খাই বেশি কিন্তু ওজন বাড়ে না, সমাধান কী
জীবনে এর চেয়ে বড় অবিচার আর কী হতে পারে। অনেকের কাছে যেখানে ওজন কমানো একটি বড় চ্যালেঞ্জ, সেখানে এমন কিছু মানুষও আছেন যারা অনেক খেয়েও ওজন বাড়াতে পারেন না। বিষয়টা মজার মনে হলেও, যারা এই সমস্যায় আছেন তাদের কাছে এটা আসলে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তারা এত খেয়েও ওজন বাড়াতে না পেরে, নিজেকে প্রশ্ন করে, কেন এমনটা হচ্ছে? এটা কি কোনো রোগ, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে? এর সমাধান কী? কীভাবে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে ওজন বাড়ানো সম্ভব?
এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব রোড আইল্যান্ডের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞানের অধ্যাপক ক্যাথলিন মেলানসন বলেন, ‘এই প্রশ্নের কোনো সহজ উত্তর নেই। কেননা এর পেছনে জিনগত, পুষ্টিগত ও আচরণগত নানা কারণ জড়িত। তবে প্রত্যেক মানুষের ক্ষেত্রে এই কারণগুলোর প্রভাব ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে।’
ওজন না বাড়ার প্রধান কারণ হলো শরীরের বিপাক প্রক্রিয়া, অর্থাৎ দেহের মেটাবলিজম। এর সঙ্গে শরীরের গড়ন বা অন্য কোনো কিছুর সম্পর্ক নেই। অধ্যাপক ক্যাথলিন মেলানসনের মতে, ‘যাদের দেখে মনে হয় অনেক খায় তবু মোটা হন না, তারা আসলে অন্যদের চেয়ে বেশি খান না।’
আপনার যে বন্ধু প্রতিদিন আইসক্রিম খায়, সে হয়তো স্বাভাবিকভাবেই অন্য খাবারে কম খেয়ে, অথবা দিনের বাকি সময় কম খাবার খেয়ে অতিরিক্ত ক্যালোরির ঘাটতি পূরণ করে। আবার যখন তারা পিৎজার মতো ফাস্ট ফুড খায়, তখন ধীরে ধীরে খায়। পেট ভরে গেলে অল্প কিছু খেয়েই থেমে যায়।
পেনিংটন বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারের প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা ডাক্তার ফ্র্যাঙ্ক গ্রিনওয়ের জানান, ‘যেসব মানুষকে দেখে মনে হয় তারা অনেক খাচ্ছেন, তাদের ক্যালরি মাপলে দেখা যাবে তারা আপনার ধারণার চেয়ে কমই খাচ্ছেন।
বেশি নড়াচড়া করলে শরীরের বিপাক প্রক্রিয়া সচল থাকে। ফলে পেশীর কোষের মধ্যে মাইটোকন্ড্রিয়ার সংখ্যা ও কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়।
ওজন না বাড়ার পেছনে শারীরিক কার্যকলাপ একটি বড় কারণ। তবে এর জন্য জিমে গিয়ে ব্যায়াম করার প্রয়োজন নেই। অধ্যাপক ক্যাথলিন মেলানসন এই সম্পর্কে বলেন, ‘কিছু মানুষ স্বাভাবিকভাবেই অন্যদের চেয়ে বেশি নড়াচড়া বা কাজ করে। এর মানে এই নয় যে তাদের শুধু ভারি কাজ করতে হবে। তারা হয়তো ছুটাছুটি বেশি করে, কাজের সূত্রে বেশি নড়াচড়া করা লাগে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বেশি নড়াচড়া করলে শরীরের বিপাক প্রক্রিয়া সচল থাকে। ফলে পেশীর কোষের মধ্যে মাইটোকন্ড্রিয়ার সংখ্যা ও কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। এই মাইটোকন্ড্রিয়াকে বলা হয় শরীরের পাওয়ার হাউজ, যা চলাচলের জন্য শক্তি তৈরি করে। তাই মাইটোকন্ড্রিয়া যত বেশি হবে, তত বেশি ক্যালরি পোড়ানো সম্ভব হবে।
ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডাক্তার ইনেস বারোসো গবেষণা করেছেন স্থূলতার জেনেটিক্স নিয়ে। তিনি বলেন, ‘এমন প্রমাণ খুব কমই পাওয়া যায় যে কিছু মানুষ জন্মগতভাবে অন্যদের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি ক্যালরি পোড়ায়, এমনকি ব্যায়াম না করলেও।’
