মস্তিষ্কের মেমোরি কি কখনো ফুরিয়ে যেতে পারে
স্মার্টফোন বা কম্পিউটারের মতো মস্তিষ্কের মেমোরি কি ফুল হয়ে যেতে পারে? সাধারণত পরীক্ষার আগের রাতে বা কাজের চাপে নির্ঘুম রাত কাটানোর পর অনেকেরই এমন মনে হয়। কিন্তু স্নায়ুবিজ্ঞানীরা বলছেন, সুস্থ ও স্বাভাবিক মস্তিষ্কের স্মৃতি ধারণের নির্দিষ্ট কোনো সীমা নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন কলেজের মনোবিজ্ঞান ও স্নায়ুবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এলিজাবেথ কেনসিঞ্জার বলেন, ‘মস্তিষ্কে কত তথ্য রাখা যাবে, তার কোনো নির্ধারিত সীমা নেই। স্মৃতি হলো মস্তিষ্কে জমা হওয়া এক ধরনের তথ্য বা ডেটা। এই ডেটাগুলো মস্তিষ্কের বর্তমান মুহূর্ত বুঝতে পারে ও ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে’।
স্মৃতি কীভাবে সংরক্ষিত হয়?
মস্তিষ্কে কোনো তথ্য একক কোষে সংরক্ষিত হয় না, বরং একটি স্মৃতি অনেক স্নায়ুকোষে ছড়িয়ে থাকে। এই স্নায়ুগুচ্ছকে বলে এনগ্রাম। এগুলো মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা স্নায়ুকোষের একটি সংযুক্ত গ্রুপ। নিউরোসায়েন্টিস্টরা এর একটি নাম দিয়েছেন, ডিস্ট্রিবিউটেড রিপ্রেজেন্টেশন। এই প্রক্রিয়ায় মস্তিষ্কের প্রতিটি স্বতন্ত্র কোষ বিভিন্ন স্মৃতি ধরে রাখতে পারে। যেমন, জন্মদিনের পার্টির কোনো স্মৃতি মস্তিষ্কের এক জায়গায় সংরক্ষিত থাকে না। বেলুনের রং, কেকের স্বাদ, বন্ধুদের গান, উত্তেজনার অনুভূতি বিভিন্ন সংবেদনশীল ও মানসিক কেন্দ্রকে সক্রিয় রাখে। যেমন, আমাদের ভিজ্যুয়াল কর্টেক্স, টেস্ট কর্টেক্স, শ্রবণতন্ত্র ও আবেগ-প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্নে একসঙ্গে সক্রিয় হয় এবং স্মৃতি সংরক্ষণ করে। পরে সেই প্যাটার্ন পুনরায় সক্রিয় হলে স্মৃতি মনে পড়ে।
মস্তিষ্কের স্মৃতি ধারণক্ষমতা এত বেশি কেন?
যুক্তরাষ্ট্রের নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির নিউরোসায়েন্সের অধ্যাপক পল রেবার বলেন, ‘ডিস্ট্রিবিউটেড রিপ্রেজেন্টেশন পদ্ধতির কারণে মস্তিষ্কের এই বিশাল ক্ষমতা। প্রতিটি নিউরন অনেক স্মৃতির অংশ। ফলে ওগুলোর সংমিশ্রণের সংখ্যা বাড়ে ত্রিমাত্রিকভাবে। এই পদ্ধতিতে মস্তিষ্কে বিলিয়ন বিলিয়ন স্মৃতি ধারণ করা সম্ভব। তাই কিছু নিউরন ক্ষতিগ্রস্ত হলেও স্মৃতি ফিরে পাওয়া যায়। কারণ, স্মৃতিগুলো কেবল এক জায়গায় সংরক্ষিত থাকে না।
প্রতিদিন অফিস বা স্কুলে যাওয়ার স্মৃতি আমাদের আলাদাভাবে মনে থাকে না। কারণ, বেশিরভাগ স্মৃতি একই রকম। তাই এগুলোকে আলাদাভাবে স্মৃতি হিসেবে সংরক্ষণের পরিবর্তে আমরা সাধারণ অভিজ্ঞতা মনে রাখি।
সব তথ্য কেন মনে রাখতে পারি না?
