সাক্ষাৎকার

‘বিরল গোলাপি হাতির দল রক্ষায় আমাদের অক্ষমতা যেন জয়ী না হয়’— এম এ আজিজ

এম এ আজিজ ২৫ বছর যাবৎ বাংলাদেশের বন্য প্রাণীর গবেষণা ও সংরক্ষণে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ থেকে ২০০০ সালে স্নাতক এবং ২০০২ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। স্নাতকোত্তর পর্যায়ে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের হাতির সংখ্যা এবং হাতি ও মানুষের সংঘাত নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। পরে তিনি শেরপুর, জুড়ি, চুনতি ও টেকনাফ বনাঞ্চলের হাতির ওপর নানা গবেষণায় নেতৃত্ব দেন। এম এ আজিজ আইইউসিএনের এশিয়ান হাতি বিশেষজ্ঞ দলের একজন সক্রিয় সদস্য। 

২০১৭ সালে যুক্তরাজ্য সরকারের কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে ইউনিভার্সিটি অব কেন্ট থেকে তিনি সুন্দরবনের বাঘের জিনতত্ত্ব ও পপুলেশনের ওপর পিএইচডি করেন। তাঁর গবেষণার গুরুত্ব বিবেচনায় ২০১৮ সালে ইউনিভার্সিটি অব কেন্ট তাঁকে ডারেল ট্রাস্ট ফর কনজারভেশন বায়োলজি পুরস্কার দেয়। দেশের বন্য প্রাণী গবেষণা ও সংরক্ষণে অবদান রাখায় ২০২৩ সালে বাংলাদেশ সরকারের বঙ্গবন্ধু অ্যাওয়ার্ড ফর ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন পদকে ভূষিত হন তিনি। এশিয়ান হাতি, মেছো বিড়াল, বাদুড়, নদীর শুশুক, সুন্দরবনের বাঘ, কুমির ও হরিণ নিয়ে নানা গবেষণায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন এম এ আজিজ। বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন তিনি।

সম্প্রতি রাঙামাটির বনে গোলাপি হাতির দেখা পেয়েছেন এমএ আজিজ। বিরল এ ঘটনাটিসহ বাংলাদেশে বন্যহাতির জীবনচিত্র নিয়ে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন লেখক ও সাংবাদিক কাজী আলিম-উজ-জামান

বিজ্ঞানচিন্তা:

সম্প্রতি রাঙামাটির বনে গোলাপি হাতি দেখা গেছে। আপনি কীভাবে খবরটি পেয়েছেন?

এম এ আজিজ: গত ১৩ জুন রাতে ফেসবুকে রাঙামাটির কাপ্তাই লেকে হাতির একটি দলের সাঁতরানোর ছবি নজরে আসে। পরে পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের সাবেক বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী ফেসবুকের হাতির ভিডিওটি আমার হোয়াটসঅ্যাপে শেয়ার করেন। ভিডিওটি বেশি ভালো মানের না হলেও হাতির দলের সঙ্গে ছোট্ট শাবকের গায়ের রং কিছুটা আলাদা মনে হয়েছে। বেশ কয়েকবার ভিডিওটি দেখে নিশ্চিত হলাম, শাবকটি অন্যদের থেকে আলাদা। ফলে রাঙামাটি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু ঈদের ছুটির পর ১৫ তারিখ প্রথম অফিস হওয়ায় দোদুল্যমানতা কাজ করে। তবে বিষয়টি মাথায় ঘুরতে থাকে। ১৫ তারিখ অফিস শেষে বাসায় ফিরে হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিই, আজ রাতেই রাঙামাটি যাব। ইতিমধ্যে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বাজে। আমার ল্যাবে গবেষণা সহযোগী হিসেবে কাজ করেন আমীর হামজা। সেও সানন্দে রাজি হলেন।

