আপনি বিগ ডেটা নিয়ে কাজ করেন, বিশেষ করে বিভিন্ন স্পেস টেলিস্কোপের পাঠানো তথ্য বিশ্লেষণ করে নতুন গ্যালাক্সি ও নক্ষত্র খুঁজে বের করেন। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য বিষয়টা সহজ করে বলুন।
সৈয়দা লাম্মীম আহাদ: নতুন গ্যালাক্সি বা নক্ষত্র খুঁজে বের করা কাজের একটা অংশ বলা যায়। তবে মূল কাজ হলো মহাবিশ্বে গ্যালাক্সি, নক্ষত্র, গ্রহ সবকিছুর যে বিপুল বৈচিত্র্য আমরা দেখতে পাই, সেগুলোর জন্ম ও বিবর্তন কীভাবে হয়েছে, সেটা বোঝার চেষ্টা। আমার গবেষণা দুই ধরনের ডেটা নিয়ে—একদিকে ভূপৃষ্ঠে বা মহাকাশে স্থাপিত টেলিস্কোপ দিয়ে মহাবিশ্বের গ্যালাক্সিদের তথ্য, অপর দিকে সুপারকম্পিউটারে রান করা মহাবিশ্বের সিমুলেশন থেকে পাওয়া তথ্য। টেলিস্কোপের ছবি থেকে আমরা মহাবিশ্বের গ্যালাক্সিগুলোর বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্যের ধারণা পাই। পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম মেনে সেগুলো কীভাবে তৈরি হওয়া সম্ভব, তা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি আমরা। যেহেতু জ্যোতির্বিজ্ঞানের ঘটনাবলির (যেমন তারার ও গ্যালাক্সিদের জন্ম ও বিবর্তন) সময়কাল আর ঘটনার ক্ষেত্র অনেক ব্যাপ্ত, পৃথিবীতে কোনো ল্যাবরেটরিতে এর পুনরাবৃত্তি করে পরীক্ষণ সম্ভব নয়। সে জন্য আমরা সুপারকম্পিউটারে করা কসমোলজিক্যাল হাইড্রোডায়নামিক সিমুলেশন থেকে পাওয়া তথ্য ব্যবহার করি।
মহাবিশ্বের সব জায়গায়ই পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম এক। তাই আমাদের পৃথিবীতে ভৌতজগৎ যে নিয়ম মেনে চলে, সেই নিয়ম দিয়েই মহাবিশ্বের ঘটনাবলি ব্যাখ্যা করা সম্ভব। যদি সম্ভব না হয়, তাহলে আমাদের জানা বিজ্ঞানের নিয়মের কোথাও গরমিল আছে। এই গরমিল বা ফাঁকফোকরগুলো খুঁজে বের করে ঠিক করা গেলে আমরা মহাবিশ্বের বিবর্তনের সামনের ধাপগুলো সম্পর্কে ধারণা পাব।
নাসার অনেকগুলো প্রজেক্ট চলমান। জেমস ওয়েব নভোদুরবিন নিয়ে সবাই অনেক আশাবাদী। আপনি কি কোনো বিশেষ প্রকল্প নিয়ে আশাবাদী বা কাজ করতে ইচ্ছুক?
