একটা শক্তিশালী ক্যামেরার কথা কল্পনা করুন। ক্যামেরাটা এত শক্তিশালী যে সাড়ে ১৩ বিলিয়ন বছর আগের গ্যালাক্সিগুলোর আলো দেখতে পায়। এমনই এক অসাধারণ ক্যামেরা মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে যাত্রা শুরু করে এই টেলিস্কোপ। এখন সেটা ঘুরে বেড়াচ্ছে পৃথিবী থেকে দশ লাখ মাইল দূরে। প্রতিদিন মহাকাশের অসংখ্য ছবি তুলে পাঠাচ্ছে। সেগুলো দেখে বিস্মিত হচ্ছেন বিজ্ঞানীরাও। কিন্তু কীভাবে এই টেলিস্কোপ এত দূরের জিনিস দেখতে পায়?
এর রহস্য লুকিয়ে আছে টেলিস্কোপটির বিশেষ ক্যামেরায়। এই টেলিস্কোপ অসাধারণ এক হাতিয়ার। এটা দিয়ে আমরা মহাবিশ্বের প্রাচীনতম গ্যালাক্সি আর ব্ল্যাকহোলগুলো দেখতে পাই। জেমস ওয়েব যখন কোনো দূরের গ্যালাক্সির ছবি তোলে, তখন আমরা আসলে সেই গ্যালাক্সিটাকে বিলিয়ন বছর আগের মতো দেখি। কারণ, সেই গ্যালাক্সির আলো বিলিয়ন বছর ধরে মহাকাশ পাড়ি দিয়ে টেলিস্কোপের আয়নায় এসে পৌঁছায়। একটা বিশাল আয়না দিয়ে প্রাচীন সেই আলো সংগ্রহ করে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ আবিষ্কার করছে মহাবিশ্বের নতুন নতুন অনেক রহস্য।
টেলিস্কোপের সাহায্যে দেখা যায় তাপ
সাধারণ ক্যামেরা বা হাবল স্পেস টেলিস্কোপ দৃশ্যমান আলোর ছবি তোলে। কিন্তু জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ ছবি তোলে অন্যভাবে। এই টেলিস্কোপ এমন আলো দেখে, যা আমাদের খালি চোখে দেখা যায় না। এই আলোর নাম ইনফ্রারেড বা অবলোহিত আলো। এ আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য দৃশ্যমান আলোর চেয়ে বেশি। তাই আমাদের চোখ এটা ধরতে পারে না। কিন্তু একটা যন্ত্র দিয়ে জেমস ওয়েব এই আলো দেখতে পায়। আর এই আলোর সাহায্যেই ওটা মহাবিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো আর দূরের বস্তুগুলো খুঁজে বের করতে পারে।
মানুষের চোখ ইনফ্রারেড আলো দেখতে পায় না ঠিকই, কিন্তু বিশেষ প্রযুক্তি দিয়ে আমরা একে তাপ হিসেবে অনুভব করতে পারি। নাইট ভিশন গগলস এ আলো ব্যবহার করে অন্ধকারে গরম জিনিসগুলো খুঁজে বের করে। ওয়েবও একই পদ্ধতি ব্যবহার করে নক্ষত্র, গ্যালাক্সি আর গ্রহদের শনাক্ত করে।
কিন্তু কেন অবলোহিত আলো ব্যবহার করা হয়? আসল ব্যাপারটা হলো, দূরের গ্যালাক্সিগুলোর দৃশ্যমান আলোক তরঙ্গ মহাকাশ পাড়ি দেওয়ার সময় এগুলোর কম্পাঙ্ক প্রসারিত হয়। বিজ্ঞানের ভাষায় এই বিষয়কে বলা হয় রেড শিফট বা লোহিত সরণ। এর কারণ, মহাবিশ্ব ক্রমাগত বাড়ছে। এই প্রসারণের ফলে দৃশ্যমান আলো পরিণত হয় অবলোহিত আলোয়। তাই মহাকাশের সবচেয়ে দূরের গ্যালাক্সিগুলো আর দৃশ্যমান আলোয় চকচক করে না, অল্প অবলোহিত আলো বিকিরণ করে। আর সেই আলোই জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ ধরতে পারে।
অল্প আভা শনাক্ত করে সোনালি আয়না
ক্ষীণ বা অল্প আলো ক্যামেরায় পৌঁছানোর আগে সেটা সংগ্রহ করতে হয় ওয়েব টেলিস্কোপের বিশাল সোনালি আয়নায়। এই আয়না ২১ ফুটের বেশি চওড়া। এটা ১৮টি ছোট আয়নার টুকরো দিয়ে তৈরি। এগুলো মৌচাকের মতো একসঙ্গে জোড়া লেগে আছে। পুরো আয়নার ওপর পাতলা একটা সোনার প্রলেপ দেওয়া। এটা শুধু দেখতে সুন্দর লাগার জন্য নয়, স্বর্ণ ইনফ্রারেড আলো অসাধারণভাবে প্রতিফলিত করে।
এই আয়না মহাকাশের গভীর থেকে আলো সংগ্রহ করে টেলিস্কোপের যন্ত্রপাতির দিকে পাঠিয়ে দেয়। আয়না যত বড়, তত বেশি আলো সংগ্রহ করতে পারে। আর দেখতে পায় তত দূর পর্যন্ত। জেমস ওয়েবের আয়না এখন পর্যন্ত মহাকাশে পাঠানো সবচেয়ে বড় আয়না।
ক্যামেরার ভেতরের গল্প