কোনো রকমে ক্যামেরা-ব্যাগ গুছিয়ে রওনা হলাম। পথে থাকতেই সংশ্লিষ্ট বন অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি, কীভাবে ওই হাতির এলাকায় সহজে যাওয়া যায়। তাঁরা আন্তরিকতার সঙ্গে সহযোগিতা করলেন। রাতেই ঠিক করে রাখা হলো রাঙামাটি থেকে গন্তব্যে যাওয়ার স্পিডবোট ও স্থানীয় গাইড। সঙ্গে বন বিভাগের একজন কর্মকর্তাও থাকবেন আমাদের সঙ্গে। সাড়ে দশটার বাসে উঠে বসলাম ঢাকার কলাবাগান থেকে। রাঙামাটি শহরের বনরূপায় ভোর ছয়টায় আমাদের বাস পৌঁছাল। সেখান থেকে আমরা ছুটলাম শুভলং বন অফিসের দিকে। প্রায় ৪০ মিনিট লাগল। বন অফিসের ফরেস্টার শরিফুল আমাদের দেখে কিছুটা অবাক হলেন। কীভাবে এত সকালে আমরা এই দুর্গম এলাকায় পৌঁছে গেলাম! কিছু পানির বোতল ও হালকা খাবার কিনে স্পিডবোটে আবার ছুটলাম আমাদের গন্তব্যের দিকে। প্রায় ৩০ মিনিটে পোঁছে গেলাম দুর্গম পাহাড়ি টিলা সমেত নানা ফলের বাগান সমৃদ্ধ এলাকায়। টিলাগুলোর মধ্যে দু-একটি বাড়িঘরও আছে। চারপাশে পানি আর পানি।

আমরা গিয়ে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের এক মেম্বারের বাড়িতে উঠলাম। সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন কয়েকজন গাইড। তাঁরা এলিফ্যান্ট রেন্সপন্স টিমের সদস্য। পরিচয় পর্ব শেষ করে আমাদেরকে নিয়ে চললেন বনের দিকে। প্রায় আধা ঘণ্টা পর পেয়েও গেলাম হাতির দল। কিন্তু গাছপালার জন্য দু একটি হাতির শুধু শুড় কিংবা পা দেখা যাচ্ছে। আমরা যে হাতি শাবক দেখতে এসেছি, তার দেখা পাচ্ছি না। ঘণ্টাখানেক এভাবেই চলল। কোনো উপায় না পেয়ে আমরা পাশের আরেকটি পাহাড়ের গায়ে এসে বসলাম। আমি আর আমীর সেখানে বসে অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে অন্যদেরকে পাঠিয়ে দিলাম দূরে, যাতে হাতি বিরক্ত না হয়। আমার ধারণা ছিল হাতি একসময় বেরিয়ে আসবে, আর তখনই আমরা ছবি তুলব। কিন্তু ততক্ষণে দুপুর হতে চলেছে। বাড়ছে রোদের তীব্রতা। ফলে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ছে। হাতি এই রোদের মধ্যে বনের ছায়া থেকে তো মোটেই বের হবে না। এভাবেই প্রায় ঘণ্টা দুয়েক বসে থাকলাম। আমাদের মধ্যে অস্থিরতা বাড়ছে। রাতের বাসে আবার ঢাকা ফিরতে হবে। পরের দিন ক্লাস-পরীক্ষা আছে।

আরও পড়ুন
বিজ্ঞানচিন্তা:

একজন গবেষক হিসেবে এই ঘটনার সঙ্গে আপনার ব্যক্তিগত আবেগ কতটুকু যুক্ত?

এম এ আজিজ: এই হাতির সঙ্গে আমার দুটো বিশেষ আবেগ বা স্মৃতি জড়িত। প্রথমত, হাতি নিয়ে আমি একটি বইয়ের পাণ্ডুলিপি প্রায় শেষ করেছি। বইয়ে সংযোজনের জন্য এশিয়ান সাদা হাতি নিয়ে যখন আমি নানা তথ্য-উপাত্ত পড়ছিলাম, ঠিক তখনই বাংলাদেশে এই সাদা হাতির শাবকসহ খবরটি নজরে আসে। বিষয়টি বেশ কাকতালীয় মনে হলো আমার কাছে। কারণ, সাদা হাতি নিয়ে প্রধানত থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের তথ্য পাচ্ছিলাম। আর বাংলাদেশে তো সাদা হাতির কোনো অস্তিত্বই নেই। ফলে বেশ শিহরিত হলাম। কারণ, বইয়ে হাতির ছবির জন্য বেশ কিছুদিন ধরে শেরপুরের হাতি পর্যবেক্ষণে যাওয়ার পরিকল্পনা করেও হয়ে উঠছিল না। ফলে এটি একটি চমৎকার সুযোগ হিসেবেও এল আমার কাছে।