সৈয়দা লাম্মীম আহাদ: এখন বিশ্বমানের জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণার বেশির ভাগ দুরবিন বা প্রজেক্ট কিন্তু খুব কম সময়ই শুধু একটি দেশের একক প্রজেক্ট হিসেবে থাকে। এমনকি জেমস ওয়েব দুরবিনও নাসার একক প্রজেক্ট নয়, সঙ্গে ইসা (ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি) এবং আরও কিছু দেশের সংস্থার অর্থায়ন, জনবল ও দক্ষতা এই অ্যাম্বিশাস প্রজেক্টের জন্য প্রয়োজন ছিল। জেমস ওয়েবের বিশেষ ক্ষমতা এর রিজলভিং পাওয়ার এবং অনেক অতীতের গ্যালাক্সিগুলোর ছবি তোলা। (রিজলভিং পাওয়ার মানে, এটা দিয়ে কত দূরের দুটি আলোক উৎসের (গ্যালাক্সি) ছবি পরস্পর থেকে আলাদা করা যাবে। যে টেলিস্কোপের রিজলভিং পাওয়ার যত ভালো, সেটা দিয়ে তত দূরের আর পরস্পর কাছাকাছি থাকা দুটি উৎসের ছবি তত ভালোভাবে আলাদা করা যায়।) এই ক্ষেত্রে এর অবদান এখন পর্যন্ত তুলনাহীন এবং সামনে নিশ্চিতভাবেই আরও অনেক ভালো কাজ এখান থেকে আসবে। তবে জেমস ওয়েব একসঙ্গে আকাশের খুব অল্প জায়গার ছবি তুলতে সক্ষম।
আমার আগ্রহের জায়গা আয়তন আর বৈচিত্র্যে বিগ ডেটা—আমি মহাবিশ্বের বিবর্তনের বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন ধরনের গ্যালাক্সি কীভাবে বদলেছে এবং কেন বদলেছে, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজি। তাই আমার গবেষণার জন্য বেশি উপযোগী লার্জ স্কাই সার্ভে বা মহাকাশ জরিপ প্রকল্পগুলো, যাদের উদ্দেশ্য আকাশের একটা বড় অংশের সবকিছুর ছবি বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যে তোলা। এমন দুটি বড় প্রকল্প এখন চলমান—একটি ইসা আর নাসার মিলিত প্রকল্প ‘ইউক্লিড’, আরেকটি ভেরা রুবিন মানমন্দিরের লিগ্যাসি সার্ভে অব স্পেস অ্যান্ড টাইম (এলএসএসটি)। ইউক্লিড জেমস ওয়েবের মতোই এল২ অরবিটে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে এবং অবলোহিত তরঙ্গদৈর্ঘ্যে মহাকাশের ছবি আর বর্ণালি আমাদের পাঠাচ্ছে। এলএসএসটি প্রকল্পের মানমন্দির দক্ষিণ আমেরিকার চিলিতে প্রস্তুত হচ্ছে। এই প্রকল্পে দৃশ্যমান বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যে মহাকাশের ছবি আর বর্ণালি ধারণ করা হবে। এই দুটি প্রকল্প থেকে আমরা মহাকাশের এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি পরিমাণ গ্যালাক্সির সবচেয়ে সেরা মানের ছবি আর তথ্য পাব। এই প্রকল্পগুলোর প্রাথমিক উদ্দেশ্য ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জির গবেষণা হলেও গ্যালাক্সি বিবর্তনের গবেষণায় এখান থেকে পাওয়া তথ্য যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে আশা করছে সবাই। আমি এই দুই প্রকল্পের সঙ্গেই যুক্ত আছি গ্যালাক্সি বিবর্তন ও গ্যালাক্সি ক্লাস্টারবিষয়ক গবেষণার টিমে।
মহাকাশবিজ্ঞান নিয়ে আমাদের যে রকম আগ্রহ, সত্যিকার একজন গবেষকের জন্য বিষয়টা সে রকম নয়। রংচঙে ছবি নয়, আপনাদের সারা দিন বিভিন্ন ডেটা প্রসেস করতে হয়, ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে থাকতে হয়। এ অভিজ্ঞতাটা আসলে কেমন? কখনো বিরক্তি চলে আসে কি?
