মহাকাশ কেন যেতে হবে? আর এখনই কেন?
সুনিতা উইলিয়ামস: মানুষ জন্মগতভাবেই কৌতূহলী। সব সময় নতুন কিছু খুঁজে বের করতে চায়। আমাদের সবার মধ্যে কৌতুহল আছে। হয়তো সমাজের চাপে আর চারপাশের নানা কারণে সেটা কিছুটা চাপা পড়ে যায়। কিন্তু আমরা সবাই কৌতূহলী এবং নতুন কিছু জানতে চাই। মহাকাশ এমন একটা জিনিস, যা মানুষকে আশার আলো দেখায়। নিজেদের চেয়ে বড় কিছু ভাবতে ও বুঝতে শেখায়।
মহাকাশে আমাদের জানার কী আছে?
সুনিতা উইলিয়ামস: আমি মনে করি, আমরা জানতে চাই মহাবিশ্বে আমাদের স্থান কোথায়। পৃথিবীতে থাকতে আমরা শুধু নিজেদের কাজ আর ছোটখাটো জিনিস নিয়েই ব্যস্ত থাকি। কিন্তু মহাকাশে গেলে বোঝা যায়, পৃথিবীটা একটা ছোট্ট দ্বীপের মতো। মহাকাশে আমাদের ভাবনা গভীর হয়, মনে অনেক দার্শনিক প্রশ্ন জাগে—আমাদের উদ্দেশ্য কী? এই পৃথিবীতে আমাদের ভবিষ্যৎ কী?
মঙ্গল গ্রহ কি সেই উত্তর দিতে পারবে?
সুনিতা উইলিয়ামস: যদি আমরা মঙ্গলে যেতে পারি, তাহলে হয়তো জানতে পারব ভবিষ্যতে আমাদের পৃথিবীর কী হবে। পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখতে কী করা দরকার, সে বিষয়ে হয়তো নতুন ধারণা পেতে পারি। মঙ্গল পর্যন্ত যাওয়াই আমাদের লক্ষ্য।
আর সেই শুরুটা হবে চাঁদে ফিরে যাওয়ার মাধ্যমে?
সুনিতা উইলিয়ামস: আমি জানি না, আমরা কীভাবে মঙ্গলে যাব। কেউই হয়তো এখনো পুরোপুরি জানে না। কিন্তু চাঁদে স্থায়ীভাবে পৌঁছানোর চেষ্টা করতে করতে আমরা অনেক কিছু শিখব। ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রযুক্তি, এমনকি মানুষ হিসেবে আমরা কীভাবে সমস্যা মোকাবেলা করি, ভবিষ্যতে অন্যান্য দেশ ও সংস্কৃতির সঙ্গে মহাকাশে যাওয়ার সময় আমরা কীভাবে সমস্যার মুখোমুখি হই, তাও শিখব।
তাহলে সেটা দেখতে কেমন হবে?
সুনিতা উইলিয়ামস: চাঁদ থেকে মঙ্গল যাওয়াই আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। আমরা স্থায়ীভাবে চাঁদে ফিরে যেতে চাই। মানে সেখানে আমাদের একটা অবতরণকারী যান থাকতে হবে। সম্ভবত আমাদের একটা মহাকাশ স্টেশনও দরকার হবে। আমরা গেটওয়ে তৈরি করছি। সেটা চাঁদ এবং চাঁদ থেকে দূরে যাওয়ার একটা ঘাঁটি হবে। সেখানে আমরা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করব। ল্যান্ডার আর মহাকাশযানের কথা ভাবলে একটু সায়েন্স ফিকশনের মতো মনে হয়। পাগলামিও মনে হতে পারে। কিন্তু আমি যখন নাসায় যোগ দিই, তখন আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনও একটা পাগলাটে ধারণা ছিল। আমরা সেটা করে দেখিয়েছি। তাই মানুষ যা ভাবতে পারে, তা করতেও পারে।
কবে আমরা চাঁদে এবং তারপর মঙ্গলে ঘাঁটি গড়তে পারব?
সুনিতা উইলিয়ামস: এটা সময়সাপেক্ষ, খুব তাড়াতাড়ি হবে না। সম্ভবত এই দশকেই মধ্যেই মানুষ আবার চাঁদে যাবে। যত দ্রুত সম্ভব চাঁদে স্থায়ী ঘাঁটি গড়তে হবে। সেখানে মানুষ যাওয়ার পর বুঝতে পারব, কাজটা কতটা কঠিন। মনে রাখবেন, আমরা অ্যাপোলো প্রোগ্রামের মতো একই জায়গায় যাচ্ছি না। আমরা যাচ্ছি দক্ষিণ মেরুতে। তাই কক্ষপথটা আলাদা। পরিবেশও। এটা একটু বেশি কঠিন।
বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যে চাঁদের মতো পরিবেশে নভোযানের যন্ত্রপাতি ফেলে রেখে পরীক্ষা করছেন, সেগুলোতে কেমন পরিবর্তন হচ্ছে। এতে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারবেন, চাঁদের মাটিতে তাঁদের কী করতে হবে। এসব ছোট ছোট কাজের মাধ্যমেই ভবিষ্যতের মঙ্গল যাত্রার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
চাঁদে যাওয়া কি নিয়মিত ব্যাপার হবে?