দ্বিতীয়ত, রাঙ্গামাটির যে হাতির দলে গোলাপি হস্তীশাবক দেখা গেছে, এই হাতির দলের সঙ্গে আমার দীর্ঘ দিনের একটি গবেষণার সম্পর্ক আছে। আমি যখন এমএসসি পর্যায়ে ২০০১-২০০২ সালের দিকে গবেষণা কাজে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় চষে বেড়িয়েছি, সেই সময় এই হাতির দলটি রাঙ্গামাটির রাঙ্গিপাড়া বনাঞ্চলে প্রথম দেখি। পরে ২০১১ সালে এই হাতির দলটি নিয়ে আবারও কিছু গবেষণা কাজ করি। ওই সময় হাতির দলটি রাঙ্গিপাড়া থেকে বেশ দক্ষিণে ভাসাইন্নাদাম গ্রামে ফসল ও ঘর-বাড়ির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে। মানুষ ও হাতির সংঘাতে ওই গ্রামের একজন প্রবীণ ব্যক্তি নিহত হন। ঘটনার পরদিন আমি ওই গ্রামে উপস্থিত হই। গ্রামে হাতি এলে ফসল ও সম্পদ রক্ষায় ওই মৃত ব্যক্তি সব সময় নেতৃত্ব দিতেন। হাতি যে রাতে তাঁকে আক্রমণ করে, সেদিন শুধু তাঁর বাড়ি তছনছ করে এবং তাকে পায়ে পিষে মেরে চলে যায়। গ্রামবাসীর ধারণা, হাতির দল তাকে টার্গেট করে হত্যা করেছে। কারণ, হাতি তাকে শত্রু মনে করেছে! ২০২৫ সালে এসে এই হাতির দলে একটি বিরল গোলাপি হাতি শাবক দেখে আজ থেকে ২৫ বছর আগের স্মৃতি মনে পড়ছে। ওই সময় এই হাতির দলের তাড়া খেয়ে পড়িমরি করে রেহাই পেয়েছিলাম। ফলে এই হাতির দলের সঙ্গে আমার জানাশুনা দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে।

বিজ্ঞানচিন্তা:

এটি কি আসলেই গোলাপি হাতি, নাকি আলো, ধুলো বা অন্য কোনো কারণে ত্বকের রং এমন দেখা গেছে? গোলাপি বা সাদা হাতি কি কোনো বিশেষ প্রজাতি, নাকি এটি সাধারণ এশীয় হাতির মাঝে বিরল রংজনিত ভিন্নতা?

এম এ আজিজ: হাতির শাবকটি যদি ভালো করে খেয়াল করেন, তাহলে দেখা যাবে গোলাপি শাবকটির প্রায় সমবয়সী আরও একটি শাবক আছে। এই শাবকটির দেহের রং কিন্তু কালো। সেই সঙ্গে গোলাপি শাবকটির মায়ের দেহের রংও কালো। গোলাপি শাবকটির দেহের রং কালো, ধুলোর কারণে হলে অন্য শাবক কিংবা মায়ের দেহের রংও তেমন হওয়ার কথা। তাছাড়া গোলাপি হাতির দেহের লোমও কিন্তু অন্যদের মতো কালো নয়। চোখের রংও ব্যতিক্রম। হস্তীশাবকের দেহের লোম সাধারণত কালো হয়। ফলে শাবকের দেহের রং মা-খালাদের দেহের রঙের চেয়েও আরও বেশি কালো দেখায়। অর্থাৎ, এই শাবকটি বিশেষ এই গোলাপি রং জন্মগতভাবে পেয়েছে।

দেহের এমন রং দেখে অনেকের কাছে এটি ভিন্ন প্রজাতি বলে মনে হতে পারে। আসলে এই গোলাপি হাতি বিশেষ কোনো প্রজাতির হাতি নয়, এটি এশিয়ান হাতির মধ্যে রংজনিত ভিন্নতা মাত্র। হাতির এমন রং অত্যন্ত বিরল ঘটনা। প্রায় ১০ হাজার শাবকের মধ্যে একটি এমন রঙের ভিন্নতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করতে পারে। এ থেকে বোঝা যায়, হাতির এই গোলাপি রং কতটা বিরল।