সৈয়দা লাম্মীম আহাদ: ঠিক বলেছেন। জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণার মূল কাজগুলোর মধ্যে আছে ইনস্ট্রুমেন্টেশন, ডেটা প্রসেসিং, প্রোগ্রামিং, পদার্থবিজ্ঞান আর স্ট্যাটিস্টিকস। ইনস্ট্রুমেন্টেশন ছাড়া বাকি সবই আমার কাজের অংশ। আমার ডেটা নিয়ে কাজ করতে ভালো লাগে। বিভিন্ন টেলিস্কোপ থেকে আমাদের পাওয়া প্রাথমিক ডেটা থাকে ফোটন কাউন্ট—আরও প্রাথমিক হলো দুরবিনের ডিটেক্টরে আলোর কণা এসে পড়লে সেখান থেকে তৈরি হওয়া তড়িৎ প্রবাহ। এই প্রবাহ থেকে আমরা ফোটন কাউন্ট পাই। সেখান থেকে কোনো তরঙ্গদৈর্ঘ্যে কী পরিমাণ আলো আসছে, সেই তথ্য পাই। এই আপাত সাধারণ তথ্যের সঙ্গে পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম আর অন্য অসংখ্য গবেষকের কাজ থেকে পাওয়া জ্ঞান মিলিয়ে আমরা হিসাব করতে পারি কোটি কোটি কিলোমিটার দূর থেকে আসা আলো কোন কোন পদার্থের মেঘের মধ্য দিয়ে পাড়ি দিয়েছে, এই আলোর উৎসের (নক্ষত্র, গ্রহ, গ্যালাক্সি ইত্যাদি) বৈশিষ্ট্য কী, এদের জন্ম, বিবর্তন আর মৃত্যুর গল্প। পুরো ব্যাপারটার মধ্যে একটা কাব্যিক সৌন্দর্য আছে। বিরক্তি যে আসে না তা নয়, তবে সেটা ডেটা কালেকশন আর প্রসেসিংয়ের সঙ্গে বা সংশ্লিষ্ট ব্যুরোক্রেসির সঙ্গে জড়িত বেশি, অ্যানালিসিসের সঙ্গে নয়; বরং সবকিছুর শেষে একটা ডেটাসেট থেকে আমি কী শিখতে পারছি, এটা ট্রায়াল অ্যান্ড এররের মধ্য দিয়ে বের করাটার সঙ্গে জটিল ধাঁধা সমাধানের মতো আনন্দের মিল আছে।
আপনার কি মনে হয়, আমরা কখনো সবকিছুর তত্ত্ব, মানে ‘থিওরি অব এভরিথিং’ খুঁজে পাব?
সৈয়দা লাম্মীম আহাদ: যদি সবকিছুকে একটা তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়, তবে সেটা খুঁজে পাওয়াটা সময় আর শ্রমের ব্যাপারমাত্র। আমি মনে করি পাব—তবে কবে পাব, সেটা নির্ভর করবে আমরা, মানে মানবসভ্যতা এই খোঁজের পেছনে কতটা রিসোর্স (সময়সহ) বিনিয়োগ করছে, তার ওপর।
আপনি যেমন নাসার ডেটা বিশ্লেষণ করেন, অন্য কেউ এ ধরনের কাজ করতে চাইলে তাদের কীভাবে এগোনো উচিত? বিজ্ঞানচিন্তার কিশোর-তরুণ পাঠকদের উদ্দেশে বলুন।
সৈয়দা লাম্মীম আহাদ: ডেটা বিশ্লেষণ আমার কাজের উপায়মাত্র। ডেটা বিশ্লেষণ করে অনেক ধরনের সমস্যা নিয়ে কাজ করা যায়। আমি পদার্থবিজ্ঞানের সমস্যা নিয়ে কাজ করি। কেউ যদি ডেটা বিশ্লেষণের কাজ করতে চায়, তাহলে তাকে ডেটা সায়েন্স বা কম্পিউটার প্রকৌশল নিয়ে পড়তে হবে। আর কেউ যদি জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করতে চায়, তাহলে অনেকভাবে এগোনো যায়। সবচেয়ে স্ট্যান্ডার্ড পদ্ধতি হবে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে স্নাতক সম্পন্ন করা, সঙ্গে সম্ভব হলে জ্যোতির্বিজ্ঞানে মেজর বা মাইনর করা। বাংলাদেশে জ্যোতির্বিজ্ঞানে মেজর এখনো সম্ভব নয়, তবে ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় বা আইইউবিতে এখন মাইনর করা সম্ভব। এমনকি কম্পিউটারবিজ্ঞানে মেজর করে জ্যোতির্বিজ্ঞানে মাইনর সম্ভব। এটাও খুব ভালো একটা কম্বিনেশন। সেই সঙ্গে গণিত, স্ট্যাটিস্টিকস ও প্রোগ্রামিং খুব ভালো জানতে হবে। স্নাতক পড়ার সময়ই সম্ভব হলে গবেষণার কাজে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করতে হবে থিসিস বা প্রজেক্টের মাধ্যমে। এরপর জ্যোতির্বিজ্ঞানে মাস্টার্স ও পিএইচডি করতে হবে। এই দুটি এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে সম্ভব নয়।
এবার একটু পেছনে ফিরে যাই। আপনি বুয়েটে পড়াশোনা করেছেন। বুয়েটের অভিজ্ঞতাটা কেমন ছিল? বিদেশে গবেষণা করতে গেলেন কেন?
