২০০৬ সাল। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার রেনফ্রু সেন্টার নামে একটি বিশেষায়িত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসাধীন চার নারীর জীবনী নিয়ে প্রকাশিত হয় একটি ডকুমেন্টারি। এতে আছে ১৫ বছর বয়সী শেলবি নামে এক কিশোরী। সে দীর্ঘদিন অ্যানোরেক্সিয়ায় আক্রান্ত। পলি নামে ২৯ বছর বয়সী নারীও দীর্ঘদিন অ্যানোরেক্সিয়া ও বুলিমিয়ার সঙ্গে লড়াই করেছেন। বাকি দুজনের নাম অ্যালিসা এবং ব্রিটনি। প্রত্যেকেই অ্যানোরেক্সিয়া নারভোসা (Anorexia Nervosa) বা বুলিমিয়া নারভোসা (Bulimia Nervosa) নামে ইটিং ডিজঅর্ডার বা খাদ্যজনিত ব্যাধিতে ভুগছিলেন।
ইটিং ডিজঅর্ডার সর্ম্পকে আমরা খুব বেশি না জানলেও আশপাশে এই রোগে ভোগা মানুষের সংখ্যা কম নয়। বিশেষভাবে নারী ও বয়ঃসন্ধিকালে থাকা কিশোর-কিশোরীরা এতে বেশি ভোগেন। অস্বাভাবিক খাদ্যাভ্যাস, শরীরের ওজন নিয়ে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা এবং খাদ্য গ্রহণের ওপর অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এই সমস্যা চিহ্নিত করা হয়। সহজ কথায়, ইটিং ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য খাবার খাওয়ার বিষয়টি চিন্তার ও অস্বস্তির বিষয়। বিশ্বের লাখ লাখ মানুষ এই ব্যাধির শিকার। পুষ্টিহীনতা, অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অক্ষমতা, এমনকি মৃত্যুর মতো মারাত্মক শারীরিক সমস্যাও সৃষ্টি হতে পারে এই রোগের কারণে।
এরই মধ্যে অনেক ধরনের ইটিং ডিজঅর্ডার চিহ্নিত করা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম অ্যানোরেক্সিয়া নারভোসা। আমাদের চারপাশে এমন অনেক মানুষ আছেন, যারা নিজেকে অত্যন্ত মোটা মনে করেন। এ জন্য তাঁরা খাবার খাওয়া কমিয়ে দেন, বদলে ফেলেন খাবারের পদ। যদিও বাস্তবে তাঁরা অতটা মোটাও নন। অ্যানোরেক্সিয়ার সঙ্গে নিউরোট্রান্সমিটার ডোপামিন এবং সেরোটোনিনের ভারসাম্যহীনতা জড়িত। মস্তিষ্কের ইনসুলার মতো অংশ খাবারের প্রতি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার জন্য দায়ী হতে পারে। অ্যানোরেক্সিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের মস্তিষ্কের ডোপামিন রিসেপ্টরগুলো অনেক সক্রিয় থাকে। এতে খাবার কম খেলে তাঁরা মানসিকভাবে স্বস্তি অনুভব করেন। পরে তা বিপজ্জনক অভ্যাসে পরিণত হয়।
এমন আরও একটা ইটিং ডিজঅর্ডার হলো বুলিমিয়া নারভোসা। মানবদেহে ঘ্রেলিন এবং লেপ্টিন নামে দুটি হরমোন আছে। এগুলো ক্ষুধার অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করে। বুলিমিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির ঘ্রেলিন ও লেপ্টিন হরমোনের ভারসাম্যহীনতা ঘটে। ফলে তাঁরা একবার খাবার খাওয়া শুরু করলে তা থামাতে পারেন না। অর্থাৎ, এই সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তি স্বল্প সময়ে বেশি খাবার খেয়ে পরে বমি করেন। অতিরিক্ত ব্যায়াম করে বা হজমের ওষুধ খেয়ে ওজন কমানোর চেষ্টা করেন। এ ধরনের মানুষ ওজন বাড়ার ভয়ে খাবার উপভোগ করতে পারেন না।