প্রাণীর দেহের রং নির্ধারিত হয় মেলানিন নামে একটি বিশেষ ধরনের রঞ্জক দিয়ে। বিশেষ করে এই মেলানিনের মাধ্যমে প্রাণীর ত্বক, লোম ও চোখের রং নির্ধারিত হয়। আবার মেলানিন তৈরি নিয়ন্ত্রিত হয় জিনগত প্রচ্ছন্ন (Recessive trait) ফ্যাক্টরের সাহায্যে। পিতা ও মাতা উভয়ের থেকে বাচ্চার দেহে যখন মেলানিন তৈরির প্রচ্ছন্ন জিন বা ফ্যাক্টর স্থানান্তরিত হয়, তখন বাচ্চার দেহে মেলানিন তৈরি হতে পারে না। আবার অনেক সময় মেলানিন তৈরির জিনে মিউটেশন ঘটলেও এমনটি হতে পারে। ফলে বাচ্চার ত্বক, লোম ও চোখের রং সাদা, গোলাপি বা বাদামি হতে পারে। প্রাণিদেহের এসব অংশে স্বাভাবিক রং দেখা না গেলে এমন প্রাণীকে বিজ্ঞানীরা অ্যালবিনো হিসেবে অভিহিত করেন।

আরও পড়ুন
বিজ্ঞানচিন্তা:

এই হাতির গায়ের রং কি তার স্বাস্থ্য বা পরিবেশগত কোনো সমস্যার ইঙ্গিত দিতে পারে?

এম এ আজিজ: প্রাণীতে এমন রং দেখা দেয় মূলত জিনগত কারণে। মেলানিন তৈরির জন্য দায়ী জিনের মিউটেশন ঘটলে পরের প্রজন্মের মধ্যে তা প্রবাহিত হতে পারে। আবার কোনো কারণে মেলানিন তৈরির জিন ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বন্ধ হয়ে যেতে পারে মেলানিন সৃষ্টি। তখনো এমন রঙের প্রাণীর দেখা মেলে।

আবার প্রাণীর কোনো পপুলেশনে যখন সদস্য সংখ্যা খুব কমে যায়, অথবা আবাসস্থলের ধ্বংস বা সংকোচন ঘটলে প্রাণীর বড় দল খণ্ডবিখণ্ড হয়ে পড়ে। তখন কাছাকাছি সম্পর্কের সদস্যদের মধ্যে প্রজনন ঘটে। এতেও প্রাণীর মধ্যে এই ধরনের শাবকের জন্ম হওয়া সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

অ্যালবিনো প্রাণীরা বুনো পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে সহজে খাপ খাওয়াতে পারে না। দলের সদস্যদের মধ্যে সেও নিজেকে আলাদা ভাবতে থাকে। মানুষের মতো তারাও সহজে অন্যদের সঙ্গে মেলামেশা করতে পারে না। তাছাড়া দূর থেকে সহজে তারা মানুষ কিংবা প্রাকৃতিক শিকারের দৃষ্টিগোচর হয়। ফলে নানা বিপদ আসে। শিকারীরাও এই ব্যতিক্রমী প্রাণীকে সহজে নিশানা করতে পারে।

যেহেতু মেলানিন চোখ ও ত্বকের সুরক্ষা দেয়, তাই অ্যালবিনো প্রাণীরা সূর্যের ক্ষতিকর ইউভি রশ্মি থেকে নিজেদেরকে নিরাপদ রাখতে পারে না। এসব প্রাণীরা সহজে সানবার্নের (রোদে-পোড়া) শিকার হয়। এতে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে। এ ছাড়া চোখে দেখতেও সমস্যা হয়।

বিজ্ঞানচিন্তা:

এই হাতিটি কি বর্তমানে ঝুঁকিতে আছে বলে মনে করছেন? কী ধরনের হুমকি এর জন্য সবচেয়ে বড়?