সৈয়দা লাম্মীম আহাদ: আমি বুয়েট থেকে তড়িৎ কৌশলে স্নাতক শেষ করে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ইরাসমাস মুন্ডাস শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে দুই বছরের প্রোগ্রামে জ্যোতির্বিজ্ঞানে মাস্টার্স করি। এ সময় আমি অস্ট্রিয়া, ইতালি আর সার্বিয়ার তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি ও গবেষণা করি। এরপর নেদারল্যান্ডসের লেইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানে পিএইচডি করি। পাঁচ বছরের পিএইচডি গবেষণা শেষ করে আমি কানাডায় পোস্টডক্টরাল ফেলো হিসেবে জয়েন করি এক বছর আগে।
বুয়েটের অভিজ্ঞতা অনেক কিছু শিখিয়েছে। আমার গবেষণায় হাতেখড়িও বুয়েটে শেষ বর্ষের থিসিসের সময়। তারও আগে থেকেই জ্যোতির্বিজ্ঞান পড়ার ও বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন ছিল। বুয়েটে পড়ার সময় গবেষণার অভিজ্ঞতায় সেই স্বপ্ন পোক্ত হয় বলা যায়। জ্যোতির্বিজ্ঞানে যেহেতু দেশে কাজের সুযোগ নেই, বিদেশে পড়তে আসতে হবে, সেটা আগেই বুঝতে পেরেছি—প্রয়োজনীয়তার জন্য।
বুয়েটে পড়ার সময় একসময়ে ঠিক করলাম, যদি জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা না করি, তাহলে পাবলিক পলিসি, বিশেষ করে বিজ্ঞান শিক্ষার পলিসি নিয়ে কাজ করতে চাই। সে সময় আমি নানা রকম এক্সট্রাকারিকুলার কাজকর্মে যুক্ত ছিলাম। বুয়েটের বিজ্ঞান ক্লাব আর কালচারাল ক্লাবে ছিলাম। আবার বাইরে বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে কমিউনিটি সার্ভিসের কাজ করেছি। ২০১৩ আর ২০১৪ সালে দুটি আন্তর্জাতিক প্রোগ্রামে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগও হয়। এ সময় দেশে বিজ্ঞান আর জ্যোতির্বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণেও কাজ করেছি। ২০১২ সালে বুয়েটের অধ্যাপক ও জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখক ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী স্যারের সঙ্গে সহলেখক হিসেবে সবার জন্য জ্যোতির্বিদ্যা (তাম্রলিপি প্রকাশনী) বই লিখি। এ ছাড়া সে সময় দেশের ভেতরে অনেক ঘুরে বেড়িয়েছি। ২০১৪ সালে আমি তৃতীয় বর্ষে থাকার সময় আমার মা স্ট্রোক করেন এবং পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হন। এর পর থেকে শুধু প্রয়োজনীয় পড়াশোনা আর কাজের বাইরে অন্য কাজগুলো করা সম্ভব হয়নি আর।
আপনার শৈশব-কৈশোরের গল্প শুনতে চাই। বেড়ে ওঠা, এসএসসি, এইচএসসি।
