শনি গ্রহের আকারের প্রথম এক্সোপ্ল্যানেটের ছবি তুলেছে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ

সম্প্রতি জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ শনি গ্রহের আকারের এক্সোপ্ল্যানেট বা বহিঃসৌরগ্রহের সরাসরি ছবি তুলেছে। টিডব্লিউএ ৭বি (TWA 7b) নামে এই গ্রহ পৃথিবী থেকে ১১০ আলোকবর্ষ দূরে রয়েছে। দীর্ঘ তিন বছর ধরে সৌরজগতের বাইরে পরিচিত গ্রহগুলো নিয়ে গবেষণার পর, এবার এই শক্তিশালী টেলিস্কোপটি প্রথমবারের মতো একটি নতুন গ্রহের সরাসরি ছবি তুলতে পেরেছে। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এটি আগের দেখা যেকোনো গ্রহের চেয়ে হালকা।

টিডব্লিউএ ৭বি গ্রহটি একটি গ্যাসদানব। এটি প্রায় শনি গ্রহের সমান। প্রায় ৬০ লাখ বছরেরও বেশি পুরোনো একটি নক্ষত্রকে এটি প্রদক্ষিণ করছে। গ্রহটি গঠনের সময় থেকে এখনো উত্তপ্ত অবস্থায় আছে এবং জ্বলছে। এর আনুমানিক ভর পৃথিবীর প্রায় ১০০ গুণ, বৃহস্পতির ভরের ০.৩ গুণ। আগে যে সব এক্সোপ্ল্যানেটের ছবি তোলা হয়েছে, সেগুলোর চেয়ে এটি দশ গুণ হালকা।

এই আবিষ্কার থেকে আমরা জানতে পেরেছি, গ্রহগুলো এদের চারপাশে থাকা ধুলো আর পাথরের গোল বলয়গুলোর মধ্যে ফাঁকা জায়গা তৈরি করতে পারে। আগে এমনটা শুধু ধারণাই করা হতো, কিন্তু এবারই প্রথম আমরা তা সরাসরি দেখতে পেলাম।

নতুন এই গ্রহটি ‘শেফার্ড’ গ্রহের সরাসরি প্রমাণ। আগে এ ধরনের গ্রহ দেখা যায়নি, তবে এর অস্তিত্ব অনুমান করা গেছে। ইংরেজি ‘শেফার্ড’ কথাটির অর্থ ‘রাখাল’। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা অবশ্য এ শব্দ ব্যবহার করেন গ্রহ বা উপগ্রহের বলয় ধরে রাখা বোঝাতে। আগে এ ধরনের বেশ কিছু চাঁদ বা উপগ্রহ দেখা গেছে। এই উপগ্রহগুলো গ্রহের বলয়ের কাছাকাছি থেকে মহাকর্ষ বলের মাধ্যমে বলয়ের কণাগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। অর্থাৎ গ্রহকে বলয়ের গঠন ঠিক রাখতে সহায়তা করে। পাশাপাশি বলয়ের মাঝে ফাঁকা জায়গা তৈরি করতে পারে। আর শেফার্ড গ্রহ নিজেই একাধিক দিকগামী বলয়কে ধরে রাখে, শাসনে রাখে এবং বলয়ের মাঝে ফাঁকা জায়গা তৈরি করতে পারে।

আরও পড়ুন

টিডব্লিউএ ৭বি গ্রহটি এর নিজের ঘূর্ণন পথে থাকা বলয়ের ধুলো বা ধ্বংসাবশেষের ফাঁকা জায়গাগুলো তৈরি করেছে। এবং এটি আশপাশের একাধিক দিকগামী বলয়গুলোকে ভালোভাবেই শাসনে রেখেছে। এই আবিষ্কারের পেছনের বিজ্ঞানীরা গত ২৫ জুন নেচার জার্নালে তাদের গবেষণাটি প্রকাশ করেন।

কম্পিউটার সিমুলেশন করে দেখা গেছে, এই আলোর উৎস সম্ভবত বৃহস্পতির প্রায় ৩০ শতাংশ আকারের একটি গ্রহের
ছবি: জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ

ফ্রান্স ন্যাশনাল সেন্টার ফর সায়েন্টিফিক রিসার্চের জ্যোতির্বিদ ও এই গবেষণার পরিচালক অ্যান-মারিয়ে লাগরাঙ্গে বলেন, ‘এই আবিষ্কার থেকে আমরা জানতে পেরেছি, গ্রহগুলো এদের চারপাশে থাকা ধুলো আর পাথরের গোল বলয়গুলোর মধ্যে ফাঁকা জায়গা তৈরি করতে পারে। আগে এমনটা শুধু ধারণাই করা হতো, কিন্তু এবারই প্রথম আমরা তা সরাসরি দেখতে পেলাম। এ থেকে আরও বোঝা যাচ্ছে, সৌরজগতের মতো ট্রোজান নামে বিশেষ ধরনের গ্রহাণু বা বস্তুগুলো অন্য গ্রহ ব্যবস্থায়ও থাকতে পারে।’

