প্রাণীরাও হিসাব কষতে পারে, বোঝে সাধারণ গণিত, জানা গেল গবেষণায়!

যদি বলি, বিড়াল গুনতে পারে, বিশ্বাস করবেন? শুধু তা-ই নয়, মৌমাছি থেকে শুরু করে বিভিন্ন পাখিও গুনতে পারে। সেসব প্রাণীর কথা…

যদি বলি, বিড়াল গুনতে পারে, বিশ্বাস করবেন?

আপনি কি বিড়াল পোষেন? বাসায় ফিরে যদি দেখেন, আপনার বিড়ালটা বসে বসে কিছু একটা গুণছে, ভড়কে যাবেন না? হ্যারি পটারের জাদুর জগতে এমন বিড়ালের দেখা মিলতে পারে, কিন্তু বাস্তবে কি সেটা আদৌ সম্ভব?

কোনো প্রাণী গুনতে পারে বা সাধারণ অঙ্ক কষতে পারে—শুনেই হয়তো ভাবতে পারেন, নিশ্চয়ই বাড়িয়ে বলছি। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, বানিয়ে বা বাড়িয়ে বলা হচ্ছে না একদমই। বিজ্ঞানীরা যাকে বলেন ‘সংখ্যাজ্ঞান’, সেটা প্রকৃতিতে সত্যিই অনেক প্রাণীর মধ্যে দেখা যায়। কিন্তু এরা কি সত্যিই গুনতে পারে? পারলে, কোন কোন প্রাণী গুনতে পারে বা সাধারণ গণিত বোঝে?

যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক মাইকেল বেরানের মতে, ‘পোকামাকড়, শামুক, টিকটিকি, বিড়াল, পাখি থেকে শুরু করে বহু স্থলচর ও জলচর স্তন্যপায়ী প্রাণী—অনেকেই সংখ্যার পার্থক্য ধরতে পারে।’ লাইভ সায়েন্সের লেখক ক্ল্যারিসা ব্রিনকেট এক নিবন্ধে লিখেছেন, এই ক্ষমতা এসব প্রাণীকে কালের আবর্তে টিকে থাকতে সাহায্য করেছে। যেমন এর মাধ্যমে তারা খাবারের উৎসের সন্ধান পায় এবং নিজেদের বংশ রক্ষা করতে পারে।

তাদের মস্তিষ্কে কিছু বিশেষ স্নায়ু কোষ বা ‘নাম্বার নিউরন’ থাকে, নির্দিষ্ট সংখ্যার প্রতি সাড়া দেয়। মজার বিষয় হলো, বিজ্ঞানীরা সদ্য ফোটা মুরগির ছানার মস্তিষ্কেও এই নিউরন খুঁজে পেয়েছেন। এ থেকে তাঁরা ধারণা করছেন, এই ক্ষমতা জন্মগত।

এর উদাহরণ প্রকৃতির বুকে অহরহ ছড়িয়ে আছে। গবেষণায় দেখা গেছে, মৌমাছিরা ফুলের মধুর সন্ধানে উড়ে যাওয়ার সময় পথের বিভিন্ন চিহ্ন গুনে রাখে। গোল্ডেন অর্ব উইভার মাকড়সা হিসাব রাখে, তার জালে কতগুলো শিকার আটকা পড়ল। এমনকি টুঙ্গারা ব্যাঙেরা (বৈজ্ঞানিক নাম: Physalaemus pustulosus) প্রজননের সময় পরস্পরের সঙ্গে সংখ্যা নিয়ে প্রতিযোগিতা করে। ইংরেজিতে এটিকে বলা হয় ‘নিউমেরিক্যাল ডুয়েল’! এ সময় পুরুষ ব্যাঙ ডাকের শেষে বিশেষ একধরনের অদ্ভুত শব্দ জুড়ে দেয়, যাকে ‘চাক’ বলা হয়। অন্য পুরুষ ব্যাঙটি তার জবাবে আরও একটি অতিরিক্ত ‘চাক’ শব্দ করে। যতক্ষণ শ্বাস থাকে, ততক্ষণ তাদের এই প্রতিযোগিতা চলতেই থাকে।

২০২৪ সালে গবেষকেরা আবিষ্কার করেছেন, কাক কোনো কিছু দেখে বা শব্দ শুনে সেই অনুযায়ী এক থেকে চার পর্যন্ত গুনে গুনে কা-কা রবে ডাকতে পারে
আরও পড়ুন