সৈয়দা লাম্মীম আহাদ: একদম ছোটবেলায় নাটোরে ছিলাম—বাবার কাজের পোস্টিং। স্কুল শুরু হতে হতে মাদারীপুরে চলে আসি। আমার দাদাবাড়ির গ্রামে থাকি কয়েক বছর। আমার মা সেখানকার কলেজের রসায়নের শিক্ষক ছিলেন। পড়াশোনার সুবিধার জন্য চতুর্থ শ্রেণি থেকে মাদারীপুর শহরে থাকি। এ সময় বাবা বদলি হয়ে চলে আসেন। সেখানে ডনোভান সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি দিই ২০০৭ সালে। ওই বছর মাদারীপুর জেলা থেকে আমি একাই গোল্ডেন এ প্লাস পাই মেয়েদের মধ্যে। এসএসসির পর ঢাকায় চলে আসি। রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ থেকে এইচএসসি দিই।
ছোটবেলা থেকেই পড়তে ভালোবাসতাম। প্রচুর কমিকস আর গল্পের বই পড়তাম। রহস্য গল্প পড়তে ভীষণ ভালো লাগত। ক্লাস ফাইভে থাকতে শার্লক হোমস অমনিবাস পড়ে ফেলেছিলাম। এ ছাড়া তিন গোয়েন্দা-ফেলুদা তো আছেই। স্কুলে থাকতে সেবা প্রকাশনীর বইয়ের ভীষণ ভক্ত ছিলাম। ক্লাস সেভেনে থাকতে টিফিনের টাকা জমিয়ে বই কিনে পড়তে আমরা কয়েকজন বান্ধবী মিলে একটা ছোট লাইব্রেরি খুলেছিলাম। যেহেতু একার টিফিনের টাকায় প্রতি সপ্তাহে বই কেনা সম্ভব নয়, তাই সবাই মিলে সমস্যা সমাধান! একটা বই কিনে একজন একজন করে সবাই পড়ে নিতাম। লাইব্রেরির নামও ছিল একটা, ‘অজানার খোঁজে’। ক্লাস নাইনে উঠে পড়াশোনার চাপ বেড়ে যাওয়ায় লাইব্রেরি বন্ধ করে বই ভাগাভাগি করে নিই আমরা।
খেলাধুলায় বেশ বাজে ছিলাম সব সময়। খেলতে গেলেই পড়ে গিয়ে হাত–পা কেটে একাকার অবস্থা হতো। এ ছাড়া অনেক কিছুই করতাম নিয়মিত—গান, আবৃত্তি, ছবি আঁকা ইত্যাদি। এসএসসির পর থেকে অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ শুরু করি—জ্যোতির্বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড দিয়ে। তখন মাদারীপুর থেকে সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল না। মা বরিশাল নিয়ে গিয়েছিলেন প্রথমবার। সেবার আঞ্চলিক অলিম্পিয়াডে প্রথম হই, জাতীয় পর্যায়ে এসে বাজে অবস্থা। তবে সেখান থেকেই আগ্রহ শুরু হয়েছে।
একনজরে
পুরো নাম: সৈয়দা লাম্মীম আহাদ
ডাক নাম: লাম্মীম
জন্মতারিখ: এপ্রিল ৩
বাবা: সৈয়দ গোলাম আহাদ
মা: সুলতানা পারভীন (মরহুমা)
অবসর: বই পড়া, ছবি আঁকা, ভ্রমণ, লেখালেখি
প্রিয় বই: দেশে বিদেশে, আরণ্যক, কাফকা অন দ্য শোর
প্রিয় লেখক: সৈয়দ মুজতবা আলী, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, হারুকি মুরাকামি (প্রিয় বই আর লেখকের তালিকা দীর্ঘ। অল্প কয়েকটি বললাম)
প্রিয় সিনেমা: দ্য পারস্যুট অব হ্যাপিনেস
গবেষক হতে চেয়েছিলেন কেন? এর পেছনে বিশেষ কোনো ঘটনা আছে?
