বর্ষাকাল এখনো আসেনি, তবু বৃষ্টি যেন ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সব। এই মেঘলা দিনে, বৃষ্টিতে আকাশে তাকিয়ে মনে পড়ে যায় কত কথা! কবিরা আরও একধাপ আগে বেড়ে কবিতা লিখে ফেলেন, কেউ হয়তো ভাবেন আবহাওয়ার নানা দিক নিয়ে। কিন্তু মেঘের ওপারেও যে অণুজীবদের বাড়ি আছে, সে কথা কি আপনি জানেন?
না, একটুও বাড়িয়ে বলছি না। সত্যিই মেঘের দেশে আছে জীবনের অস্তিত্ব!
অনেক বছর ধরে বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, কাব্য আর শিল্পের ক্যানভাস ছাড়িয়ে মেঘ কেবলই বাষ্পীভূত পানির সমাহার। বৃষ্টির উৎস। কিন্তু গত এক দশকে আমরা জেনেছি, আকাশের অনেক ওপরে, আমাদের চোখের আড়ালে এক অদৃশ্য জৈব বাস্তুতন্ত্র গড়ে উঠেছে। সেখানে বাস করে ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, এমনকি ভাইরাসও! ইংরেজিতে এটাকে বলা হয় মাইক্রোবায়োম ইন ক্লাউডস। অর্থাৎ মেঘের দেশের বাস্তুতন্ত্র। আরেকটু কাব্য করে যদি বলি ‘মেঘের ওপর অণুজীবদের বাড়ি’, আশা করি কেউ রাগ করবেন না।
এই বাড়ি বা বাস্তুতন্ত্রের খোঁজ শুরু হয় ২০০০ সালের পর থেকে। মেঘের ভেতরে কী আছে, বিজ্ঞানীরা তা গভীরভাবে খুঁজে দেখতে শুরু করেন। এ জন্য বিশেষ বিমানে চড়ে, কখনো ঝড়ের মধ্য দিয়ে উড়ে গিয়ে, কখনো পর্বতের ওপর থেকে সংগ্রহ করেন মেঘের কণা। জলীয় এসব কণায় পাওয়া যায় শত শত প্রজাতির অণুজীব। দেখা যায়, এর অনেকগুলো সক্রিয়ভাবে বেঁচে আছে।
তিনি আসলে বুঝিয়েছেন, এই অণুজীবেরা মেঘের ভেতরেই খায়, বংশবিস্তার করে, এবং খানিকটা ‘কারিকুরি’ও করে! হ্যাঁ, অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, এই অণুজীবেরা আবহাওয়াকে প্রভাবিত করতে পারে। ‘ক্লাউড ইঞ্জিনিয়ার’ পদটা বোধ হয় এদের জন্য যথার্থ, কী বলেন?
বিষয়টা উঠে এসেছে ফরাসি উদ্ভিদ রোগতত্ত্ববিদ ও অণুজীববিজ্ঞানী ড. সিন্ডি মরিসের ভাষ্যে। মেঘের ভেতরের এসব অণুজীব নিয়ে তিনি ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে গবেষণা করছেন। তিনি বলেন, ‘এতদিন আমরা ভাবতাম, মেঘ অনেক ঠান্ডা, অ্যাসিডিক (অম্লীয়), আর খুব বেশি সময় অক্ষুণ্ণ থাকে না, ঝরে যায়। তাই সেখানে জীবন সম্ভব নয়। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, অণুজীবেরা মেঘের ভেতরে শুধু বেঁচেই নেই, তারা সক্রিয়ও।’
সক্রিয় বলে আসলে কী বোঝালেন এই ফরাসি বিজ্ঞানী? তিনি আসলে বুঝিয়েছেন, এই অণুজীবেরা মেঘের ভেতরেই খায়, বংশবিস্তার করে, এবং খানিকটা ‘কারিকুরি’ও করে! হ্যাঁ, অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, এই অণুজীবেরা আবহাওয়াকে প্রভাবিত করতে পারে। ‘ক্লাউড ইঞ্জিনিয়ার’ পদটা বোধ হয় এদের জন্য যথার্থ, কী বলেন?
২
এই মেঘজীবেরা কীভাবে আবহাওয়া বদলে দেয়?
