মাকড়শা একটা নিরীহ প্রাণী। অথচ একে দেখলেই অনেকে ভয়ে আঁতকে ওঠেন। যারা মাকড়সা দেখলে ভয় পান, তারা অ্যারাকনোফোবিয়ায় আক্রান্ত। এখন প্রশ্ন হলো, মাকড়শা দেখলেই অনেকে ভয় পায় কেন? মস্তিষ্ক তা কীভাবে বুঝতে পারে? ভয় পেলে মাথার মধ্যে কী চলে!
আসলে ভয় আমাদের জীবনযাপনের একটা অংশ। ইংরেজিতে একে বলে ফোবিয়া। এককথায়, শরীরের নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাই আমাদের সতর্ক করে দেয়। ধরুন, হঠাৎ একটা শব্দ শুনে লাফিয়ে ওঠলেন। দিলেন দৌড়। এই যে দৌড় দিলেন, এটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্যই ঘটে। ভয়ের বাহ্যিক প্রকাশও বলা যায় একে। আগে থেকে সতর্ক না থাকলে মস্তিষ্ক তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেয়। মস্তিষ্ক তখন নিজ থেকেই এমন প্রতিক্রিয়ার সংকেত পাঠায়। কিন্তু আপনি যদি আগে থেকেই জানেন যে একটা বিকট শব্দ হবে, তাহলে কিন্তু ভয় পাবেন না। দৌড়েও পালাবেন না। কারণ, এক্ষেত্রে আপনার মস্তিষ্ক আগে থেকেই জানে, ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। মস্তিষ্ক উপরের দুটি ঘটনা ভিন্ন প্রেক্ষাপটে আলাদা করে ফেলে।
ভয় পেলে মানুষ কি করে? স্বাভাবিক সময়ের সঙ্গে এর পার্থক্য কী? এসব বিষয় নিয়ে চলতি বছর সায়েন্স জার্নালে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন বিজ্ঞানীরা। চলুন, সেগুলো দেখা যাক।
মস্তিষ্ক যেভাবে ভয় চেনে
কিছু ভয় আমরা জন্মের পরপরই পাওয়া শুরু করি। যেমন, শিশুরা উচ্চ শব্দে ভয় পায়। কারণ, ওদের মস্তিষ্ক তীব্র শব্দকেই বিপদ হিসেবে ধরে নেয়। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্ক শিখে নেয়, কোনটা বিপদ আর কোনটা নয়। প্রতি বছর নববর্ষের সময় আতশবাজির উচ্চ শব্দে অনেক নবজাতকের মৃত্যুর খবর শোনা যায়। কিন্তু এই একই শব্দ শুনে ৩-৪ বছরের শিশু আনন্দ পায়। কারণ, ততদিনে ওদের মস্তিষ্ক বুঝে গেছে এটা ক্ষতিকর নয়, বরং আনন্দের। গবেষণা দলের প্রধান সারা মেদেরোস বলেন, ‘আমাদের মস্তিষ্ক অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শেখে। ক্ষতিকর নয় এমন ভয়গুলো ধীরে ধীরে উপেক্ষা করে।’
ভয়ের বিষয়টি বুঝতে বিজ্ঞানীরা ইঁদুরের ওপর একটা পরীক্ষা চালান। কিন্তু ইঁদুরই কেন! কারণ, ইঁদুরের মস্তিষ্কের সঙ্গে মানুষের মস্তিষ্কের বেশ মিল রয়েছে। ইঁদুরের ভয়টাও স্পষ্ট দেখা যায়। তাছাড়া ভয় পেলে এরা ঠাঁয় স্থির থাকে বা দ্রুত পালায়। স্বাভাবিকভাবেই ইঁদুর বাজপাখির মতো শিকারি পাখিকে ভয় পায়। পরীক্ষাটি গবেষণাগারেই করেছেন বিজ্ঞানীরা। বাজপাখির ছায়া প্রজেক্টরের সাহায্যে ফুটিয়ে তুলেছেন। প্রথমদিকে ছায়া দেখে ভয়ে ইঁদুর পালিয়ে যায়। এটা খুবই স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। একই পরীক্ষা বার বার চালান গবেষকেরা। এরপর ধীরে ধীরে ইঁদুর ভয় কাটিয়ে ওঠে। ছায়া দেখে আর পালিয়ে যায় না। অর্থাৎ, প্রাণীটি বুঝে গেছে, এই ছায়া তার জন্য আর হুমকি নয়। এবার বিজ্ঞানীরা জানতে চান, ইঁদুরের মস্তিষ্কের কোন অংশ ভয় দমন করতে কাজ করে!
মস্তিষ্ক যেভাবে ভয়কে নিয়ন্ত্রণ করে
মস্তিষ্কের সেরিব্রাল কর্টেক্সের হায়ার ভিজ্যুয়াল অঞ্চল ইঁদুরকে বলে দেয়, ছায়াটি বিপজ্জনক নয়। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। প্রাণীটি একবার এটা শিখে নিলে মস্তিষ্কের ভিজ্যুয়াল অংশটির কাজ শেষ হয়ে যায়। তবে এই অংশে ভয়ের স্মৃতি জমা থাকে না। এটা দেখে বিজ্ঞানীরা অবাক হয়েছেন। ভয়ের স্মৃতি জমা থাকে মস্তিষ্কের ভেনট্রোল্যাটারাল জেনিকুলেট নিউক্লিয়াস (ভিএলজিএন) নামে সাবকর্টিকাল অঞ্চলে।
আগে বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, ভয়ের স্মৃতি কেবল মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাসে জমা হয়। এই অঞ্চল শেখা ও স্মৃতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে নতুন এই গবেষণায় বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন, ভয়ের স্মৃতি সাবকর্টিকাল অঞ্চলেও জমা হতে পারে। বিষয়টি মানুষের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। তাই মানুষের ভয় নিয়ন্ত্রণেও এই আবিষ্কার কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
আমরা ভয় পেলে মস্তিষ্ক তা ধীরে ধীরে সামলে ওঠে। কিন্তু যাঁদের পিটিএসডি, ফোবিয়া বা উদ্বেগজনিত সমস্যা রয়েছে, তাদের মস্তিষ্ক ঠিকমতো ভয় নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার বা পিটিএসডির ক্ষেত্রে মস্তিষ্ক কিছু সমস্যার মুখোমুখি হয়। এ ক্ষেত্রে মস্তিষ্ক ভয় দমন করতে পারে না। ফলে ক্ষতিকর নয় এমন বস্তু বা শব্দের কারণেও মস্তিষ্ক বিপদের সংকেত পাঠায়। এই ভয়ের প্রতিক্রিয়া অতিরিক্ত মাত্রায় ছড়িয়ে পড়ে পুরো শরীরে। সহজ করে বললে, মস্তিষ্ক ট্রমাটাইজ হয়ে যায়।
সারা মেদোরেসের এই গবেষণার ফলাফল ভয়ের চিকিৎসায় নতুন পথ খুলে দিতে পারে। এই চিকিৎসা মানুষের অতিরিক্ত ভয় কমাতে সাহায্য করবে। ফলে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা সহজ হবে।