আগেই বলেছি, মস্তিষ্কের মেমোরি ধারণের ক্ষমতা সীমিত নয়। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, আমরা কেন সবকিছু মনে রাখতে পারি না? এই প্রশ্নের উত্তর হলো, তথ্য ধারণের ক্ষমতা থাকলেও আমাদের মস্তিষ্ক সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পারে না। আমাদের মস্তিষ্কে প্রতি মুহূর্তে অসংখ্য তথ্য প্রবেশ করে, কিন্তু তার সবটা মেমোরিতে জায়গা পায় না। মেমোরিকে একটি ভিডিও ক্যামেরার মতো ভাবতে পারেন। তবে এই ক্যামেরা সব দৃশ্য ধারণ করবে না, বরং শুধু নির্দিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য রেকর্ড রাখবে। আমরা যা দেখি বা অনুভব করি, তার একটি ক্ষুদ্র অংশই দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতিতে রূপ নেয়। তাই আমাদের দেখা বা শোনা জিনিসের মাত্র দশ ভাগের এক ভাগই আমরা মনে রাখতে পারি। যে তথ্য আমাদের মেমোরি সিস্টেমে প্রবেশ করে, তা ধীরে ধীরে দীর্ঘমেয়াদী স্থায়ী স্মৃতিতে রূপান্তরিত হয়। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় কনসলিডেশন।
কী মনে রাখব, কী ভুলে যাব, তা কীভাবে নির্ধারিত হয়?
প্রতি মুহূর্তে আমাদের বিভিন্ন ইন্দ্রিয় থেকে প্রচুর তথ্য মস্তিষ্কে প্রবেশ করে। এগুলোর সবকিছু মনে রাখার দরকার নেই। কলোম্বিয়া ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানী লাইলা দাভাচি বলেন, ‘মানব মস্তিষ্ক স্মৃতিকে নিখুঁতভাবে মনে রাখার জন্য বিবর্তিত হয়নি। আমাদের মেমোরি সিস্টেম বিবর্তিত হয়েছে বেঁচে থাকার জন্য। তাই আমরা যেটাকে সহায়ক মনে করি, সেই স্মৃতি আমাদের মনে থাকে।’
আগেই বলেছি, মস্তিষ্কের মেমোরি ধারণের ক্ষমতা সীমিত নয়। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, আমরা কেন সবকিছু মনে রাখতে পারি না? এই প্রশ্নের উত্তর হলো, তথ্য ধারণের ক্ষমতা থাকলেও আমাদের মস্তিষ্ক সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পারে না।
মস্তিষ্ক কীভাবে তথ্য সংরক্ষণের কাজ করে?
তথ্য প্রক্রিয়া ও মনে রাখার ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের কিছু দক্ষতা রয়েছে। একই তথ্য বারবার পেলে মস্তিষ্ক তা বিস্তারিতভাবে নয়, বরং সারাংশ আকারে সংরক্ষণ করে। উদাহরণ হিসেবে স্কুল বা কর্মস্থলে যাওয়ার সময়ের কথা ভাবতে পারেন। প্রতিদিন অফিস বা স্কুলে যাওয়ার স্মৃতি আমাদের আলাদাভাবে মনে থাকে না। কারণ, বেশিরভাগ স্মৃতি একই রকম। তাই এগুলোকে আলাদাভাবে স্মৃতি হিসেবে সংরক্ষণের পরিবর্তে আমরা সাধারণ অভিজ্ঞতা মনে রাখি। বিশেষ কোনো ঘটনা ঘটলে মস্তিষ্ক শুধু সেই নির্দিষ্ট তথ্য সংরক্ষণ করে।
সুতরাং, মস্তিষ্কের জায়গা শেষ হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। বরং মস্তিষ্ক প্রতিনিয়ত পুনর্গঠিত হচ্ছে। মস্তিষ্ক প্রতিনিয়ত আগের অভিজ্ঞতা থেকে শেখে, ভবিষ্যতের পূর্বাভাস তৈরি করে এবং দরকারি বিষয় মনে রাখে। তাই আপনি যদি কফির কাপ বা বই কোথায় রেখেছেন তা ভুলে যান, তাহলে ভয় পাবেন না। কারণ, আপনার মস্তিষ্ক হয়তো তখন আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনে রাখার কাজ করছিল।