মহাকাশ নিয়ে কৌতূহলী মানুষদের জন্য সুখবর! বিশ্বের সবচেয়ে বড় ডিজিটাল টেলিস্কোপের সাহায্যে তোলা প্রথম ছবিগুলো ২৩ জুন, সোমবার প্রকাশিত হয়েছে। এসব ছবিতে মহাবিশ্বের বিস্ময়কর ও বিস্তৃত রূপ ধরা পড়েছে। ভেরা সি রুবিন অবজারভেটরির এই ছবিগুলো দেখে বিজ্ঞানীরা নিজেরাই অভিভূত হয়েছেন।
প্রথম ছবিতে দেখা যাচ্ছে ট্রিফিড এবং লেগুন নেবুলার গোলাপি রঙের এক মনোরম দৃশ্য। ধনু নক্ষত্রমণ্ডলে (স্যাজিটেরিয়াস) অবস্থিত এই দুটি বিশাল ধূলিকণা ও গ্যাসের মেঘ পৃথিবী থেকে হাজার হাজার আলোকবর্ষ দূরে রয়েছে। এই নেবুলা দুটির ছবি আগেও অনেকবার তোলা হয়েছে। পেশাদার ও শখের জ্যোতির্বিদরা এগুলোকে ক্যামেরাবন্দি করেছেন। অনেক শক্তিশালী যন্ত্র দিয়ে আরও বিস্তারিত ছবিও তোলা হয়েছে। কিন্তু সেগুলোর সাহায্যে পুরো দৃশ্যের একটা ছোট অংশই দেখা যেত। এবার ভেরা সি রুবিন টেলিস্কোপের সাহায্যে এই দৃশ্যের পুরোটা দেখা যাচ্ছে।
এই টেলিস্কোপের নামকরণ করা হয়েছে জ্যোতির্বিদ ভেরা রুবিনের নামে। মহাবিশ্বে ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্ব আবিষ্কারের জন্য তিনি পরিচিত। টেলিস্কোপটির অনন্য নকশার কারণে এটি একইসঙ্গে গভীর ও প্রশস্তভাবে মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্তা ক্রুজ ক্যাম্পাসের পদার্থবিদ ও ভেরা সি রুবিন প্রকল্পের বিজ্ঞানী স্টিভেন রিৎজ বলেন, ‘এভাবে পুরো দৃশ্যটা একসঙ্গে এত গভীরভাবে আপনি আগে কখনো দেখেননি। এটা কতটা সুন্দর, দেখুন একবার!’
যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব এনার্জি এবং ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউণ্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত ভেরা সি রুবিন অবজারভেটরি রাতের আকাশের এমন এক বিস্তৃত দৃশ্য দেখাবে, যা জ্যোতির্বিদরা আগে কখনো দেখেননি। এই অবজারভেটরির অবস্থান চিলির উত্তরাঞ্চলে, আন্দিজ পর্বতমালার পাদদেশে আতাকামা মরুভূমির প্রান্তে একটি পর্বতের ওপর। উঁচু ও শুষ্ক এই স্থানে আকাশ পরিষ্কার থাকে। ফলে মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করা যায় ভালোভাবে।
এই টেলিস্কোপের নামকরণ করা হয়েছে জ্যোতির্বিদ ভেরা রুবিনের নামে। মহাবিশ্বে ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্ব আবিষ্কারের জন্য তিনি পরিচিত। টেলিস্কোপটির অনন্য নকশার কারণে এটি একইসঙ্গে গভীর ও প্রশস্তভাবে মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করতে পারে। টানা দশ বছর ধরে প্রতি তিন থেকে চার দিনে একবার পুরো আকাশ স্ক্যান করে লাখ লাখ বিস্ফোরিত নক্ষত্র, গ্রহাণু এবং বিকৃত স্থান-কালের ছবি তুলবে এই টেলিস্কোপ।
এই বিপুল তথ্যভাণ্ডার ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জির রহস্য উন্মোচনে জ্যোতির্বিদদের নতুন দ্বার খুলে দেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পৃথিবীর কাছাকাছি এলাকায় এটি এমন সব গ্রহাণু চিহ্নিত করবে যেগুলো হয়তো পৃথিবীর সঙ্গে সংঘর্ষের পথে রয়েছে।
