কম খাই, তবু ওজন বাড়ে কেন? সমাধান কী?
ওজন বেড়ে যাওয়া বর্তমানে একটা বড় সমস্যা। এ নিয়ে নানাজন নানারকম কথা বলতে পারেন, বন্ধুমহলে ‘ভোজন রসিকতা’ নিয়ে রসিকতাও হয়তো চালু থাকতে পারে। তবুও অনেকেই হয়তো ভাবেন, ‘আমি তো খাই কম, তবু ওজন বাড়ছে কেন?’ বিশেষ করে কিশোর-তরুণ বয়সে এমন প্রশ্ন মনে আসা স্বাভাবিক। মনে হয় যেন রহস্যজনক কোনো কারণে শরীরের ওজন বাড়ছে তো বাড়ছেই। খাওয়াদাওয়া কমিয়েও বিষয়টা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
শুধু ক্যালরি গুনে এ সমস্যার সমাধান করা যাবে না। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর পেছনে থাকতে পারে আরও বেশ কিছু ‘গোপন’ কারণ। ‘গোপন’ বলার মানে হচ্ছে, এসব কারণ ‘বেশি খাওয়া’র মতো করে আমাদের চোখে পড়ে না। কিন্তু এগুলোই বড় ভূমিকা রাখতে পারে ওজন বাড়ার পেছনে। এসব সমস্যার সমাধান খাওয়া কমানোর মাধ্যমে মিলবে না, বরং সমস্যা অনুযায়ী নিতে হবে পদক্ষেপ। ফলে বিষয়গুলো বোঝা প্রয়োজন। তাই চলুন, ওজন বাড়ার পেছনের গোপন কারণগুলো সংক্ষেপে জানা যাক।
ওজন বাড়ার পেছনে দায়ী যেসব গোপন কারণ
এ ক্ষেত্রে একদম শুরুতেই বলতে হবে আমাদের দেহের মেটাবলিজম বা বিপাক প্রক্রিয়ার কথা। এটি ওজন বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখে। মেটাবলিক রেট বা বিপাকের হার মানে, শরীর কত দ্রুত ক্যালরি ‘পোড়ায়’। অর্থাৎ খাবারের ভেতরে জমা ক্যালরিকে রূপান্তর করে শক্তিতে। এই শক্তি দিয়েই চলে আমাদের দেহ। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, বিশেষ করে বয়ঃসন্ধির পর, অনেকের এই বিপাকের হার কিছুটা কমে যেতে পারে। এর মানে হলো, আগের মতো একই পরিমাণ খাবার খেলেও শরীর কম ক্যালরি পোড়াচ্ছে। তাহলে অতিরিক্ত ক্যালরি যাচ্ছে কোথায়? এগুলো জমা হয় ফ্যাট বা চর্বি হিসেবে। জিনগত কারণেও বিপাকের হারে ভিন্নতা দেখা যায়। দেখা যায়, কারো শরীর দ্রুত ক্যালরি পোড়ায়, আবার কারো শরীর ক্যালরি পোড়ায় ধীরে ধীরে।
অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট বা বিষন্নতা কমানোর ওষুধ, অ্যান্টিহিস্টামিন বা অ্যালার্জির ওষুধ কিংবা স্টেরয়েড ওজন বাড়াতে পারে। হরমোনের ভারসাম্যহীনতাও এর জন্য দায়ী। যেমন হাইপোথাইরয়েডিজম, অর্থাৎ থাইরয়েড হরমোনের অভাব ওজন বাড়ার একটা পরিচিত কারণ।
ওজন বাড়ার আরেকটি বড় কারণ ঘুমের অভাব। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল হেলথ ইনস্টিটিউটের তথ্যানুসারে, অপর্যাপ্ত ঘুম স্থুলতার ঝুঁকি বাড়ায়। এটা কীভাবে হয়? আসলে, আমরা যখন পর্যাপ্ত ঘুমাই না, তখন দেহের কিছু হরমোনে পরিবর্তন আসে। এর মধ্যে ঘ্রেলিন (Ghrelin) নামে হরমোনটি ক্ষুধার অনুভূতি বাড়ায়। পাশাপাশি লেপটিন (Leptin) নামে যে হরমোন ক্ষুধা কমায়, ঘ্রেলিন তার কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়। ফলে আমাদের বেশি ক্ষুধা পায় এবং মুখরোচক অস্বাস্থ্যকর খাবার খেতে ইচ্ছা করে। এসব খাবার—যেমন ফাস্ট ফুড বা তেলে ভাজা খাবার—অল্প খেলেও শরীরে প্রচুর পরিমাণে ক্যালরি জমা হয়।