এম এ আজিজ: পুরো হাতির দলটিই ঝুঁকির মধ্যে আছে। বর্ষাকাল চলছে। ফলে কাপ্তাই লেকে পানি বাড়ছে। এতে হাতির বিচরণ এলাকা মারাত্মভাবে সংকুচিত হয়ে পড়েছে। পুরো এলাকায় নানা ধরনের ফলের বাগান গড়ে উঠেছে। বেশিরভাগই ব্যক্তিমালিকানা জমি। কোনো বুনো পরিবেশ নেই। সরকারের কিছু বনভূমি ছড়িয়ে আছে বরকল উপজেলায়। ফলে হাতির খাদ্য সংকট যেমন রয়েছে, তেমনি মানুষের সঙ্গে সংঘাত লেগেই আছে।

দ্বিতীয়ত, এই হাতির শাবক দেখতে নানা শ্রেণির মানুষ ভিড় করতে পারে। এ ছাড়া স্থানীয় মানুষও উৎসাহী হয়ে উঠবে। ফলে হাতির দল বিরক্ত হবে। এমনকি মারমুখী হয়ে উঠতে পারে। এতে মানুষের সঙ্গে সংঘাত সৃষ্টি হবে, সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে।

আরও পড়ুন
বিজ্ঞানচিন্তা:

এই প্রজাতিকে সুরক্ষার জন্য কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত? স্থানীয় বন বিভাগ বা প্রশাসনের কাছে আপনি কী ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ প্রত্যাশা করেন?

এম এ আজিজ: বরকল এলাকাটি বেশ দুর্গম। ফলে বন বিভাগ এই হাতির নিয়মিত মনিটরিং করতে হিমশিম খায়। ওই এলাকায় বন বিভাগ তিনটি এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম তৈরি করেছে। তাদের সক্রিয় রাখা খুব জরুরি। আর এই কাজে বন বিভাগের পক্ষ থেকে প্রণোদনা দেওয়ার তেমন কোনো বরাদ্দ নেই। তেমন কোনো ভালো যাতায়াতে ব্যবস্থা নেই বন বিভাগের নিজেদেরও। তাদের অর্থ সংকট আছে বলেও জেনেছি।

এলাকাটি মূলত ব্যক্তিমালিকানাধীন হওয়ায় হাতি নিয়মিত ফসল ও পরিসম্পদের ক্ষতি করছে। তাদের ক্ষতিপূরণ বন বিভাগ নিয়মিতভাবে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে দুর্গম এলাকা হওয়ায় স্থানীয় মানুষেরা সঠিক সময়ে ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র উপস্থাপন করতে পারে না। ক্ষতিপূরণের আবেদন প্রক্রিয়া সহজ করা যায় কিনা, ভেবে দেখতে হবে।

হাতির দলকে নিয়মিত মনিটরিংয়ে রাখতে হবে। খাবারের সংকট মেটাতে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নিতে হবে। স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের যোগাযোগ বাড়াতে নিয়মিত মিটিং ও আলোচনা অব্যাহত রাখা জরুরি।

বিজ্ঞানচিন্তা:

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই হাতিকে নিয়ে মানুষের আগ্রহ চোখে পড়ছে। এই আগ্রহ কি বন্যপ্রাণী সুরক্ষার পক্ষে ইতিবাচক কোনো ভূমিকা রাখতে পারে?

এমএ আজিজ: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুব দ্রুত সমাজের নানা প্রান্তের সব খবর পৌঁছে যায়। এই হাতির ক্ষেত্রেও তাই হবে। ফলে এমন হাতি নিয়ে মানুষের জানার কৌতূহল সৃষ্টি হওয়াই স্বাভাবিক। এতে হাতির ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণের জন্য কর্তৃপক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া আসবে হবে বলে বিশ্বাস করি। সরকারের ওপর তরফ থেকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা ও সমর্থন প্রয়োজন হবে। কারণ, রাঙামাটির মতো দুর্গম এলাকায় চলাচল ও সংরক্ষণ কার্যক্রম বাস্তবায়নে নানা বাধা পেরিয়ে তবেই প্রান্তিক পর্যায়ের বনকর্মীরা কাজ করতে পারেন। প্রয়োজনীয় যানবাহন ও জনবলের অভাব মেটাতে হবে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একটি নেতিবাচক দিকও আছে। নানা মাধ্যমে প্রচারের ফলে ওই অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের দর্শনার্থী, আলোকচিত্রি ও মিডিয়া কর্মীরা ভিড় করতে পারেন। তাতে হাতির দল বিরক্ত ও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে। এমন ঘটনা নিয়মিত ঘটলে তাদের দৈনন্দিন খাবার গ্রহণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে। এতে হাতির দৈহিক ও মানসিক ভারসাম্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

আরও পড়ুন
বিজ্ঞানচিন্তা:

এই ঘটনাকে ঘিরে নতুন কোনো গবেষণার পরিকল্পনা আছে কি? বাংলাদেশের বন্য হাতিদের বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা আপনি কীভাবে দেখছেন?

