বিড়াল, কুকুর বা ঘোড়ার মতো অনেক প্রাণীই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। অনেক মানুষ যে ক্যান্সারে আক্রান্ত হন, তা তো বলা বাহুল্য। অথচ হাতির মতো বিশালদেহী প্রাণীর ক্যান্সার বলতে গেলে হয়ই না। বিষয়টা অবাক করা তো বটেই।
তিমি বা হাতির মতো বিশালদেহী প্রাণীর ক্যান্সার হয় না বললেই চলে। অর্থাৎ ক্যান্সার হওয়ার সঙ্গে কোনো প্রজাতির কোষের সংখ্যার সম্পর্ক দেখা যায় না
বিজ্ঞানে পেটোর প্যারাডক্স বলে একটা ব্যাপার আছে। এই প্যারাডক্স বা হেঁয়ালির মূল কথা হলো, একই প্রজাতির প্রাণীর কোষের সংখ্যা বেশি হলে তার ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি (ক্যান্সারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্য বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রিত থাকলেও এমনটাই দেখা যায়)। অথচ প্রজাতিভেদে এই বিষয়টি আর কাজ করে না। তিমি বা হাতির মতো বিশালদেহী প্রাণীর ক্যান্সার হয় না বললেই চলে। অর্থাৎ ক্যান্সার হওয়ার সঙ্গে কোনো প্রজাতির কোষের সংখ্যার সম্পর্ক দেখা যায় না। কেন, সে বিষয়টা বুঝতে আগে ক্যান্সার জিনিসটা কী, তা দেখে নেওয়া প্রয়োজন।
আমাদের দেহে ক্যান্সার হওয়ার কারণ, কোষের ভেতর লম্বা সময় ধরে জমা মিউটেশন। মিউটেশন কী? কোষের ডিএনএতে চার ধরনের নাইট্রোজেন ক্ষার একটা নির্দিষ্ট অনুক্রমে বসানো থাকে। ক্ষার চারটা হলো—অ্যাডিনিন (A), গুয়ানিন (G), সাইটোসিন (C) আর থায়মিন (T)। মিউটেশন মানে হলো, কোনো কারণে ডিএনএতে এই চারটা ক্ষারের অনুক্রম পরিবর্তিত হয়ে যাওয়া। আর মিউটেশন হওয়ার একটা কারণ হলো কোষের ভেতরে ডিএনএ অনুলিপন—অর্থাৎ যে প্রক্রিয়ায় এক ডিএনএ থেকে অন্য ডিএনএ তৈরি হয়, সে প্রক্রিয়ায় ভুল হওয়া।
হয়তো ভাবতে পারেন, হাতিও আমাদের মতো লম্বা সময় ধরে বাঁচে। তাদের দেহে কোষের সংখ্যাও অগণিত। কিন্তু হাতি কখনো ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় না বললেই চলে। কারণটা কী?
মানবদেহের মতো হাতির দেহেও পি৫৩ (p53) নামে একধরনের প্রোটিন তৈরি হয়। এই প্রোটিনের কাজ হলো ডিএনএ অনুলিপনের সময় হওয়া ভুলগুলো ঠিক করা। কোষে প্রোটিন তৈরি হয় জিন থেকে। তেমনি পি৫৩ প্রোটিনের জন্যও আছে নির্দিষ্ট জিন। এর নাম টিপি৫৩ (TP53)। ডিএনএ অনুলিপনের সময়ের ভুলগুলো ঠিক করার মতো গুরু দায়িত্ব পালনের জন্য একে ‘গার্ডিয়ান অব দ্য জিনোম’ বা জিনের অভিভাবক বলে ডাকা হয়।
একটা লম্বা সময় ধরে কোষের ডিএনএতে মিউটেশন জমা হলে টিউমার সৃষ্টি হয়। পরে এই টিউমার থেকে হয় ক্যান্সার। পি৫৩ প্রোটিন ডিএনএর মিউটেশনগুলো ঠিক করে টিউমার গঠনের হাত থেকে কোষকে রক্ষা করে
অবাক করা বিষয় হলো, হাতির দেহকোষে পি৫৩ জিনের বিশটি কপি থাকে। প্রতিটি কপির আবার দুটি করে প্রকরণ থাকে। এগুলোকে ডাকা হয় অ্যালিল। সুতরাং হাতির দেহকোষে পি৫৩ জিনের প্রকরণ সংখ্যা দাঁড়ায় চল্লিশ। ফলত এদের কোষে মোট চল্লিশটি পি৫৩ প্রোটিন তৈরি হয়। আর মানুষের দেহকোষে এই জিনের কেবল একটি কপি (দুটি প্রকারণ) থাকে। ফলে আমাদের দেহকোষে কেবল দুটি পি৫৩ প্রোটিন তৈরি হয়।
একটা লম্বা সময় ধরে কোষের ডিএনএতে মিউটেশন জমা হলে টিউমার সৃষ্টি হয়। পরে এই টিউমার থেকে হয় ক্যান্সার। পি৫৩ প্রোটিন ডিএনএর মিউটেশনগুলো ঠিক করে টিউমার গঠনের হাত থেকে কোষকে রক্ষা করে। ডিএনএ অনুলিপন প্রক্রিয়ায় কোনো ভুল দেখা গেলেই এই প্রোটিন অনুলিপন প্রক্রিয়া থামিয়ে সেটা মেরামত করে। কিংবা কোষে যদি যথেষ্ট মিউটেশন জমে যায়, পি৫৩ প্রোটিন সে কোষকে আত্মঘাতী হতে বাধ্য করে। বোঝাই যাচ্ছে, এই প্রোটিনের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। অর্ধেকেরও বেশি মানুষের দেহে ক্যান্সার হয় রেডিয়েশন বা তেজস্ক্রিয়তা কিংবা কোনো কারণে পি৫৩ প্রোটিনের কার্যকারিতা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে।
এবারে আগের প্রশ্নে আবার ফেরা যাক। হাতির দেহে কেন ক্যান্সার হয় না? যেহেতু হাতির দেহে বহু সংখ্যক পি৫৩ প্রোটিন তৈরি হয়, তাই মিউটেশনের কারণে এই প্রোটিনের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়। তা ছাড়া একই কারণে একসঙ্গে বিভিন্ন আণবিক সংকেতে সাড়া দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত কোষের মিউটেশন মেরামত করা সম্ভব হয়। বিজ্ঞানীরা হাতির দেহকোষে পি৫৩ প্রোটিনগুলো কী করে ক্ষতিগ্রস্ত কোষের প্রতি সাড়া দেয়, তা বোঝার চেষ্টা করছেন। সেই সঙ্গে এই গবেষণা মানুষের দেহে ক্যান্সার রুখতে কাজে লাগানো যায় কি না, সে চেষ্টাও করে যাচ্ছেন।
লেখক: শিক্ষার্থী, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: সায়েন্টিফিক আমেরিকান, উইকিপিডিয়া