ওদিকে সিংহীরা (বৈজ্ঞানিক নাম: Panthera leo) যুদ্ধের আগে প্রতিপক্ষ দলের গর্জনের সংখ্যা গুনে শক্তি পরিমাপ করে। এরপরই তারা সিদ্ধান্ত নেয়, আক্রমণ করবে নাকি পিছু হটবে। সম্প্রতি, ২০২৪ সালে গবেষকেরা আবিষ্কার করেছেন, কাক কোনো কিছু দেখে বা শব্দ শুনে সেই অনুযায়ী এক থেকে চার পর্যন্ত গুনে গুনে কা-কা রবে ডাকতে পারে।

তবে অধ্যাপক বেরানের মতে, এই ক্ষমতা আসলে মানুষের গোনার মতো নয়। ইতালির ট্রেন্টো ইউনিভার্সিটির স্নায়ুবিজ্ঞানের অধ্যাপক জর্জিও ভালোর্টিগারা জানান, প্রাণীদের মধ্যে যা দেখা যায়, তা হলো ‘আনুমানিক সংখ্যা পদ্ধতি’। ইংরেজিতে বলা হয় ‘অ্যাপ্রোক্সিমেট নাম্বার সিস্টেম বা এএনএস (ANS)। এটি একধরনের সহজাত ক্ষমতা, যা তাদের সংখ্যার একটি আনুমানিক ধারণা দেয়। তাদের মস্তিষ্কে কিছু বিশেষ স্নায়ু কোষ বা ‘নাম্বার নিউরন’ থাকে, নির্দিষ্ট সংখ্যার প্রতি সাড়া দেয়। মজার বিষয় হলো, বিজ্ঞানীরা সদ্য ফোটা মুরগির ছানার মস্তিষ্কেও এই নিউরন খুঁজে পেয়েছেন। এ থেকে তাঁরা ধারণা করছেন, এই ক্ষমতা জন্মগত।

নামিবিয়ার হিম্বা উপজাতির মতো কিছু গোষ্ঠী এখনো পরিমাণ বোঝার জন্য আনুমানিক সংখ্যা পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল। কৃষিকাজ ও পশুপালনের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আরও নিখুঁত হিসাবের প্রয়োজন হয়, আর তা থেকেই সম্ভবত আজকের প্রচলিত পাটিগণিতের জন্ম।

এই ‘আনুমানিক সংখ্যা পদ্ধতি’ কিন্তু আঙুল গুনে হিসাব করার মতো নয়। এটি মূলত দ্রুত তুলনা করার একটি কৌশল। এর দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো—এক, দূরত্বের প্রভাব বা ডিসট্যান্স ইফেক্ট, আর দুই, আকারের প্রভাব বা সাইজ ইফেক্ট। সহজ করে বললে, যে দুটি সংখ্যার মধ্যে দূরত্ব বেশি, তাদের তুলনা করা বা পার্থক্য করা সহজ। যেমন ৮ আর ৬-এর মধ্যে পার্থক্য করার চেয়ে ৮ আর ২-এর মধ্যে পার্থক্য করা সহজ। এটাই দূরত্বের প্রভাব। আবার বড় দুটি সংখ্যার চেয়ে ছোট দুটি সংখ্যার তুলনা করা সহজ—পার্থক্যের মান সমান হলেও। যেমন ১১২ এবং ১১৪-এর পার্থক্য বোঝার চেয়ে ২ আর ৪-এর পার্থক্য বোঝা সহজ। এটাই সাইজ ইফেক্ট বা আকারের প্রভাব।

আরও পড়ুন

বোস্টন ইউনিভার্সিটির গবেষক আইরিন পেপারবার্গ। তোতা পাখি কথা তো শেখে, কিন্তু এর অর্থ কী বোঝে?—এ নিয়ে গবেষণার জন্য ‘অ্যালেক্স’ নামের একটি তোতাপাখিকে নিয়ে কাজ করেছেন তিনি দীর্ঘদিন। এই পাখিটি বেশ ‘সেলিব্রেটি’ও হয়ে উঠেছিল! যাহোক, আইরিন প্রাণীদের নিয়ে বলেন, ‘প্রাণীদের এই আনুমানিক ধারণা আর মানুষের নিখুঁতভাবে গোনার ক্ষমতা এক জিনিস নয়।’ তাঁর ভাষ্যমতে, মানুষ যখন “৪” সংখ্যাটি ব্যবহার করে, তখন সে বোঝে এখানে চারটি বস্তু আছে—সেটা হোক মার্বেল, চাবি বা অন্য কিছু। সত্যিকারের গোনার জন্য সংখ্যার প্রতীক চেনা, তার মান বোঝা এবং ক্রম মনে রাখা প্রয়োজন। মানব শিশুদেরই এই ধারণাগুলো আয়ত্ত করতে কয়েক বছর লেগে যায়।