সৈয়দা লাম্মীম আহাদ: কোনো বিশেষ ঘটনা নেই। তবে আমার বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে বড় হওয়ার পেছনে মায়ের ও ছোটদের জন্য বাংলায় লেখা বিজ্ঞান বইয়ের ভূমিকা অনেক। মা রসায়নের শিক্ষক ছিলেন। শুধু পরীক্ষায় ভালো করার জন্য নয়, বিজ্ঞান কীভাবে জীবনে সব জায়গায় ছড়িয়ে আছে আর কীভাবে বিজ্ঞান দিয়ে আমরা সমস্যা সমাধান করি—এসবই মা গল্পের ছলে বলতেন। ছোটবেলায় রূপকথার গল্পের সঙ্গে বিজ্ঞানীদের জীবনী আর বিজ্ঞানের মজার খেলার বই পড়ে বড় হয়েছি। নতুন খেলনা পেলে এক্সপেরিমেন্টের নামে খেলনা ভেঙে সেখান থেকে চিপ আর চুম্বক নিয়ে দেখতাম, ওগুলো কী করে। খেলনা গাড়ির মোটর ভেঙে তাতে পাখা লাগিয়ে ফ্যান বানিয়ে ভাবতাম বিজ্ঞানী হয়ে গেছি (হা হা)। গ্রামে আশপাশের জায়গা থেকে নানা রকমের গাছের পাতা জোগাড় করে বলতাম, স্যাম্পল সংগ্রহ করি। আবার সন্ধ্যায় লোডশেডিংয়ের সময় মা কালপুরুষ আর সপ্তর্ষি মণ্ডল চিনিয়ে দেওয়ার পরে মনে হয়েছে এই তারাগুলো আসলে কেমন, জানতে পারলে ভালো হয়। বড় হয়ে বিজ্ঞানী হতে চাইতাম। তবে কী বিষয়ে কাজ করব, এসব ভাবনা অনেক পড়ে এসেছে অবশ্যই। তখন মনে হতো প্রকৃতিকে জানাবোঝার চেষ্টা করাই বিজ্ঞান।
দেশের কেউ আপনার সঙ্গে কাজ করতে চাইলে কী করতে পারে?
সৈয়দা লাম্মীম আহাদ: আমাকে কাজের আগ্রহের কথা জানাবেন। কথা বলে দেখব, আসলেই কোনো প্রজেক্টে কাজ সম্ভব কি না। আমার গবেষণার বিষয় নিয়ে তো এর মধ্যেই বলেছি। সেই সঙ্গে আমার গবেষণাপত্রগুলো গুগল স্কলার বা নাসার অ্যাস্ট্রোফিজিকস ডেটা সিস্টেম (এডিএস) যেকোনোটায় খুঁজলেই পেয়ে যাবেন। জেনেরিকভাবে কাজ করতে চাই না বলে আগ্রহের বিষয় বা প্রজেক্ট নিয়ে বললে ভালো হয়। আগে থেকে গবেষণার অভিজ্ঞতা না থাকলে শিখে নিয়ে কাজ করতে অনেক সময় ও পরিশ্রম করতে হবে। সে রকম মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করব।
৭০-৮০-এর দশকে অনেকে বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিয়ে দেশে ফিরতেন। জামাল নজরুল ইসলাম এর বড় উদাহরণ। এই ট্রেন্ডটা এখন কমে গেছে। এখন দেশে কেউই ফিরে আসতে চান না বললেই চলে। আপনার কী মনে হয়, এর কারণ কী?
সৈয়দা লাম্মীম আহাদ: প্রধান কারণ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি মানুষ উচ্চশিক্ষা নিতে বাইরে যাচ্ছেন। এত মানুষ দেশে ফিরে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ পাচ্ছেন না। আবার আগের চেয়ে এখন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ অনেক সহজ, তাই দেশের বাইরে থাকলেও দেশে কাছের মানুষের থেকে খুব বেশি বিচ্ছিন্ন নেই কেউ। সেই সঙ্গে বিদেশে বাংলাদেশি মানুষের কমিউনিটি ক্রমবর্ধমান, তাই দেশীয় উৎসব আয়োজন বা দেশি মানুষের সাহচর্য পাওয়া সম্ভব। তাই উপযুক্ত কাজের সুযোগ আর কমিউনিটি দুটিই থাকায় অনেকে বাইরে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।
তবে মুদ্রার ওপিঠে বলব, জামাল নজরুল ইসলাম যেমন এসেছেন, ওনার সময়েও অনেকেই কিন্তু রয়েও গেছেন। যাঁরা দেশে ফিরে আসেননি, তাঁদের ব্যাপারে জানা হয়নি দেখে এখন মানুষ আসছেন না মনে হতে পারে। কাজেই এটা অনেকটা সাকসেসর বায়াসের মতো ব্যাপার। আমার পরিচিত অনেকে যেমন বিদেশে পড়তে এসে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তেমনি অনেকে দেশে ফেরত গিয়েছেন আবার অনেকে ফিরতে চাইছেন, কিন্তু কাজ পাচ্ছেন না উপযুক্ত।
বাংলাদেশে মহাকাশবিজ্ঞান নিয়ে যে আগ্রহ গড়ে উঠেছে বর্তমানে বা গত এক দশকের যে বিজ্ঞানচর্চা—আপনি নিজে এর মধ্য দিয়ে গেছেন। এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী? বাংলাদেশে বিজ্ঞানচর্চা এখন কোন পর্যায়ে রয়েছে?