তিনি আরও জানান, ‘এই প্রথমবার এত হালকা একটি গ্রহের ছবি তোলা সম্ভব হলো। আগে আমরা যত হালকা গ্রহের ছবি তুলেছি, এটি তার চেয়েও দশ গুণ হালকা।’

এই আলোর উৎস সম্ভবত বৃহস্পতির প্রায় ৩০ শতাংশ আকারের একটি গ্রহের। পৃথিবী সূর্যকে যে দূরত্বে থেকে প্রদক্ষিণ করে, টিডব্লিউএ ৭বি গ্রহটি তার নক্ষত্র থেকে সে তুলনায় ৫২ গুণ বেশি দূরত্বে থেকে প্রদক্ষিণ করছে।

জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সৌরজগতের বাইরের গ্রহগুলো, অর্থাৎ বহিঃসৌরগ্রহ নিয়ে গবেষণা করেন, কারণ এর মাধ্যমে তাঁরা আমাদের সৌরজগতের গ্রহগুলো কীভাবে তৈরি হয়েছে, তা আরও ভালোভাবে বুঝতে পারেন। যদিও হাজার হাজার বহিঃসৌরগ্রহের সন্ধান পাওয়া গেছে, কিন্তু এদের বেশির ভাগেরই সরাসরি ছবি তোলা কঠিন। কারণ, ওসব গ্রহ থেকে আসা আলো সাধারণত নক্ষত্রের প্রবল আলোয় ঢাকা পড়ে যায়। ফলে তাদের দেখা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। সাধারণত স্কাই-ম্যাপিং স্যাটেলাইটগুলো রাতের আকাশের ছবি তুলে তাতে আলোর পরিমাণ ও বর্ণালি বিশ্লেষণ করে ওগুলোর অবস্থান শনাক্ত করা হয়। কিন্তু জেমস ওয়েব বা হাবলের মতো নভোদুরবিনগুলো এসব বহিঃসৌরগ্রহের কোনো কোনোটির ছবি তুলতে পারে।

আরও পড়ুন

বিশেষ এই দৃশ্যটি দেখার জন্য জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ তার মিড-ইনফ্রারেড ইন্সট্রুমেন্টের (MIRI) সঙ্গে যুক্ত একটি করোনাগ্রাফ ব্যবহার করেছে। এই যন্ত্র নক্ষত্রের তীব্র আলো আটকে দেয়। ফলে এর চারপাশে বস্তুগুলোকে খুঁজে পাওয়া সহজ হয়। গবেষণাটি আরও কার্যকর করতে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এমন কিছু নতুন নক্ষত্র বেছে নেন, যেগুলোর গ্রহ তৈরি হওয়ার ধুলোর বলয়গুলো টেলিস্কোপের দিকে সরাসরি মুখ করে আছে।

জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সৌরজগতের বাইরের গ্রহগুলো, অর্থাৎ বহিঃসৌরগ্রহ নিয়ে গবেষণা করেন, কারণ এর মাধ্যমে তাঁরা আমাদের সৌরজগতের গ্রহগুলো কীভাবে তৈরি হয়েছে, তা আরও ভালোভাবে বুঝতে পারেন।

টিডব্লিউএ ৭বি গ্রহটি যে নক্ষত্রমণ্ডলে আছে, সেটিকে টিডব্লিউএ ৭ (TWA 7) বলা হয়। এখানে পাথরের ভাঙা অংশ ও ধুলোর তিনটি গোল বলয় আছে। এর একটি সরু ও দুটি খালি জায়গা দিয়ে ঘেরা। বিজ্ঞানীরা এই সরু বলয়ের ঠিক মাঝখানে একটি গর্ত খুঁজে পেয়েছেন, যেখান থেকে ইনফ্রারেড বা অবলোহিত আলো বেরিয়ে আসছে।

পরে কম্পিউটার সিমুলেশন করে দেখা গেছে, এই আলোর উৎস সম্ভবত বৃহস্পতির প্রায় ৩০ শতাংশ আকারের একটি গ্রহের। পৃথিবী সূর্যকে যে দূরত্বে থেকে প্রদক্ষিণ করে, টিডব্লিউএ ৭বি গ্রহটি তার নক্ষত্র থেকে সে তুলনায় ৫২ গুণ বেশি দূরত্বে থেকে প্রদক্ষিণ করছে। গ্রহের বলয়ের মধ্যকার ফাঁকা জায়গায় এর উপস্থিতি বেশ কৌতূহল করে তুলেছে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ

সূত্র: লাইভ সায়েন্স, দ্য গার্ডিয়ান, স্পেস ডটকম

আরও পড়ুন