যে গ্রহে হিরের বৃষ্টি ঝরে

নেপচুন আর পলিথিন—দুটোর মধ্যে কী কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে? সাধারণ দৃষ্টিতে এই দুইয়ের মধ্যে যোজন যোজন দূরত্ব। তাদের মধ্যে ন্যূনতম মিল থাকার কথা নয়। একটিকে আমরা চিনি সৌরজগতের দূরতম এক রহস্যময় গ্রহ হিসেবে। আর অন্যটি ব্যবহৃত হয় বাজারের ব্যাগ, খাবারের প্যাকেট বা কফির কাপের উপাদান হিসেবে। কিন্তু অন্তত একটা জায়গায় দুটোর মিল আছে। আর তাই সামান্য এই পলিথিন পরীক্ষা করেই নেপচুনের ভেতরের জগতের গভীর রহস্য ভেদ করেছেন বিজ্ঞানীরা।

সৌরজগতের অস্টম গ্রহ নেপচুন। সূর্য থেকে তো বটেই, পৃথিবী থেকেও নেপচুনের দূরত্ব অনেক। গণিতের ভাষায় এর পরিমাণ প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন কিলোমিটার। গ্রহটা এত দূরে যে সূর্যের আলোও সেখানে পৌঁছাতে লাগে প্রায় চার ঘণ্টা। আর সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে লাগে মাত্র সাড়ে ৮ মিনিট! আবার সূর্যের চারপাশে নেপচুনের একবার ঘুরে আসতে সময় লাগে প্রায় ১৬৫ বছর। বহুদূর হওয়ার কারণেই সেখানে কখনো মানুষ পা পড়েনি। ভবিষ্যতেও পড়বে কি না, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবে মানুষের তৈরি একটা যন্ত্র এ গ্রহের কাছ ঘেঁষে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিল একবার। সেটি ছিল ভয়েজার ২ নভোযান। তাও পৃথিবী থেকে এ নভোযানের নেপচুনে পৌঁছাতে সময় লেগেছিল পাক্কা ১২ বছর। ১৯৮৯ সালে নেপচুনের কাছে পৌঁছেছিল ভয়েজার ২। সে সময় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ছবি ও তথ্য-উপাত্ত পৃথিবীতে পাঠিয়েছে নভোযানটি।

শুরুতে বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন, তাঁদের হিসেবে হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে। তাই সেগুলো আবারও গণনা করে দেখা গেল, না কোনো ভুল নেই। আবার ভয়েজার ২ থেকে নেপচুন সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে দেখা গেল, গ্রহটা কতটা আলো প্রতিফলিত করে।

সেসব বিশ্লেষণ করে দূরের এই বরফজগৎ সম্পর্কে যেসব বিষয় উদঘাটন করা সম্ভব হয়েছে, তাতে অবাক হতে হয়েছেন বিজ্ঞানীরা। যেমন নেপচুনে বাতাসের কথাই ধরা যাক। এ গ্রহে বয়ে যাচ্ছে ঝড়। সেটা যা তা ঝড় নয়, খুব শক্তিশালী ঝড়। বিজ্ঞানীরা বলেন, সেটিই সৌরজগতের সবচেয়ে দ্রুত গতির ঝড়। সেখানে বাতাসের গতি এত বেশি যে তা শব্দের গতিকেও হার মানায়। সে গতি ঘণ্টায় প্রায় ২১০০ কিলোমিটার! কিন্তু সেটা জানা গেল কীভাবে? বিজ্ঞানীরা সেটা টের পেয়েছেন অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে এর উজ্জ্বল সাদা মেঘকে গ্রহের চারপাশে ঘুরতে দেখে। সেটার নাম দেওয়া হয়েছে গ্রেট ডার্ক স্পট। ভয়েজার ২ এবং হাবল স্পেস টেলিস্কোপের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করে এসব জানতে পারা গেছে।