সুনিতা উইলিয়ামস: আমরা চাই, চাঁদে যাওয়া নিয়মিত ব্যাপার হয়ে উঠুক। চাঁদ হবে মহড়ার মঞ্চ। সেখানে মহাকাশ স্টেশন থাকবে, মানুষ থাকবে, তাঁরা গবেষণা করবে। এরপর আমরা মঙ্গলগ্রহে যাত্রার প্রস্তুতি নেব। আমরা এখন পৃথিবীর কাছাকাছি কক্ষপথে যেতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আমরা জানি, কীভাবে এটা করতে হয়। রকেট বিপজ্জনক, কিন্তু আমরা জানি এটা কীভাবে করতে হয়।
বেসরকারি মহাকাশ সংস্থাগুলোর ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
সুনিতা উইলিয়ামস: প্রথমে রাশিয়া পর্যটকদের নিয়ে মহাকাশে যাওয়া শুরু করেছিল। পরে নাসাও বাণিজ্যিকভাবে মহাকাশে মালামাল পাঠানো শুরু করে। সেটার সঙ্গে আমরা ভালোভাবেই মানিয়ে নিয়েছি। এরপর তো আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে নভোচারী পাঠাতেও বেসরকারি কোম্পানিগুলো সাহায্য করছে। এসব শুরু হয়েছিল ২০০০ সালের দিকে। তবে গত দশকে এটা সত্যিই অনেক বেড়েছে।
সাধারণ মানুষের জন্য কি এর কোনো উপকারিতা আছে?
সুনিতা উইলিয়ামস: বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের মতো করে কাজ করতে পারছে। এতে খরচ কমছে এবং তারা নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করছে। তাই উৎপাদন প্রক্রিয়া, বড় আকারে ধাতুর থ্রিডি প্রিন্টিং, ফ্রিকশন স্টিয়ার ওয়েল্ডিং এবং এই ধরনের অন্যান্য প্রক্রিয়াতে অনেক উন্নতি হয়েছে।
প্রযুক্তিগত উন্নয়ন কতটা সাহায্য করছে?
সুনিতা উইলিয়ামস: আজকের দিনে একটা স্মার্টফোনেও স্পেস শাটলের চেয়ে বেশি কম্পিউটিং শক্তি থাকে। নতুন প্রযুক্তি, উপকরণ, জ্বালানির ব্যবহার সবকিছুই উন্নত হচ্ছে। এসব খাতে বেসরকারি উদ্ভাবনের জায়গা থাকছে। সরকারও সাহায্য করছে চুক্তি দিয়ে।
ভবিষ্যতে কোন খাতে সবচেয়ে বেশি উন্নয়ন হবে মহাকাশ নিয়ে?
সুনিতা উইলিয়ামস: অবশ্যই রকেট। তবে এর নানা উপকরণ, স্পেসস্যুট, ল্যান্ডার—সব কিছু উন্নত করতে হবে। আপনি যদি দীর্ঘ সময়ের জন্য কাউকে কোনো স্থানে পাঠান, তাহলে সেই ব্যক্তির প্রতিটি ছোট ছোট বিষয়েরও সমাধান করতে হবে। খাবার, ব্যায়াম, পোশাকের মতো সব জিনিসের সৃজনশীল উপায় খুঁজে বের করতে হবে। শিশুদের আমি প্রায়ই বলি, ‘তুমি যেকোনো কিছু করতে পারো, এমনকি মহাকাশের ব্যবসা নিয়েও ভাবতে পারো। শুধু নভোচারী, ইঞ্জিনিয়ার বা ডাক্তার হতে হবে না।’
তাহলে মহাকাশের ব্যাপারে আমরা এখনো অনেক কিছু জানি না।
সুনিতা উইলিয়ামস: হ্যাঁ, আমরা মহাকাশ থেকে সুস্থভাবে ফিরে এসেছি ঠিকই, কিন্তু দীর্ঘদিন কেউ মহাকাশে থাকলে কী হয়, সেটা জানতেই হবে। চাঁদ খুব বেশি দূরে নয়, তাও সেই মিশন কয়েক সপ্তাহ দীর্ঘ হয়। নভোচারীরা এই পুরো সময়টা মাইক্রোগ্র্যাভিটিতে থাকে। মঙ্গলযাত্রা অনেক দীর্ঘ, ওখানে অনেক দিন থাকতে হবে। মঙ্গলে পৃথিবীর মতো মাধ্যাকর্ষণও থাকবে না। তাই আমাদের এখনো অনেক কিছু শিখতে হবে।