বিঞ্জ ইটিং ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তিরা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে প্রচুর খাবার খান। তবে বুলিমিয়ার মতো ওজন কমানোর কোনো ব্যবস্থা তাঁরা নেন না। এই সমস্যার সঙ্গে মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড সিস্টেমের অস্বাভাবিক কার্যকারিতা জড়িয়ে আছে। এতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা খাবারের প্রতি বেশি সংবেদনশীল হন। এটি ডোপামিন নিঃসরণের মাধ্যমে আনন্দ অনুভব করায়। ফলে তাঁরা নিয়মিত অতিরিক্ত খাবার খেয়ে ফেলেন।
পিকা নামে একটি ইটিং ডিজঅর্ডার আছে। এতে আক্রান্ত হলে শিশুরা ক্লাসরুমের চক খেয়ে ফেলে। অনেক শিশু দেয়াল খুঁড়ে সিমেন্টও খায়। আবার গর্ভাবস্থায় অনেক মায়ের উদ্ভট বস্তু খাওয়ার ইচ্ছা হয়। এসবই পিকা নামে ইটিং ডিজঅর্ডারের বৈশিষ্ট্য। মানে যে সব জিনিস সাধারণত খাওয়া যায় না, সেসব খাওয়ার প্রবণতা দেখা যায় এই রোগে আক্রান্ত হলে। অনেকে মাটি, বরফ, কাগজ, চুল, চক ইত্যাদি খান। সাধারণত অপুষ্টি বা নির্দিষ্ট পুষ্টি ঘাটতির জন্য মানুষ এই সমস্যায় ভোগেন।
রুমিনেশন ডিজঅর্ডার সাধারণত শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। তবে কিছু প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির মধ্যেও এটা দেখা যেতে পারে। রুমিনেশন ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তিরা খাবার মুখে দিয়ে আবার তা বের করে আনেন এবং পুনরায় চিবিয়ে খান। অনেক সময় চিবিয়ে ফেলে দেন।
ইটিং ডিজঅর্ডার আপাত দৃষ্টিতে নির্দোষ সমস্যা মনে হলেও এটি আমাদের শরীরকে ধীরে ধীরে নিঃশেষ করে ফেলে। প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাবে মাঝেমধ্যে প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে।
কিছু মানুষ ছোটবেলা থেকে নির্দিষ্ট কিছু খাবারের গন্ধ ও টেক্সচারের কারণে সেগুলো খেতে পারেন না। আবার কিছু খাবার খাওয়ার সময় আতঙ্কিত বোধ করেন। এমন সমস্যার নাম এআরএফআইডি। এতে আক্রান্ত ব্যক্তি নির্দিষ্ট কিছু খাবারের প্রতি বিশেষ ধরনের সংবেদনশীলতা অনুভব করেন। আর এই অস্বস্তির কারণে প্রয়োজনীয় পুষ্টি গ্রহণ করতে পারেন না। সাধারণত শিশুদের মধ্যে এ রোগ বেশি দেখা যায়।
ইটিং ডিজঅর্ডার আপাত দৃষ্টিতে নির্দোষ সমস্যা মনে হলেও এটি আমাদের শরীরকে ধীরে ধীরে নিঃশেষ করে ফেলে। প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাবে মাঝেমধ্যে প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে। ইটিং ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তিরা অস্টিওপোরোসিস, ইররেগুলার হার্টবিট ও ক্রনিক মেলনিউট্রেশনের ঝুঁকিতে থাকেন। দীর্ঘমেয়াদি ইটিং ডিসঅর্ডারে শারীরিক ও মানসিক সামাজিক বিকাশ ব্যাহত হয়।
ইটিং ডিজঅর্ডার শুধু খাবারের সঙ্গে সম্পর্কিত এমন নয়। জিনগত, পরিবেশগত ও সামাজিক কারণও এর সঙ্গে জড়িত। খাবার খেতে ভয় লাগলে তার প্রভাব সম্পূর্ণ শরীরেই পরে। তাই খাবার খেতে ভয় না পেয়ে যা খাবেন আনন্দের সঙ্গে খান।