আরও পড়ুন

আরও অবাক করা ব্যাপার হলো, গ্রহ হিসেবে নেপচুন বেশ উষ্ণ। আসলে বলা উচিত, বিজ্ঞানীদের প্রত্যাশার চেয়েও বেশি গরম সেখানে। সাধারণভাবে, কোনো গ্রহ সূর্যের থেকে যে পরিমাণ তাপ পায় এবং তাৎক্ষণিকভাবে যতটা ফিরিয়ে দেয়, তার মধ্যে একটা ভারসাম্য থাকার কথা। এই দুইয়ের পার্থক্যের সমীকরণ থেকেই মাপা যায় গ্রহটির তাপমাত্রা। কিন্তু এই সমীকরণ থেকে নেপচুনের যে তাপমাত্রা পাওয়ার কথা, তার প্রকৃত তাপমাত্রা তার চেয়েও বেশি। এর মানে হলো, কোথাও একটা রহস্য লুকিয়ে আছে। আর তার কারণেই হয়তো নেপচুনের এমন খরতপ্ত ভাব। কিন্তু সেই রহস্যটা কী?

নেপচুন গ্রহ
ছবি: সংগৃহীত

শুরুতে বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন, তাঁদের হিসেবে হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে। তাই সেগুলো আবারও গণনা করে দেখা গেল, না কোনো ভুল নেই। আবার ভয়েজার ২ থেকে নেপচুন সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে দেখা গেল, গ্রহটা কতটা আলো প্রতিফলিত করে। চুলচেরা বিশ্লেষণে দেখা গেল, নেপচুনে যে পরিমাণ আলো পড়ে, তার ২৯ ভাগই প্রতিফলিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে মহাকাশে। তার মানে, সূর্যের আলোর অনেকটাই বেরিয়ে আসছে বাইরে। তাই তার তাপমাত্রা বেশ কমই হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবে পাওয়া যাচ্ছে তার চেয়ে বেশি তাপমাত্রা। তাহলে সূর্যের আলো ছাড়াও নিজেকে উত্তপ্ত রাখার নিশ্চয়ই অন্য কোনো উপায় রয়েছে নেপচুনে। বিশেষ কোনো প্রক্রিয়ায় নেপচুনে হয়তো তাপ তৈরি হচ্ছে।

কার্বন একে-অপরের সঙ্গে জুড়ে পরিণত হয় হিরের মতো কঠিন স্ফটিকে। এই হিরেগুলো ভারী হয়ে ধীরে ধীরে নামতে থাকে নেপচুনের কেন্দ্রের দিকে। অনেকটা আকাশ থেকে বৃষ্টি পড়ার মতো ব্যাপার।

তবে শুধু নেপচুন নয়, বৃহস্পতি আর শনিও সূর্যের যেটুকু আলো শুষে নেয়, তার চেয়ে বেশি গরম। তবে নেপচুনের উষ্ণ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটা একটু অন্যরকমও হতে পারে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এর কারণ হয়তো নেপচুনের ভেতরে হিরের বৃষ্টি ঝরছে!

হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। হিরে। তবে সেগুলো এমন হিরে, যা প্রায় চোখেই দেখা যায় না। ছোট ছোট—ন্যানো আকারের।

আরও পড়ুন

নেপচুনের বায়ুমণ্ডল মূলত হাইড্রোজেন, হিলিয়াম এবং মিথেন গ্যাস দিয়ে গঠিত। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নেপচুনের বেশির ভাগই হাইড্রোজেন আর হিলিয়াম দিয়ে তৈরি, কিন্তু এর সুন্দর নীল রঙের কারণ হলো মিথেন গ্যাস। বিজ্ঞানীরা বলেন, নেপচুনের গভীরে যে চাপ আর তাপ রয়েছে, তা এত বেশি যে বায়ুমণ্ডলে থাকা মিথেন গ্যাসের ভেতরের কার্বন আর হাইড্রোজেন আলাদা হয়ে যায়। উড়ে যায় হাইড্রোজেন। আর কার্বন একে-অপরের সঙ্গে জুড়ে পরিণত হয় হিরের মতো কঠিন স্ফটিকে। এই হিরেগুলো ভারী হয়ে ধীরে ধীরে নামতে থাকে নেপচুনের কেন্দ্রের দিকে। অনেকটা আকাশ থেকে বৃষ্টি পড়ার মতো ব্যাপার। সেই হিরেগুলো ঘন বাতাসের মধ্যে দিয়ে পড়ার সময় ঘর্ষণের ফলে তৈরি হয় তাপ। এভাবে নেপচুন নিজেই নিজেকে ঘষে ঘষে গরম করে তুলছে।