কিছু ব্যাকটেরিয়া, যেমন স্যুডোমোনাস সিরিঞ্জি (Pseudomonas syringae) এমন একধরনের প্রোটিন তৈরি করে, যা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি তাপমাত্রায় বরফ গঠনে সাহায্য করে। মানে এরা প্রাকৃতিক আইস-নিউক্লিয়েটর—জলীয় বাষ্পকণাকে বরফ বা বৃষ্টির ফোঁটায় পরিণত করতে পারে। ঠিক ধরেছেন, এই খুদে মেঘ-কৌশলীরা বৃষ্টিপাতে সাহায্য করে। গবেষকদের ধারণা, এটা নিছক কাকতাল নয়। টিকে থাকার জন্য শুধু মেঘের ওপারে বাড়িতে থাকলেই এদের হয় না, পৃথিবীতেও ফিরে আসতে হয়। আর এ জন্য প্রাকৃতিক লিফট হিসাবে এরা ব্যবহার করে বৃষ্টি বা তুষারকে। এভাবে পৃথিবীতে ফিরে আসার কৌশল হিসাবে এরা বৃষ্টিকে ব্যবহার করে।
শুধু তা-ই নয়, বিশ্বজুড়ে ঘুরে বেড়াতেও এই মেঘব্যবস্থার জুড়ি নেই। এ ক্ষেত্রে বৈশ্বিক পরিবহনব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে মেঘ। মরুভূমি, মহাসাগর বা বিভিন্ন বন ও শহর থেকে মেঘের জগতে উঠে পড়ে অনেক অণুজীব। পানি বাষ্প হয়ে আকাশে ওঠার সময়ই ওর সঙ্গে মেঘের দেশে পাড়ি জমায় এরা। তারপর বাতাসে ভর করে বিশ্বজুড়ে ঘুরে বেড়ায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সাহারার ধুলিঝড় প্রায়ই আফ্রিকার জীবাণুদের আটলান্টিক পেরিয়ে অ্যামাজনের জঙ্গলে পৌঁছে দেয়।
এই আবিষ্কার আমাদের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ওপর অণুজীবের প্রভাব বোঝার পদ্ধতি ও ধারণা বদলে দিচ্ছে। এতদিন বিজ্ঞানীরা অণুজীবের খোঁজে শুধু মাটি, পানি বা জীবদেহে চোখ রাখতেন। এখন তাঁরা আকাশেও চোখ রাখছেন। কারণ, এসব অণুজীব এক পরিবেশ থেকে ভিন্ন পরিবেশে চলে যাচ্ছে, সেখানে ভূমিকা রাখছে, কারিকুরি করছে। এর প্রভাব পড়ছে গাছের রোগ থেকে শুরু করে জলবায়ু পরিবর্তন পর্যন্ত। এ প্রসঙ্গে ড. মরিস বলেন, ‘আমরা যখন বাস্তুতন্ত্র বলি, তখন প্রায়ই আকাশকে বাদ দিয়ে দিই। এখন আর সেই উপায় নেই।’
৩
কিন্তু মেঘের দেশে বাস করা এত সহজ নয়। ঠান্ডা, তীব্র অতিবেগুনি রশ্মি, জলীয়বাষ্পের অনিয়মিত উপস্থিতি—সবকিছুই এ ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ হিসেবে হাজির হয়। তবু এই অণুজীবেরা ওই পরিবেশে টিকে থাকে দারুণভাবে।
গবেষকদের ধারণা, মেঘের রসায়ন—পানি, বিভিন্ন জৈব যৌগ, ও অ্যাসিডের মিশ্রণ—এই অণুজীবদের বিবর্তন ও কাজের ধরনে প্রভাব ফেলে। অনেক বিজ্ঞানীর ধারণা, এর কোনো কোনোটি মেঘের ভেতরের কিছু কার্বন যৌগ ভেঙে ফেলতে পারে। যেমন স্যুডোমোনাস সিরিঞ্জি কার্বন যৌগ ভেঙে ফেলতে পারে। এভাবে এগুলো বৃষ্টিপাতের পাশাপাশি দূষণ কমাতেও ভূমিকা রাখে বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা।