টেলিস্কোপের ভেতরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র হলো এর দুটি ‘চোখ’। এগুলো আসলে ক্যামেরার মতো কাজ করে। এদের নাম নিয়ারক্যাম (NIRCam) আর মিরি (MIRI)। নিয়ারক্যাম মানে অবলোহিত আলোর কাছাকাছি লালচে আলো ধরতে পারে, এমন ক্যামেরা। জেমস ওয়েবের প্রধান ক্যামেরা এটাই। গ্যালাক্সি আর নক্ষত্রদের অসাধারণ ছবি তোলা হয় এই ক্যামেরার সাহায্যে। এর মধ্যে আছে একটা করোনাগ্রাফও। এই যন্ত্রটা নক্ষত্রের আলো আটকে দেয়। তাই উজ্জ্বল নক্ষত্রগুলোর কাছের ক্ষীণ জিনিসগুলোর ছবিও তোলা যায়।
নিয়ারক্যাম অবলোহিত আলোর কাছাকাছি তরঙ্গের আলোর ছবি তোলে। এই আলো মানুষের চোখে দেখা আলোর সবচেয়ে কাছাকাছি। এটা আলোকে বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যে ভাগ করে ফেলে। ফলে কোনো জিনিস দেখতে কেমন, তা বোঝার পাশাপাশি সেটা কী দিয়ে তৈরি, তাও জানতে পারেন বিজ্ঞানীরা। মহাকাশের বিভিন্ন পদার্থ নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যে অবলোহিত আলো শোষণ ও বিকিরণ করে। এ যেন একধরনের রাসায়নিক ছাপ। এই ছাপ দেখে বিজ্ঞানীরা দূরের নক্ষত্র আর গ্যালাক্সির বৈশিষ্ট্য বুঝতে পারেন।
আর মিরি মানে মিড-ইনফ্রারেড। এটা দীর্ঘতর অবলোহিত তরঙ্গ শনাক্ত করে। এই তরঙ্গ ঠান্ডা আর ধুলোময় জিনিস খুঁজে বের করতে বিশেষভাবে পারদর্শী। গ্যাসের মেঘের ভেতর যে নক্ষত্রগুলো এখনো তৈরি হচ্ছে, সেগুলোর ছবিও তুলতে পারে মিরি। এমনকি গ্রহের বায়ুমণ্ডলে কী ধরনের অণু আছে, তাও খুঁজে বের করতে পারে।
এই দুটি ক্যামেরা পৃথিবীর সাধারণ ক্যামেরার চেয়ে অনেক বেশি সংবেদনশীল। নিয়ারক্যাম আর মিরি বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূর থেকে আসা সামান্য তাপও ধরতে পারে। যদি আপনার চোখ জেমস ওয়েবের নিয়ারক্যামের মতো হতো, তাহলে চাঁদের ওপর বসে থাকা একটা মৌমাছির তাপও দেখতে পেতেন।
মিরির জন্য তাপমাত্রা আরও কম হতে হয়। সে জন্য আছে বিশেষ একটা ফ্রিজ। আসলে শীতক যন্ত্র। এর নাম ক্রায়োকুলার। এটা মিরিকে প্রায় মাইনাস ৪৪৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত ঠান্ডা রাখে।
জেমস ওয়েব যেভাবে ঠান্ডা থাকে
জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ দূরের বস্তুর ক্ষীণ তাপ ধরার চেষ্টা করে। তাই নিজেকে যতটা সম্ভব ঠান্ডা রাখতে হয়। এ জন্য টেলিস্কোপটি সঙ্গে নিয়ে গেছে একটা বিশাল সান শিল্ড। সূর্য নিরোধক ঢাল। এটা একটা টেনিস কোর্টের সমান বড়। পাঁচ স্তরের এই শিল্ড বা ঢাল সূর্য, পৃথিবী আর চাঁদের তাপ আটকে দেয়। এতে জেমস ওয়েব অবিশ্বাস্যরকম ঠান্ডা থাকে। এর তাপমাত্রা থাকে প্রায় মাইনাস ৩৭০ ডিগ্রি ফারেনহাইট।
তবে মিরির জন্য তাপমাত্রা আরও কম হতে হয়। সে জন্য আছে বিশেষ একটা ফ্রিজ। আসলে শীতক যন্ত্র। এর নাম ক্রায়োকুলার। এটা মিরিকে প্রায় মাইনাস ৪৪৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত ঠান্ডা রাখে। কারণ, জেমস ওয়েব যদি একটু গরমও হয়ে যায়, তাহলে ওটার নিজের তাপেই দূরের সংকেতগুলো চাপা পড়ে যাবে।
আলো যেভাবে ছবিতে পরিণত হয়
জেমস ওয়েবের ক্যামেরায় আলো পৌঁছানোর পর সেটা সেন্সরে আঘাত করে। এই সেন্সরগুলোকে বলে ডিটেক্টর। এগুলো ফোনের ক্যামেরার মতো সাধারণ ছবি তোলে না, বরং অবলোহিত আলোকে ডিজিটাল তথ্যে রূপান্তর করে। সেই তথ্য পাঠানো হয় পৃথিবীতে। বিজ্ঞানীরা সেটাকে রঙিন ছবিতে পরিণত করেন।
জেমস ওয়েবের ছবিতে আমরা যে রং দেখি, ক্যামেরা সেটা সরাসরি দেখে না। কারণ, ইনফ্রারেড বা অবলাল আলো অদৃশ্য। বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যকে আলাদা আলাদা রং দিয়ে শনাক্ত করেন। এতে আমরা প্রতিটি ছবির মানে বুঝতে পারি। এই প্রক্রিয়াজাত ছবিগুলো গ্যালাক্সি, নক্ষত্র আর অন্যান্য বস্তুর গঠন, বয়স আর উপাদান দেখায়। এভাবেই জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ আমাদের মহাবিশ্ব সৃষ্টির ঠিক পরের ছবিগুলো দেখাতে পারে।