কিন্তু বিজ্ঞানীদের এ ধারণা কি শুধুই কল্পনা? নাকি স্রেফ কোনো গাণিতিক হিসেব? নাকি বাস্তবতাও আছে এতে? আর এরকম অদ্ভুত ধারণাটা তাদের মাথায় এলই-বা কী করে?

সে জবাব দেওয়ার আগে বলে রাখি, আমরা যে হিরে চিনি, সেটা আসলে কার্বনের একটা পালিশ করা টুকরো। কার্বনকে প্রচণ্ড তাপ আর চাপে একসঙ্গে মেশালে তৈরি হয় হিরে। প্রাকৃতিকভাবে এভাবেই হিরে তৈরি হয়। কৃত্রিমভাবেও এই প্রক্রিয়ায় হিরে তৈরি করে দেখেছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা মনে করেন, নেপচুনের বায়ুমণ্ডলে প্রচণ্ড চাপের কারণে সেখানে তাপমাত্রাও অনেক বেশি। আবার সেখানে কার্বনও আছে যথেষ্ট।

বিজ্ঞানীরা দেখলেন, নেপচুনে না গিয়েও যদি তার ভেতরের কাজকর্ম বুঝতে হয়, তাহলে পলিথিনের ওপর লেজার রশ্মি ফেলা যেতে পারে। নেপচুন পলিথিন দিয়ে তৈরি নয়—ওটা হাইড্রোজেন, হিলিয়াম আর মিথেন দিয়ে তৈরি।

বিজ্ঞানীদের ধারণা, নেপচুনের এই কার্বনগুলো আসছে মিথেন থেকে। মিথেন হলো হাইড্রোকার্বন গোত্রের একটা সাধারণ অণু। হাইড্রোকার্বন মানেই হলো হাইড্রোজেন আর কার্বন দিয়ে তৈরি অণু। মিথেনে একটা কার্বন পরমাণু আর চারটা হাইড্রোজেন পরমাণু থাকে। নেপচুন এই মিথেনের মধ্যেই তার কার্বন লুকিয়ে রেখেছে। হাইড্রোজেনের সঙ্গে জোড়া বাঁধা থাকলেও সেখানে প্রচুর মিথেন আছে। আসল প্রশ্ন হলো, নেপচুনের ভেতরের তাপমাত্রা আর চাপে কি কার্বন আর হাইড্রোজেন আলাদা হয়ে হিরে তৈরি করতে পারবে?

আরও পড়ুন

আমরা প্রতিদিনই নানাভাবে হাইড্রোকার্বন ব্যবহার করি। যেমন প্রোপেন গ্যাস, যা আমরা গ্যাসের চুলা আর ফায়ারপ্লেসে ব্যবহার করি। আরেকটা হলো পলিথিন। এটাও একধরনের হাইড্রোকার্বন। এর একেকটা ইউনিটে আটটা কার্বন আর আটটা হাইড্রোজেন থাকে। সেগুলো একের পর এক চেইনের মতো জুড়ে তৈরি হয় প্লাস্টিক।

বিজ্ঞানীরা দেখলেন, নেপচুনে না গিয়েও যদি তার ভেতরের কাজকর্ম বুঝতে হয়, তাহলে পলিথিনের ওপর লেজার রশ্মি ফেলা যেতে পারে। নেপচুন পলিথিন দিয়ে তৈরি নয়—ওটা হাইড্রোজেন, হিলিয়াম আর মিথেন দিয়ে তৈরি। মিথেনও পলিথিন নয়, তবে দুটোই একই জিনিস দিয়ে তৈরি। তবে পলিথিনের সুবিধা হলো, এটা ঘরের তাপমাত্রায় কঠিন থাকে, দামেও বেশ সস্তাও। তা ছাড়া মিথেনের মতো বাতাসের সঙ্গে মিশে ভুল ঘনত্বে এলে ততটা বিস্ফোরকের মতো আচরণও করে না। তবে এর কিছু অসুবিধাও আছে। যেমন নেপচুন খুব গরম আর ঘন, কিন্তু পলিথিন তেমনটা নয়। তাহলে একটা ফেলে দেওয়া কফি কাপকে কীভাবে নেপচুনের ভেতরের মতো বানানো যায়?