পেপারবার্গের মতে, অ্যালেক্স নামের তোতাপাখিটি এবং শেবা ও আই নামের দুটি শিম্পাঞ্জি ছাড়া খুব কম প্রাণীই সত্যিকারের গোনার কাছাকাছি পৌঁছাতে পেরেছে। অ্যালেক্স এক থেকে আট পর্যন্ত আরবি সংখ্যা চিনতে, সাজাতে এবং এমনকি দুটি ভিন্ন ধরনের বস্তুর মোট হিসাব করতেও পারত।

তাহলে বিষয়টা কী দাঁড়াল? প্রাণীরা কি গণিত করতে পারে?

অধিকাংশ গবেষকের মতে, গোনার ক্ষমতা গণিতের ভিত্তি বটে, কিন্তু এটি ঠিক গণিত নয়। গণিতের প্রাথমিক স্তরেই যোগ, বিয়োগ, গুণ এবং ভাগের মতো জটিল প্রক্রিয়া জানতে হয়। তাই অনেক প্রাণী সংখ্যার পরিবর্তন বা পার্থক্য বুঝতে পারলেও তারা আসলে মানুষের মতো অঙ্ক কষতে পারে না।

শেবা নামের এই শিম্পাঞ্জিটি সত্যিকার গোনার কাছাকাছি পৌঁছেছে
ছবি: গেটি ইমেজ
বিজ্ঞানীরা কিছু চমকপ্রদ পরীক্ষার মাধ্যমে দেখিয়েছেন, কয়েকটি নির্বাচিত প্রজাতি সাধারণ যোগ-বিয়োগ করতে পারে। আফ্রিকান গ্রে প্যারট, পায়রা, কিছু প্রাইমেট বা স্তন্যপায়ী প্রাণী, মৌমাছি এবং স্টিংরে মাছকে নির্দিষ্ট প্রতীক বা রঙের মাধ্যমে যোগ বা বিয়োগ করতে শেখানো হয়েছে।

অধ্যাপক ভালোর্টিগারার ভাষ্যে, ‘স্কুলে শিশুরা যে ধরনের পাটিগণিত শেখে, তা মানুষের এতদিনের সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের ফলে হওয়া একটি আধুনিক উদ্ভাবন।’ নামিবিয়ার হিম্বা উপজাতির মতো কিছু গোষ্ঠী এখনো পরিমাণ বোঝার জন্য আনুমানিক সংখ্যা পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল। কৃষিকাজ ও পশুপালনের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আরও নিখুঁত হিসাবের প্রয়োজন হয়, আর তা থেকেই সম্ভবত আজকের প্রচলিত পাটিগণিতের জন্ম। এই পাটিগণিত প্রাণীরা পারে না।

আরও পড়ুন

তবে বিজ্ঞানীরা কিছু চমকপ্রদ পরীক্ষার মাধ্যমে দেখিয়েছেন, কয়েকটি নির্বাচিত প্রজাতি সাধারণ যোগ-বিয়োগ করতে পারে। আফ্রিকান গ্রে প্যারট, পায়রা, কিছু প্রাইমেট বা স্তন্যপায়ী প্রাণী, মৌমাছি এবং স্টিংরে মাছকে নির্দিষ্ট প্রতীক বা রঙের মাধ্যমে যোগ বা বিয়োগ করতে শেখানো হয়েছে। যেমন একটি নীল বিন্দু দেখানোর অর্থ হলো ‘এক যোগ করো’। এই নিয়ম শিখে তারা ছোট ছোট সংখ্যার গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে পেরেছে।

অধ্যাপক বেরানের মতে, ভবিষ্যতে আরও উন্নত পরীক্ষার মাধ্যমে হয়তো গুণ বা ভাগের মতো প্রক্রিয়াও তাদের শেখানো সম্ভব হতে পারে। কিন্তু যখনই ১২ + ২২-এর মতো বড় সংখ্যা বা বীজগণিতের জটিল সূত্রের প্রশ্ন আসে, তখন স্বীকার করতেই হয়, প্রাণীদের পক্ষে সেই ক্ষমতা অর্জন করা প্রায় অসম্ভব।

সংখ্যার জগৎ বিশাল ও রহস্যময়। প্রাণীদের এই সীমিত ক্ষমতা হয়তো সেই রহস্যেরই একটি অংশ, কে জানে!

শিক্ষার্থী: পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

সূত্র: লাইভ সায়েন্স, কিনশিপ, উইকিপিডিয়া

আরও পড়ুন