প্রায় সব জীব কেন অক্সিজেন নিয়ে বেঁচে থাকে

মানুষসহ জীবজন্তুর বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে বেশি যেটা দরকার, তা হলো অক্সিজেন। নিশ্বাসের সঙ্গে আমরা অক্সিজেন গ্রহণ করি। কিন্তু বাস্তবে এটি খুবই প্রতিক্রিয়াশীল একটি মৌল। কাঠ পুড়তে দেখলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। তবুও বেশিরভাগ জীব কেন বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেন গ্রহণ করে?

জীবদেহের মধ্যে যেসব রাসায়নিক প্রক্রিয়া চলে, সেগুলোকে বলে মেটাবোলিজম। ডেনমার্কের সাউদার্ন ডেনমার্ক ইউনিভার্সিটির জিওবায়োলজিস্ট ডোনাল্ড ক্যানফিল্ড বলছেন, ‘হাজার হাজার রকমের মেটাবোলিজম থাকতে পারে। তবে প্রায় সব ইউক্যারিওট (যাদের কোষে নিউক্লিয়াস থাকে) এবং অনেক প্রোক্যারিওট (যাদের কোষে নিউক্লিয়াস নেই) অক্সিজেন ব্যবহার করে।’

তিনি মূলত হেটেরোট্রোফ নামে জীবের কথা বলছেন। মানুষ হেটেরোট্রোফ জীব। এরা নিজেদের প্রয়োজনীয় শক্তি ও পুষ্টি অন্য জীব বা জৈব পদার্থ থেকে পায়।

ক্লোরিন ও অক্সিজেন কাছাকাছি শক্তি দিতে পারে। ফ্লোরিন বেশি শক্তি দিতে পারলেও এটি জৈব পদার্থের সংস্পর্শে আসা মাত্র বিস্ফোরণ ঘটায়। ফলে এটি জীবনের জন্য বিপজ্জনক এবং শ্বাস নেওয়া সম্ভব নয়।

জার্মানির ইউনিভার্সিটি অব মিউনিখের গবেষক ড্যান মিলস বলেন, ‘সব জীব শুধু এভাবে বাঁচে না। যেমন, গাছ কার্বন গ্রহণ করে বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইড থেকে। হেটেরোট্রোফ জীবরা সাধারণত খাবারের জৈব পদার্থ থেকে ইলেকট্রন ছেঁকে নেয়। এই ইলেকট্রনগুলো মাইটোকন্ড্রিয়ার ঝিল্লিতে এক এনজাইম থেকে আরেক এনজাইমে যায়। এতে ছোট্ট বিদ্যুৎ প্রবাহ তৈরি হয়, যা প্রোটনকে একপাশ থেকে অন্য পাশে ঠেলে দেয়। অক্সিজেন সাধারণত এই ইলেকট্রন পরিবহন শৃঙ্খলে চূড়ান্ত গন্তব্য হিসেবে কাজ করে। তখন ইলেকট্রন গ্রহণ করে ও দুটি প্রোটন মিলে তৈরি করে পানি।

আরও পড়ুন

যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের জৈব রসায়নবিদ অধ্যাপক নিক লেন বলেন, ‘এই প্রক্রিয়ায় ঝিল্লির একপাশে অনেক প্রোটন জমা হয়। পরে একটি ক্ষুদ্র জলবিদ্যুৎ বাঁধের মতো ঝিল্লির একটি প্রোটিন চ্যানেলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। টারবাইনের মতো ঘুরতে থাকা একটি প্রোটিন এই প্রোটন প্রবাহের মাধ্যমে শক্তি তৈরি করে। সেই শক্তি কোষ ব্যবহার করে অ্যাডেনোসিন ট্রাইফসফেট বা এটিপি আকারে। কোষটি তখন এই প্যাকেজ করা শক্তি ব্যবহার করতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের অধ্যাপক ডেভিড ক্যাটলিং ও তাঁর সহলেখকরা অ্যাস্ট্রোবায়োলজি পত্রিকায় প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে ব্যাখ্যা করেন, ‘ক্লোরিন ও ফ্লোরিন ছাড়া অক্সিজেন কমে যাওয়ার সময় প্রতি ইলেকট্রন হস্তান্তরে সবচেয়ে বেশি শক্তি তৈরি হয়।’

তাঁরা গবেষণাপত্রে লেখেন, ক্লোরিন ও অক্সিজেন কাছাকাছি শক্তি দিতে পারে। ফ্লোরিন বেশি শক্তি দিতে পারলেও এটি জৈব পদার্থের সংস্পর্শে আসা মাত্র বিস্ফোরণ ঘটায়। ফলে এটি জীবনের জন্য বিপজ্জনক এবং শ্বাস নেওয়া সম্ভব নয়।