তখন বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করলেন এক শক্তিশালী লেজার! এই লেজার রশ্মি পলিথিনের ওপর ফেলে দেখা হলো, কী ঘটে। দেখা গেল, লেজার পলিথিনকে এত গরম করে তুলল যে তার কিছু অংশ হঠাৎ করে প্লাজমায় পরিণত হয়। তাতে সেটা বাইরের দিকে বিস্ফোরিত হয়। ফলে একটা ছোট ধাক্কার মতো তরঙ্গ তৈরি হয়, যা আশপাশের পলিথিনের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে। এই প্রক্রিয়ায় এক পর্যায়ে প্লাস্টিকের হাইড্রোজেন ও কার্বন আলাদা হয়ে যায়। এরপর কার্বনগুলো ক্রিস্টালের আকার ধারণ করে। অর্থাৎ হিরের ন্যানো পার্টিকেল হিসেবে বেরিয়ে আসে!

আরও পড়ুন
ছোট হোক বড় হোক, নেপচুনের হিরের বৃষ্টিগুলো কোথায় ঝরে পড়ে? সেখানে কি কোনো কঠিন মাটি আছে যেখানে সেগুলো পড়বে? নাকি কোনো তরলের স্তর? হিরেগুলো কি নেপচুনের কেন্দ্রে গিয়ে জমা হচ্ছে?

ল্যাবরেটরিতে এহেন দৃশ্য দেখে বিজ্ঞানীরা বুঝলেন, তাঁদের ধারণা মিথ্যে নয়। যথেষ্ট তাপ ও চাপে পলিথিনে আঘাত করা হলে সত্যিই হিরে তৈরি হতে পারে। একই যুক্তিতে, নেপচুনে হিরে তৈরি হওয়া সম্ভব। সেই যুক্তির ওপর ভর করে বিজ্ঞানীরা মনে করেন, নেপচুনের আকাশেও হিরের বৃষ্টি হচ্ছে। অনেকে মনে করেন নেপচুনের হিরেগুলো হয়তো অনেক বড়, অনেক ভারীও হতে পারে। কারণ ল্যাবরেটরির হিরেগুলো ক্ষণস্থায়ী হলেও নেপচুনের গভীরে তো সেই তাপ আর চাপ সবসময়ই থাকে!

ছোট হোক বড় হোক, নেপচুনের হিরের বৃষ্টিগুলো কোথায় ঝরে পড়ে? সেখানে কি কোনো কঠিন মাটি আছে যেখানে সেগুলো পড়বে? নাকি কোনো তরলের স্তর? হিরেগুলো কি নেপচুনের কেন্দ্রে গিয়ে জমা হচ্ছে? নেপচুনের ভেতরে কি হিরের কোনো স্তর আছে? নাকি সেখানে হিরের বরফখণ্ডও ভাসছে?

এ সবের উত্তর এখনো কেউ নিশ্চিতভাবে জানে না। কেউ কেউ মনে করেন, নেপচুনের ভেতরটা হয়তো হিরের বরফে ঢাকা। সেটাও যৌক্তিক কল্পনা। বাস্তব ব্যাপারটা যে কী, তা জানতে হলে, নেপচুনে গিয়েই জানতে হবে; নয়তো নেপচুনে পাঠাতে হবে রোবটবাহী কোনো নভোযান। ততদিন পর্যন্ত আমাদের কল্পনাই সার।

সূত্র:  দ্য মিল্কিওয়ে স্মেলস অব রাম অ্যান্ড র‍্যাস্পবেরি/ জুলিয়ান স্কুডার

নাসা ডটগভ

আমেরিকান সায়েন্টিস্ট

উইকিপিডিয়া

আরও পড়ুন