সৈয়দা লাম্মীম আহাদ: বিজ্ঞানচর্চা নিয়ে আমি মনে করি, এখানে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বাড়ানো প্রয়োজন। আমি বেড়ে ওঠার সময় বিজ্ঞানচর্চা বা বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের যেসব কাজ দেখেছি একজন শিক্ষার্থী হিসেবে, এখন তার চেয়ে কাজের ব্যাপ্তি অনেক বেড়েছে। এখানে প্রযুক্তি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তবু বর্তমানে দেশের বিজ্ঞানচর্চা যথেষ্ট পোলারাইজড অবস্থায় আছে, আমি যা দেখি। ঢাকা-চট্টগ্রাম বা বড় কিছু শহরে এসব সুযোগ আছে, ঢাকায় নিঃসন্দেহে অনেক ভালো কাজ হচ্ছে। তবে মফস্সল শহরে বা গ্রামে, এমনকি স্কুল–কলেজের শিক্ষায় ঘাটতি আছে। আমি বিভিন্ন জায়গায় আমার পরিচিত মানুষের বা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে যা দেখেছি, সেই পরিপ্রেক্ষিতে বলছি। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের কাজগুলো দেশে প্রায় সিংহভাগই হয় স্বেচ্ছাসেবী কাজ হিসেবে। স্বেচ্ছাসেবীদের এমনকি নিজ খরচে এসব কাজ করতে হয়। এটা কোনো সুদূরপ্রসারী বা টেকসই সমাধান নয়। এ ক্ষেত্রে সরকারি–বেসরকারি অনুদান ও কাঠামোগত কাজ বাড়ানো জরুরি।
বিজ্ঞানচিন্তার বেশির ভাগ পাঠক কিশোর-তরুণ। তাদের উদ্দেশে কিছু বলুন।
সৈয়দা লাম্মীম আহাদ: বিজ্ঞান গবেষণার একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো আনন্দ। আমার পিএইচডি চলাকালে নতুন কোনো ডেটা হাতে এলেই আমার সুপারভাইজর বলতেন, ‘প্লে অ্যারাউন্ড উইদ ইট’ মানে নেড়েচেড়ে দেখো এটা কেমন লাগছে, ইন্টারেস্টিং কিছু আছে কি না, কোনো সমস্যা আছে কি না ইত্যাদি—খেলার মতো কৌতূহল আর আগ্রহ নিয়ে দেখতে হবে। আর সব সময় বলতেন, সময় নিয়ে কাজ করো, খুঁটিনাটি বিষয়গুলো যাচাই করে দেখো, তাড়াহুড়ার কিছু নেই। তাড়াহুড়া করে বিজ্ঞান হয় না। এই কথাগুলো আমি মনে রেখে কাজ করি, বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদেরও জানিয়ে রাখলাম। এ ছাড়া তরুণদের বলব, বিজ্ঞানচিন্তার পাঠক হিসেবে ধরেই নিচ্ছি যে তোমরা বিজ্ঞানের আনন্দ কিছুটা হলেও পেয়েছ। এই আনন্দটাকে মনে রেখো। নতুন কিছু জানা, একটা জটিল সমস্যা নিয়ে লেগে থাকা, সেটার সমাধান করতে পারা, প্রকৃতিকে বুঝতে পারা—এ সবকিছুই আনন্দের আর সৌভাগ্যের ব্যাপার। আরও বড় আনন্দ মানুষের ভালোর জন্য কিছু করতে পারা। এসব আনন্দে তোমাদের জীবন ভরে উঠুক, শুভকামনা রইল।