আরেকটি বড় সমস্যা মানসিক চাপ। সামাজিক চাপ বা অন্য যেকোনো দুশ্চিন্তা আমাদের দেহে কর্টিসল নামের ‘স্ট্রেস হরমোন’ নিঃসরণ করে। এই কর্টিসলের মাত্রা বেড়ে গেলে শরীর পেটে চর্বি জমার প্রবণতা বাড়ায়। এ ছাড়াও মানসিক চাপে থাকলে অনেকে ‘স্ট্রেস ইটিং’ করেন। অর্থাৎ খাবার খেয়ে মন শান্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। এ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ক্যালরিযুক্ত আরামদায়ক বা খেতে বেশি স্বাদ, এমন খাবারই মানুষ সাধারণত বেছে নেয়। ফলে বাড়ে দেহের ওজন।
স্ট্রেস ইটিং হোক বা অন্য কারণ, অতিরিক্ত পরিমাণে প্রক্রিয়াজাত খাবার বা প্রসেসড ফুড খাওয়া শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর। মনে হতে পারে, কমই তো খাচ্ছি। কিন্তু খাদ্যতালিকায় যদি অতিরিক্ত চিনি, পরিশোধিত শস্য এবং অস্বাস্থ্যকর চর্বিযুক্ত প্রক্রিয়াজাত খাবার বেশি থাকে, তাহলে অল্প খেলেও সেগুলো ওজন বাড়াতে পারে। কারণ, এগুলো উচ্চ ক্যালরি সম্পন্ন খাদ্য। এসব খাবারে সাধারণত ফাইবার বা আঁশ এবং পুষ্টি কম থাকে। ফলে অল্প খেলে পেট ভরে না এবং দ্রুত ক্ষুধা পায়। হার্ভার্ড হেলথ বলছে, এ ধরনের ‘উচ্চ ক্যালরির গোপন উৎস’ ওজন বাড়ার পেছনে বহুলাংশে দায়ী।
শুধু কম খাওয়া তথা ক্যালরি কম গ্রহণ করাই ওজন বাড়া বা স্থূলতা সমস্যার সমাধান নয়। কারণ, ওজন বাড়ার পেছনে মূল সমস্যাটা অনেক ক্ষেত্রে ‘খাওয়া’ নয়, অন্যকিছু। তাহলে এসব সমস্যার সমাধান কী?
এ ছাড়া অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট বা বিষন্নতা কমানোর ওষুধ, অ্যান্টিহিস্টামিন বা অ্যালার্জির ওষুধ কিংবা স্টেরয়েড ওজন বাড়াতে পারে। হরমোনের ভারসাম্যহীনতাও এর জন্য দায়ী। যেমন হাইপোথাইরয়েডিজম, অর্থাৎ থাইরয়েড হরমোনের অভাব ওজন বাড়ার একটা পরিচিত কারণ। থাইরয়েড গ্রন্থি যথেষ্ট হরমোন উৎপাদন না করলে বিপাকের হার কমে যায় এবং শরীর কম ক্যালরি পোড়ায়। এর ফলেই ঘটে ওজন বৃদ্ধি। ওদিকে মেয়েদের দেহে পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম পিসিওএস (PCOS) নামে একধরনের হরমোনজনিত সমস্যা দেখা যায়। নারীর ওজন বৃদ্ধির পেছনে হরমোনজনিত এ ধরনের সমস্যাগুলো বড় ভূমিকা রাখতে পারে। এরকম সমস্যা আছে বলে সন্দেহ হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিৎ।
সবশেষে আরেকটি কারণ নিয়ে না বললে লেখাটা অসমাপ্ত রয়ে যাবে। সেটা হলো, দৈহিক কার্যকলাপ বা পরিশ্রমের অভাব। এখন আমরা খেলাধুলা বা দৈহিক পরিশ্রমের কাজ করি কম। বিনোদনের জন্য আছে স্মার্টফোন, ট্যাব বা কম্পিউটার। ফলে শরীর ক্যালরি গ্রহণ করে, কিন্তু সেটা পোড়াতে পারে না। কম খেলেও, বিন্দু বিন্দু জল জমে গিয়ে যেমন সাগর তৈরি হয়, তেমনি ক্যালরি চর্বি হিসেবে জমে জমে দেখা দিতে পারে স্থূলতা।
অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে, শুধু কম খাওয়া তথা ক্যালরি কম গ্রহণ করাই ওজন বাড়া বা স্থূলতা সমস্যার সমাধান নয়। কারণ, ওজন বাড়ার পেছনে মূল সমস্যাটা অনেক ক্ষেত্রে ‘খাওয়া’ নয়, অন্যকিছু। তাহলে এসব সমস্যার সমাধান কী?
খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে হবে। কম খেলেও খাবারের গুণগত মান অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। প্রক্রিয়াজাত খাবার, অতিরিক্ত চিনি, সাদা রুটি বা মিষ্টি পানীয় এড়িয়ে চলা ভালো। কারণ, এসব খাবারে ক্যালরি অনেক বেশি থাকে এবং পুষ্টিগুণ থাকে কম।
ওজন বাড়ার সমাধান কী
যেহেতু কারণ একটা নয়, তার মানে সমাধানও একটা হতে পারে না। ভিন্ন ভিন্ন সমস্যার সমাধানও হবে ভিন্ন। এ জন্য জীবনযাত্রায় কিছু পরিবর্তন আনতে হবে, মনোযোগ দিতে হবে খাদ্যাভ্যাসে। আর অবশ্যই, দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ভুলেও নিজে নিজে বা গুগল দেখে ডাক্তারি করা যাবে না। এখানে তাই যে সমাধানগুলোর কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো ওপরে আলোচিত সাধারণ সমস্যাগুলোর সাধারণ সমাধান। একজন নির্দিষ্ট মানুষের সমস্যা কী, তার সমাধান কী হতে পারে, সেটা অভিজ্ঞ চিকিৎসক ছাড়া আর কেউ বলতে পারেন না। তাহলে আসুন, সাধারণ সমাধানগুলো জেনে নিই।
এক, পর্যাপ্ত এবং ভালো ঘুম নিশ্চিত করুন। বুঝতেই পারছেন, ঘুমের সমস্যার সমাধান হলো ভালো ঘুম। স্লিপ ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, প্রাপ্তবয়স্কদের দৈনিক ৭-৯ ঘণ্টা আর কিশোরদের প্রতিদিন ৮-১০ ঘণ্টা মানসম্মত ঘুম নিশ্চিত করার চেষ্টা করা উচিৎ। এ জন্য ঘুমের নির্দিষ্ট সময়সূচি মেনে চলা প্রয়োজন।
দুই, মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করুন। সেটা কীভাবে করবেন? প্রকৃতির কাছাকাছি সময় কাটানো, পরিবার বা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে গল্প করা, পছন্দের গান শোনা বা বই পড়া—এরকম নানা উপায়ে এটা করা যেতে পারে। প্রয়োজনে মনোবিদের সাহায্য নিতে পারেন।
তিন, খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে হবে। কম খেলেও খাবারের গুণগত মান অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। প্রক্রিয়াজাত খাবার, অতিরিক্ত চিনি, সাদা রুটি বা মিষ্টি পানীয় এড়িয়ে চলা ভালো। কারণ, এসব খাবারে ক্যালরি অনেক বেশি থাকে এবং পুষ্টিগুণ থাকে কম। এসবের পরিবর্তে তাজা ফলমূল, শাকসবজি, শস্য বা চর্বিহীন প্রোটিন—যেমন মাছ, মুরগির মাংস, ডাল—খেতে হবে। ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার যেমন শাকসবজি ও ফল খেলে দীর্ঘক্ষণ পেট ভরা থাকে। এতে অতিরিক্ত খাওয়া কমবে।
চার, নিয়মিত শরীরচর্চা করতে হবে। ব্যায়ামের অভাবে ওজন বাড়ে। প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০-৬০ মিনিট মাঝারি ধরনের শরীরচর্চা করা উচিৎ। দ্রুত হেঁটে, দৌড়িয়ে, সাইকেল চালিয়ে, সাঁতার কেটে বা যেকোনো খেলাধুলা করেও ব্যায়াম করা যায়। শরীরচর্চা কেবল ক্যালরি পোড়াতে সাহায্য করে না, মেটাবলিজম বাড়ায় এবং মানসিক চাপ কমাতেও সাহায্য করে।
সাত, ধৈর্য ও ধারাবাহিকতা থাকতে হবে। ওজন কমানো বা নিয়ন্ত্রণে আনা একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। রাতারাতি কোনো জাদুবলে ওজন কমবে না। তাই ধৈর্য ধরে ওপরের পরামর্শগুলো মেনে চলতে হবে এবং ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে।
পাঁচ, ওষুধের প্রভাব সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। যদি কোনো নির্দিষ্ট ওষুধের কারণে ওজন বাড়ছে বলে সন্দেহ হয়, তাহলে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। চিকিৎসক প্রয়োজনে ওষুধ পরিবর্তন করতে পারেন বা ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য বিকল্প পরামর্শ দিতে পারেন। নিজে ওষুধ পরিবর্তন করা যাবে না।
ছয়, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা যাচাই করতে হবে। ওজন বৃদ্ধির পেছনে হরমোনের সমস্যা আছে বলে মনে হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। রক্ত পরীক্ষা এবং অন্যান্য শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে হরমোনজনিত সমস্যা শনাক্ত করা যায়। সঠিক চিকিৎসা পেলে হরমোনের ভারসাম্য ফিরিয়ে এনে ওজন নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
সাত, ধৈর্য ও ধারাবাহিকতা থাকতে হবে। ওজন কমানো বা নিয়ন্ত্রণে আনা একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। রাতারাতি কোনো জাদুবলে ওজন কমবে না। তাই ধৈর্য ধরে ওপরের পরামর্শগুলো মেনে চলতে হবে এবং ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। ছোট ছোট পরিবর্তন দীর্ঘ মেয়াদে বড় সাফল্য এনে দিতে পারে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, কম খেয়ে ওজন বাড়ার ব্যাপারটা শুধু ক্যালরিতে সীমাবদ্ধ নেই। ঘুম, মানসিক চাপ, হরমোন, ওষুধ এবং খাদ্যের গুণগত মানের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। তবুও যদি ওজন বাড়তেই থাকে, তাহলে একজন চিকিৎসক বা পুষ্টিবিদের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। তাঁরা আপনার ব্যক্তিগত পরিস্থিতি অনুযায়ী সঠিক নির্দেশনা দিতে পারবেন।