এমএ আজিজ: আমাদের দেশে বন্য প্রাণী নিয়ে গবেষণার অপার সম্ভাবনা আছে। তবে পরিতাপের বিষয়, এ দেশে বন্যপ্রাণী নিয়ে গবেষণার প্রয়োজনীয় অর্থের কোনো জোগান নেই বললেই চলে। যেমন, আমার বড় কয়েকটি গবেষণা বিশেষ করে বাঘের জিনগত গবেষণা ও বাঘের শিকার প্রাণীর জরিপ, নদীর শুশুকের পপুশেলন এবং মেছো বিড়ালের ওপর পরিচালিত গবেষণার সব অর্থই দেশের বাইরের বিভিন্ন দাতা সংস্থার কাছে প্রতিযোগিতা করে পেয়েছি। এসব গবেষণার জন্য দেশে আর্থিক সুবিধা পাওয়া প্রায় দুঃসাধ্য। তাছাড়া ঘাট-পাট চুকিয়ে তবেই মিলতে পারে গবেষণার অর্থ।

দেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক গবেষক থাকলেও ভালো মানের গবেষকের ঘাটতি আছে। সরকারি বা কোনো দাতা সংস্থা থেকে আর্থিক সহযোগিতা পেলে এই হাতি মনিটরিং ও স্থানীয় মানুষের সমর্থন আদায়ে কাজ করার সুযোগ আছে। বিশেষ করে গোলাপি হাতির বেড়ে ওঠায় কী ধরনের পরিবর্তন কিংবা বাধাবিপত্তির মধ্যে পড়ছে, তা নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রাখা জরুরি।

কোভিডের পর থেকে বাংলাদেশের হাতি এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। একদিকে নিয়মিত বিরতিতে হাতি মারা পড়ছে, অন্যদিকে হাতির আক্রমণে প্রান্তিক কৃষকেরা মারা যাচ্ছেন। হাতির জন্য টিকে আছে অতীত বনের কঙ্কাল। ভেতরে গাছ নেই, খাবার নেই, পানি নেই। মানুষের থাবায় হাতির আবাস যেমন সংকুচিত হয়েছে, তেমনি ক্ষয় হয়েছে অতিমাত্রায়। ফলে হাতিরা মানুষের ফসলের ক্ষেতে হানা দিচ্ছে, বাড়ি এসে নিয়ে যাচ্ছে গোলায় রাখা ধান-চাল।

চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের হাতির আবাস ক্ষত-বিক্ষত। নানা প্রতিষ্ঠান, হাট-বাজার, রাস্তাঘাট, মহাসড়ক, রেল লাইন স্থাপন, রোহিঙ্গা বসতি স্থাপন ইত্যাদি নানা কারণে হাতিরা আজ দিশেহারা। শেরপুরে ভারতের সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করে সেখানকার হাতির চলাচলের রাস্তা চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে বাংলাদেশ অংশে আটকা পড়েছে একশটিরও বেশি হাতির দুটি দল। অথচ বাংলাদেশের পাশে নেই তেমন কোনো বনাঞ্চল, বনভূমি। ফলে প্রতিনিয়ত চলছে হাতি ও মানুষের মধ্যে সংঘাত।

হাতি ও হাতির বাড়িঘরের এই যখন অবস্থা, তখন আমি একজন আশাবাদী মানুষ হয়েও প্রায়ই নিরাশ হয়ে পড়ি। স্থলভাগের এই বৃহত্তম প্রাণীটি কি আদৌ বাংলাদেশে টিকে থাকবে? আমাদের অক্ষমতাই কি জয়ী হবে? বিরল গোলাপি হাতির দল রক্ষায় আমাদের অক্ষমতা যেন জয়ী না হয়।

আরও পড়ুন