফাঁপা এমনিতেই কমে যায়। ফলে কিছু দিনের জন্য ভালো লাগে।

শরীর যখন দীর্ঘদিন কোনো আঁশজাতীয় খাবার বা উদ্ভিজ্জ খাদ্য পায় না, তখন অন্ত্রের উপকারী ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। ফাইবার বা আঁশ শুধু হজমের জন্য নয়; হৃদরোগ, ক্যানসার, ডায়াবেটিস, এমনকি মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও জরুরি। গবেষণায় দেখা গেছে, পর্যাপ্ত আঁশ খেলে ক্যানসারের ঝুঁকি প্রায় ২২ শতাংশ পর্যন্ত কমে।

শরীর যখন দীর্ঘদিন কোনো আঁশজাতীয় খাবার বা উদ্ভিজ্জ খাদ্য পায় না, তখন অন্ত্রের উপকারী ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়।
ছবি: মিডজার্নির সাহায্যে

শরীরে পুষ্টির ঘাটতি

শুধু মাংস খেলে শরীরে কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের ঘাটতি দেখা দেয়। যেমন ভিটামিন সি, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও উদ্ভিজ্জ রাসায়নিক উপাদান (ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট)। এই উপাদানগুলো শরীরের প্রদাহ বা ব্যথা কমায় এবং কোষকে রক্ষা করে। অতিরিক্ত প্রোটিন খেলে শরীরকে নাইট্রোজেন থেকে ইউরিয়া তৈরি করতে হয়, এতে লিভারের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে। কিডনিকে বেশি পরিশ্রম করতে হয় এই ইউরিয়া বের করে দিতে। ফলে দীর্ঘমেয়াদে কিডনি ও যকৃত—দুটোই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

গবেষণায় দেখা গেছে, আঁশ ও ফল-সবজিসমৃদ্ধ খাদ্যাভ্যাস মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বাড়ায়। বিষণ্নতার ঝুঁকি প্রায় ১৯ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। অন্যদিকে, কার্নিভোর ডায়েটে এসব উপাদান নেই। তাই এই খাদ্যাভ্যাস মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

আরও পড়ুন
নিয়মিত লাল মাংস খেলে হৃদরোগের ঝুঁকি ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ে। স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে হতে পারে দ্বিগুণ।ফলে হৃদ্‌যন্ত্রের ওপর চাপ বাড়ে।

হৃদ্‌যন্ত্রের ঝুঁকি

কার্ডিওলজিস্ট বা হৃৎরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, লাল মাংস বা রেড মিট এবং প্রক্রিয়াজাত মাংসে প্রচুর পরিমাণে স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও কোলেস্টেরল থাকে। এগুলো ক্ষতিকর এলডিএল বা নিম্ন ঘনত্বের কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এই এলডিএল কোলেস্টেরল হৃদরোগ ও স্ট্রোকের বড় কারণ। নিয়মিত লাল মাংস খেলে হৃদরোগের ঝুঁকি ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ে। স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে হতে পারে দ্বিগুণ। খাদ্যতালিকায় কোনো আঁশ না থাকলে শরীরের পক্ষে অতিরিক্ত এলডিএল কোলেস্টেরল বের করে দেওয়া কঠিন হয়। ফলে হৃদ্‌যন্ত্রের ওপর চাপ বাড়ে।

লাল মাংস বা রেড মিট এবং প্রক্রিয়াজাত মাংসে প্রচুর পরিমাণে স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও কোলেস্টেরল থাকে।
ছবি: মিডজার্নির সাহায্যে

তবু কেন এই ডায়েট জনপ্রিয় হচ্ছে

কার্নিভোর ডায়েটের জনপ্রিয়তা কমছে না, কারণ যাঁরা দীর্ঘদিন হজমের সমস্যা বা খাদ্য-অসহিষ্ণুতায় (Food Intolerance) ভুগেছেন, তাঁদের কাছে এই ডায়েট অনেকটা ‘সহজ সমাধান’। কেউ কেউ ভাবেন, সব খাবার বাদ দিলে শরীর ‘রিসেট’ হয়ে যাবে। শুধু মাংস খেয়ে থাকলে প্রথম দিকে হয়তো ওজন কমে, পেটের অস্বস্তিও দূর হয়। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে শরীর আসলে পুষ্টির ভারসাম্য হারায়।

তাই শুধু মাংস খেয়ে থাকলে কিছু দিন হয়তো হালকা বা চনমনে থাকা সম্ভব। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে শরীরের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

আরও পড়ুন