বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় গেছেন। সেখানে পরিচয় হলো একজন নতুন মানুষের সঙ্গে। জমাট আড্ডা হলো। কিন্তু লোকটি চলে যেতেই অবাক হয়ে দেখলেন, কিছুতেই তার নাম মনে পড়ছে না। এ ধরনের অভিজ্ঞতা হয়তো অনেকেরই হয়েছে। এই অবস্থাকেই প্রচলিত ভাষায় বলা হয় মাইন্ড ব্ল্যাঙ্ক হয়ে যাওয়া। বিরল মনে হলেও ঘটনাটা বেশ সাধারণ। গবেষকদের মতে, আমাদের মস্তিষ্ক প্রায় ৫-২০ শতাংশ সময় পুরোপুরি ব্ল্যাঙ্ক অবস্থায় থাকে।
তবে এই ব্যাপারটা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতভেদ আছে। বেলজিয়ামের ইউনিভার্সিটি অব লিজের কগনিটিভ নিউরোসায়েন্টিস্ট অ্যাথেনা ডেমার্তজি এ বিষয়ে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন। তাঁর মতে, ‘মাইন্ড ব্ল্যাঙ্ক এমন এক অবস্থা, যখন মনে হয় মাথায় কোনো চিন্তা নেই বা থাকলেও তা বোঝানো যায় না।’
ব্যাখ্যাটা বেশ গোলমেলে মনে হলেও বিজ্ঞানীরা ইচ্ছা করেই এ ক্ষেত্রে খানিকটা অস্পষ্টতা রেখেছেন। কারণ, মানুষ নিজেদের মানসিক অবস্থা বোঝাতে নানা ধরনের ভাষা ব্যবহার করে। কেউ বলেন, ‘জানি না আমি কী ভাবছিলাম,’ আবার কেউ বলেন, ‘মনোযোগ দিইনি’। ডেমার্তজি বলেন, ‘এ ধরনের ধোঁয়াশা অনেক সময় গবেষকদের দিশেহারা করে দেয়।’
মস্তিষ্ক ব্ল্যাঙ্ক হওয়ার কারণ এখনো পুরোপুরি জানা যায়নি। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, ঘুম ও মস্তিষ্কের উত্তেজনার সঙ্গে এর সম্পর্ক থাকতে পারে। ঘুমের সময় নিউরন বিশ্রাম নেয়। দিনভর জমে থাকা সব পরিষ্কার করে ফেলে।
ডেমার্তজি চেষ্টা করেছেন, মাইন্ড ব্ল্যাঙ্ক হয়ে যাওয়ার বিভিন্ন ধরন আলাদা করে বুঝতে। কিন্তু কাজটা সহজ নয়, বেশ জটিল। আমাদের মস্তিষ্কের ভেতরের কাজকর্ম বোঝার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পদ্ধতিগুলোর একটি হলো ফাংশনাল ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং বা এফএমআরআই (fMRI)। ডেমার্তজি ব্যাখ্যা করেছেন, এফএমআরআই গবেষণায় অংশ নেওয়া মানুষদের প্রায়ই বলা হয় স্ক্যানার মেশিনে থাকার সময় কিছু না ভাবতে। কিন্তু এমনটা করলে সিঙ্গুলেট কর্টেক্সের মতো মস্তিষ্কের মাঝখানের কিছু অংশ সক্রিয় হয়ে ওঠে। তবে ডেমার্তজির মতে, এটা আসলে মস্তিষ্ক ফাঁকা হওয়ার কোনো চিহ্ন নয়। বরং এটা চিন্তা দমন করার জন্য মস্তিষ্ক যে পরিশ্রম করে, তারই একটি মানসিক সংকেত।
২০২৩ সালে ডেমার্তজি ও তাঁর দল স্ক্যানারে থাকা অবস্থায় কিছু মানুষের মস্তিষ্ক পর্যবেক্ষণ করেন। হঠাৎ তাঁদের প্রশ্ন করা হয়, ‘এই মুহূর্তে আপনি কী ভাবছেন?’ যাঁরা বলেছেন ‘কিছু চিন্তা করছি না’, তাঁদের মস্তিষ্কে একধরনের বিশেষ সংকেত পাওয়া গেছে। দেখা গেছে, তাঁদের মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ হঠাৎ একসঙ্গে কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ হয়ে যায় বা খুব কম সক্রিয় থাকে। মজার বিষয় হলো, এ ধরনের সংকেত ঘুম বা অজ্ঞান অবস্থাতেও দেখা যায়।’
বিজ্ঞানবিষয়ক ম্যাগাজিন পপুলার সায়েন্স-এর তথ্য মতে, অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে, মাথা শান্ত থাকলে মাইন্ড ব্ল্যাঙ্ক হওয়ার সম্ভবনা বেশি থাকে। অর্থাৎ, মাথা বেশি উত্তেজিত না থাকলে আমাদের ভাবনার ধারা থেমে যেতে পারে। তবে অতিরিক্ত উত্তেজনাতেও হতে পারে সমস্যা। বেশি চিন্তিত হলে ভাবনাগুলো গুলিয়ে যায়। তখন মাথা এত চিন্তায় ভরে যায় যে কিছুই আলাদা করে মনে থাকে না। এটাও একধরনের মাইন্ড ব্ল্যাঙ্ক।
আমাদের মস্তিষ্কের ভেতরের কাজকর্ম বোঝার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পদ্ধতিগুলোর একটি হলো ফাংশনাল ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং বা এফএমআরআই (fMRI)।
মাঝেমধ্যে কিছু রোগ বা মানসিক সমস্যার কারণে মস্তিষ্ক ব্ল্যাঙ্ক হয়ে যায়। এডিএইচডি রোগে এ সমস্যা বেশি দেখা যায়। এতে আক্রান্ত শিশুরা ওষুধ ছাড়া থাকলে প্রায়ই তাদের ভাবনার কথা ভুলে যায়। এমনকি যারা অতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় ভোগে, তাদের ভাবনাগুলোও গুলিয়ে যায়।
মস্তিষ্ক ব্ল্যাঙ্ক হওয়ার কারণ এখনো পুরোপুরি জানা যায়নি। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, ঘুম ও মস্তিষ্কের উত্তেজনার সঙ্গে এর সম্পর্ক থাকতে পারে। ঘুমের সময় নিউরন বিশ্রাম নেয়। দিনভর জমে থাকা সব পরিষ্কার করে ফেলে। অপ্রয়োজনীয় জিনিস পরিষ্কারের কাজটা জেগে থাকা অবস্থায়ও অল্প সময়ের জন্য হতে পারে। আমরা সেই ছোট্ট বিশ্রামের মুহূর্তগুলোকে বলি মাইন্ড ব্ল্যাঙ্ক। এটা একটু অতিসরলীকরণ হয়ে গেল, তবে বোঝার জন্য কথাটি ভুল নয়।
সব মিলিয়ে মাইন্ড ব্ল্যাঙ্ক হয়ে যাওয়া আসলে মস্তিষ্কের নিজেকে টিকিয়ে রাখার একধরনের কৌশল। এতে আমরা বাকি সময়টা পুরো মনোযোগ দিয়ে সচেতন থাকতে পারি।