ট্রিফিড ও লেগুন নেবুলার ছবিটি আসলে চার রকমের রঙের ফিল্টার দিয়ে তোলা ৬৫০টি ছবির সমন্বয়। এটি আকাশের এমন একটি এলাকা দেখাচ্ছে, যা প্রায় ৬০টি পূর্ণিমার চাঁদের সমান। ভেরা সি রুবিনের প্রচার বিশেষজ্ঞ ক্লেয়ার হিগস এই ছবিকে ‘নক্ষত্রের নার্সারি’ বলে উল্লেখ করেছেন। এই ছবিতে খুব তরুণ ও উত্তপ্ত নক্ষত্র রয়েছে। কিছু নক্ষত্র রয়েছে যেগুলো সদ্য গঠিত হচ্ছে।
ছবির নীল অংশগুলো তরুণ উত্তপ্ত নক্ষত্রের আলোয় আলোকিত আর সেই আলো ধূলিকণায় ছড়িয়ে পড়েছে। গোলাপি রং সম্ভবত হাইড্রোজেন পরমাণুর নিঃসরণ থেকে এসেছে। আর কালো সুতোর মতো অংশগুলো হলো ধূলিকণার পথ।
আরও দুটি প্রাথমিক ছবিতে দেখা যাচ্ছে ভার্গো ক্লাস্টারের কয়েকটি অংশ। এটি প্রায় ৫৫ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের একদল ছায়াপথ। এই দুটি ছবি মে মাসের শুরুতে চার রাত ধরে তোলা একটি বড় ছবি থেকে কেটে নেওয়া হয়েছে। এই ছবির ব্যাপারে ক্লেয়ার হিগস বলেন, ‘ছবিটি যতবার জুম করবেন, নতুন কোনো মজার জিনিস খুঁজে পাবেন।’
আর ছবির সামনের দিকে রয়েছে উজ্জ্বল নক্ষত্র। এগুলো আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির মধ্যে রয়েছে। পেছনে রয়েছে অনেক দূরের গ্যালাক্সি। ওগুলো লালচে রঙের। কারণ, প্রসারণশীল মহাবিশ্বে দূরের বস্তুগুলো দ্রুত আরও দূরে সরে যাচ্ছে। মাঝামাঝি রয়েছে ভার্গো ক্লাস্টারের গ্যালাক্সিগুলো। গ্যালাক্সির মধ্যে যে নীল বিন্দুগুলো দেখা যাচ্ছে, সেগুলো নক্ষত্র গঠনের এলাকা। এখানে তরুণ ও উত্তপ্ত নক্ষত্র রয়েছে।
দশ বছরের নির্মাণকাজের পর সম্পূর্ণ টেলিস্কোপ ১৫ এপ্রিল প্রথমবার ফোটন (আলোর কণা) ধরতে পেরেছিল। প্রথম ছবিটি নিখুঁত ছিল না। নক্ষত্রগুলো আলোর বিন্দুর বদলে বাদামের মতো দেখাচ্ছিল। কিন্তু ঝাপসা দাগের বদলে বাদামের মতো দেখানোর মানে, আয়নাগুলো খুব বেশি অসামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। মাত্র কয়েকটা সমন্বয়ের পর বাদামগুলো বিন্দুতে পরিণত হলো। তখন থেকে ভেরা সি রুবিনের প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানীরা এই জটিল টেলিস্কোপের ক্রমাঙ্কন ও সূক্ষ্ম সমন্বয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। এই টেলিস্কোপের বৈজ্ঞানিক কার্যক্রম ও দশ বছরের সমীক্ষা পুরোদমে শুরু হবে চলতি বছর অক্টোবর মাসে।
টেলিস্কোপটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় টেলিস্কোপ না হলেও এটি এক প্রযুক্তিগত বিস্ময়। এর প্রধান আয়না ২৮ ফুট চওড়া । দ্বিতীয় আয়না ১১ ফুট চওড়া। এটিই বিশ্বের সবচেয়ে বড় ডিজিটাল ক্যামেরা। চৌম্বকীয় মোটরে ভাসমান এই ৩০০ টনের কাঠামো একবারে পুরো আকাশ স্ক্যান করতে পারে মাত্র আধা মিনিটে। এই দ্রুত গতির কারণে টেলিস্কোপটি আকাশ ভালোভাবে নজর রেখে প্রতি রাতে প্রায় এক হাজারের বেশি ছবি তুলতে পারে।