তবে অধ্যাপক মেলানসনের মতে, ‘এর পেছনে কিছু শারীরিক পার্থক্য থাকতে পারে, যা কিছু মানুষকে খুব বেশি চেষ্টা ছাড়াই স্বাভাবিকভাবে তাদের খাদ্য গ্রহণ নিয়ন্ত্রণ করতে দেয়। আমাদের রক্তে থাকা স্নায়ু সংকেত এবং হরমোনগুলো একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমাদের ক্ষুধার্ত বা পেট ভরা থাকার অনুভূতি জানায়।’ এই প্রক্রিয়াকে ক্ষুধা নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা বলা হয়। কিছু মানুষের মধ্যে এই ব্যবস্থা অন্যদের তুলনায় বেশি সংবেদনশীল হতে পারে, যার ফলে তারা সহজেই বুঝতে পারে কখন খাওয়া বন্ধ করতে হবে।
এই ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত একটি গুরুত্বপূর্ণ হরমোন হলো লেপটিন (Leptin)। এটি কেবল আমাদের পরবর্তী খাবারের পরিমাণই নয়, বরং দীর্ঘ সময় ধরে আমরা কতটা খেতে চাই, তা নিয়ন্ত্রণ করতেও সাহায্য করে।
শুধু জিনই ওজন নির্ধারণ করে না। এমন কোনো জিন পাওয়া যায়নি, যা কাউকে পুরোপুরি স্থূলতা থেকে রক্ষা করে বা স্থূল করে তোলে। এটি আসলে একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া।
অধ্যাপক মেলানসনের মতে, যেসব মানুষ সহজে ওজন বাড়াতে পারেন না, তাদের শরীরের ভেতরের ব্যবস্থাটি বেশি সংবেদনশীল। এর ফলে তারা হয়তো কোনো অনুষ্ঠানে বেশি খেলেও পরের কয়েক দিনের জন্য তাদের পেট ভরা মনে হতে পারে এবং তারা স্বাভাবিকের চেয়ে কম খেতে পারেন। কারণ তাদের শরীরের ভেতরের সংকেত স্বয়ংক্রিয়ভাবে মস্তিষ্কে এই বার্তা পাঠায় যে, ‘আমাদের যথেষ্ট শক্তি আছে।’
কোনো ব্যক্তির ওজন বাড়া বা কমার পেছনে বংশগতি বা জেনেটিক্সের বড় ভূমিকা থাকতে পারে। ২০১৯ সালে পিএলওএস জেনেটিক্স নামে একটি গবেষণাপত্রে বিজ্ঞানীরা ডিএনএ-এর ২৫০টিরও বেশি এমন অংশ খুঁজে পেয়েছেন, যা স্থূলতার সঙ্গে সম্পর্কিত। এই গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের ওজন কম, তাদের মধ্যে মোটা হওয়ার প্রবণতার সঙ্গে জড়িত এই জিনগুলো কম ছিল।
তবে এই গবেষণার সহ-লেখক ডাক্তার বারোসোর মতে, শুধু জিনই ওজন নির্ধারণ করে না। এমন কোনো জিন পাওয়া যায়নি, যা কাউকে পুরোপুরি স্থূলতা থেকে রক্ষা করে বা স্থূল করে তোলে। এটি আসলে একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। অনেকের স্থূলতার জন্য দায়ী জিন থাকলেও তারা মোটা নন।
শেষ পর্যন্ত, ওজন বৃদ্ধি বা তা নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রবণতার উত্তরটা বেশ জটিল। এটি পুরোপুরি পূর্বনির্ধারিত নয়, আবার সম্পূর্ণরূপে আমাদের নিয়ন্ত্রণেও থাকে না। এর কারণ এমন কোনো জেনেটিক ‘অন-অফ সুইচ’ নেই যা কিছু মানুষকে যা খুশি তাই খেতে দেয়। একই সঙ্গে, ওজন বাড়ার প্রবণতা শুধু আত্মনিয়ন্ত্রণের অভাবের কারণেও হয় না। অধ্যাপক মেলানসনের মতে, এ বিষয়টি একজনের থেকে অন্যজনের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে।
যদি ওজন কম হয় এবং স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে ওজন বাড়াতে হলে সঠিক ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া অত্যন্ত জরুরি। মূল লক্ষ্য হলো অস্বাস্থ্যকর খাবার এড়িয়ে ধীরে ধীরে ওজন বাড়ানো, যাতে শরীর প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায়।
ওজন বাড়াতে চাইলে এমন সব খাবার খাওয়া প্রয়োজন, যা শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টি দেবে। সেজন্য শরীর মেরামতের জন্য প্রোটিন এবং কোষ সচল রাখতে ভিটামিন ও খনিজ জাতীয় খাবার খেতে হবে।
মনে রাখতে হবে ওজন কম হলেও চিনি, চর্বি এবং লবণযুক্ত খাবার—যেমন কেক, ফাস্টফুড ও চিনিযুক্ত পানীয় এড়িয়ে চলা উচিত। আবার দিনভর ঘন ঘন ছোট ছোট খাবার খেয়ে সহজে ওজন বাড়াতে পারেন। প্রতিদিনের খাবারে পনির, বাদাম, দুধ এবং শুকনো ফলের মতো স্বাস্থ্যকর ও উচ্চ-শক্তির খাবার রাখা উচিৎ।