অক্সিজেনের বিশেষ উপযোগিতা কোয়ান্টাম ফিজিকস দিয়ে বোঝানো যায়। অক্সিজেন একবারে একটি করে ইলেকট্রন গ্রহণ করে, ফলে এটি শক্তি ছাড়ে এবং ধাপে ধাপে প্রতিক্রিয়া সম্পন্ন করে। এভাবে এটি অনেক শক্তি ছাড়ে।

এছাড়া ক্লোরিন ও ফ্লোরিন জীবের জন্য বিষাক্ত হলেও, অক্সিজেন তুলনায় নিরাপদ। অক্সিজেন ব্যবহারে বাড়তি সুবিধা হলো, এটি থেকে শুধু পানি ও কার্বন ডাই-অক্সাইড তৈরি হয়, বিষাক্ত কিছু নয়। তবে টিস্যুতে বেশি অক্সিজেন জমলে ক্ষতি করতে পারে। যেমন ক্ষতি করতে পারে ডিএনএ ও প্রোটিনের মতো কোষীয় উপাদানের। এ কারণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।

ক্যানফিল্ড ও মিলস জানান, ‘আরেকটা বড় কারণ হলো অক্সিজেন খুব সহজলভ্য। যদিও এটি নানা পদার্থের সঙ্গে মিশে যেতে ভালোবাসে। তবুও গাছেরা ফটোসিন্থেসিসের (সালোকসংশ্লেষণ) মাধ্যমে প্রচুর অক্সিজেন তৈরি করে। এগুলো বায়ু ও পানিতে মিশে যায় এবং জীবনের জন্য সহজলভ্য হয়ে ওঠে। আর অক্সিজেন গ্যাস হওয়ায় ঝিল্লি পেরিয়ে শরীরে যায় সহজে।

আরও পড়ুন

এখন প্রশ্ন হলো, প্রাচুর্যের কথা বলতে গেলে নাইট্রোজেন কেন ব্যবহার করা হবে না। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ৭৮ শতাংশই নাইট্রোজেন। তবুও জীব কেন এই গ্যাসের সাহায্যে শ্বাস নেয় না?

এ প্রসঙ্গে ক্যানফিল্ড জানান, ‘নাইট্রোজেনের সমস্যা হলো, এর মধ্যে তিনটি শক্ত বন্ধন আছে। এই বন্ধন ভাঙা খুব কঠিন। নাইট্রোজেন জীবদেহের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের অংশ। কিন্তু এটিকে ভেঙে ব্যবহারযোগ্য করতে অনেক শক্তি লাগে। কিছু নির্দিষ্ট জীবই এটা করতে পারে।’

ক্লোরিন ও ফ্লোরিন জীবের জন্য বিষাক্ত হলেও, অক্সিজেন তুলনায় নিরাপদ। অক্সিজেন ব্যবহারে বাড়তি সুবিধা হলো, এটি থেকে শুধু পানি ও কার্বন ডাই-অক্সাইড তৈরি হয়, বিষাক্ত কিছু নয়। তবে টিস্যুতে বেশি অক্সিজেন জমলে ক্ষতি করতে পারে।

তাঁর মতে, ‘অক্সিজেনের বিশেষ উপযোগিতা কোয়ান্টাম ফিজিকস দিয়ে বোঝানো যায়। অক্সিজেন একবারে একটি করে ইলেকট্রন গ্রহণ করে, ফলে এটি শক্তি ছাড়ে এবং ধাপে ধাপে প্রতিক্রিয়া সম্পন্ন করে। এভাবে এটি অনেক শক্তি ছাড়ে। কিন্তু একসঙ্গে খুব বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে না। ফলে বাতাসে সহজে জমে থাকতে পারে।’

সবশেষে বলা যায়, অক্সিজেন মধ্যপন্থী। এটি ফ্লোরিন বা ক্লোরিনের মতো অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়াশীল নয়, আবার নাইট্রোজেনের মতো অতিরিক্ত শক্ত নয়। অন্যদিকে সালফেট বা নাইট্রেটের মতো কম শক্তিশালীও নয়। বরং এটি সহজলভ্য, তুলনামূলকভাবে নিরাপদ এবং গাছেরা উৎপাদন করে। ফলে মানুষসহ অন্যান্য জীবও অক্সিজেন ব্যবহার করে বেঁচে থাকতে পারে।

লেখক: সাংবাদিক

সূত্র: লাইভ সায়েন্স

আরও পড়ুন