মৃত্যুর কারণ হতে পারে যে রোগগুলো
জীবনের সঙ্গে রোগব্যাধি, মৃত্যু সব সময়ই জড়িত। একটা সময়ে কলেরার প্রকোপে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যেত। কখনোবা দুর্ভিক্ষে মারা যেত অনেক মানুষ। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর জন্য দায়ী রোগে এসেছে পরিবর্তন। বিভিন্ন সংক্রামক রোগে মৃত্যুর হার যেমন আগের চেয়ে কম, তেমনি চরম দুর্ভিক্ষও কমে এসেছে। তবু থেমে নেই মৃত্যু। বর্তমানে যে রোগগুলোতে মানুষ বেশি আক্রান্ত হচ্ছে ও মারা যাচ্ছে, সেসব নিয়েই এই লেখা।
রক্ত সংবহনতন্ত্রের রোগ (৩৮%)
রক্ত সংবহনতন্ত্রের রোগে মৃত্যুর অর্ধেকই হয় স্ট্রোকের কারণে। স্ট্রোক কোনো হৃদ্রোগ নয়। কোনো কারণে মস্তিষ্কের কোনো অংশে রক্তপ্রবাহ ব্যাহত হলে বা রক্ত জমাট বেঁধে গেলে মস্তিষ্কের সেই অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন সেই অংশের কোষগুলো মারাও যেতে পারে। এটিই স্ট্রোক।
স্ট্রোকের পরেই আসে হার্ট অ্যাটাকের কথা। হার্ট অ্যাটাকেও রক্তপ্রবাহ ব্যাহত হয়, তবে তা হয় হৃৎপিণ্ডের একটা অংশে। ফলে হৃৎপিণ্ডের ওই অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাক—দুই ক্ষেত্রেই দ্রুত ব্যবস্থা নিতে না পারলে মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত।
ক্যানসার হয় বিভিন্ন জিনের মিউটেশন বা পরিব্যাপ্তির কারণে। মূলত মিউটেশনের ফলে কোষগুলো বিভাজন ক্ষমতার ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে, বিভাজিত হতে থাকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে। লাভ করে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা।
স্ট্রোক আর হার্ট অ্যাটাক, দুটি সমস্যারই উৎপত্তি রক্তবহনকারী ধমনিতে। ধূমপান, অতিরিক্ত তেলচর্বি, উচ্চ রক্তচাপ—সবই ধমনির দেয়ালের ক্ষতি করে। ধূমপানের কারণে ধমনির দেয়াল তার স্থিতিস্থাপকতা হারায়। অন্যদিকে রক্তে অতিরিক্ত চর্বি থাকলে তা ধমনির গায়ে জমা হয়ে ধমনির রাস্তা প্রায় বন্ধ করে ফেলে। ফলে ধমনিতে রক্তপ্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়। এমনকি ধমনি ফেটে গিয়ে রক্তক্ষরণও হতে পারে। যখন ক্ষতি হয় মস্তিষ্কের ধমনিতে, তখন হয় স্ট্রোক এবং হৃৎপিণ্ডেরই কোনো ধমনিতে ক্ষতি হলে হয় হার্ট অ্যাটাক।
রক্ত সংবহনতন্ত্রের রোগের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের কথা না বললেই নয়। এর কারণে অনেকের মৃত্যু হয়। পাশাপাশি এটি স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা বাড়ায়। প্রায় ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই উচ্চ রক্তচাপের কোনো নির্দিষ্ট কারণ পাওয়া যায় না। বাকি ক্ষেত্রে রক্ত সংবহনতন্ত্রের অন্যান্য সমস্যা, কিংবা কিডনির সমস্যার কারণে উচ্চ রক্তচাপ হয়ে থাকে।
কারও উচ্চ রক্তচাপ থাকলে তা নিয়ন্ত্রণে রাখা, তেলচর্বি কম—এমন স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া ও ধূমপান না করার মাধ্যমে রক্ত সংবহনতন্ত্রের রোগ থেকে বাঁচা যায়।
ক্যানসার (১২%)
দেহের কিছু অস্বাভাবিক কোষ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বিভাজিত হতে থাকাই ক্যানসার। বিভাজিত হয়ে এসব কোষ সংখ্যায় বাড়তে থাকে এবং একসময় রক্ত বা লসিকার মাধ্যমে ছড়িয়ে যায় সারা শরীরে। অর্থাৎ ক্যানসার আসলে কোনো রোগ নয়, কোষের অস্বাভাবিক ও অনিয়ন্ত্রিত বিভাজন। শতাধিক ধরনের ক্যানসার রয়েছে। দেহের যেখান থেকে অস্বাভাবিক এই কোষগুলোর উৎপত্তি, সে অনুসারে ক্যানসারের নামকরণ করা হয়। রোগের লক্ষণগুলোও অনেকাংশে তার ওপর নির্ভরশীল।
ক্যানসার হয় বিভিন্ন জিনের মিউটেশন বা পরিব্যাপ্তির কারণে। মূলত মিউটেশনের ফলে কোষগুলো বিভাজন ক্ষমতার ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে, বিভাজিত হতে থাকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে। লাভ করে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা। এই মিউটেশন হতে পারে অস্বাস্থ্যকর জীবনধারণের ফলাফল। তা ছাড়া অনেকে জন্মগতভাবেই মিউটেটেড জিনের অধিকারী হন, ফলে তাঁদের ক্যানসারের ঝুঁকি বহুলাংশে বেড়ে যায়।
হাঁপানিতে শ্বাসকষ্ট হয় রাতে বা সকালে। হাঁপানির এ শ্বাসকষ্ট মূলত একটি অ্যালার্জিক রি–অ্যাকশন। পরিবেশের কোনো উপাদান যখন ফুসফুসে সমস্যার সৃষ্টি করে, তখন এই প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। ফুসফুসে রক্তপ্রবাহ বেড়ে যায়।
সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় ফুসফুসে ক্যানসারে। এ ক্যানসারের জন্য দায়ী ফুসফুসের ক্ষতি করে, এমন রাসায়নিকগুলো। তালিকার প্রথমেই আসবে ধূমপান। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ—দুই ধরনের ধূমপানের ক্ষেত্রেই ফুসফুসে ক্যানসারের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। ধূমপান ছাড়াও অ্যাসবেস্টস, সিলিকা ও অন্যান্য রাসায়নিক নিয়ে যাঁরা সব সময় কাজ করেন, তাঁদের ক্ষেত্রেও ফুসফুসে ক্যানসারের ঝুঁকি অনেক বেশি।
এরপরেই বলতে হয় স্তন ক্যানসারের কথা। নারীদের মৃত্যুর জন্য এটিই সবচেয়ে বেশি দায়ী। BRCA1 এবং BRCA2 জিনের মিউটেশনের কারণে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বেড়ে যায়। অনেকে জন্মগতভাবে এই মিউটেটেড জিন বহন করেন, যা তাঁরা সাধারণত পান তাঁর মায়ের কাছ থেকে। নিয়মিত স্তন ক্যানসারের স্ক্রিনিংয়ে থাকা তাঁদের জন্য জরুরি। এ ছাড়া স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হলে ম্যাস্টেকটমি বা স্তন কেটে ফেলার মতো অপারেশনও করতে হয় অনেক ক্ষেত্রে।
এ ছাড়া পাকস্থলীর ক্যানসার, নারীদের ক্ষেত্রে সার্ভিক্যাল ক্যানসার, পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রস্টেট ক্যানসার হতে পারে মৃত্যুর কারণ।
ক্যানসার শুরুতেই ধরা পড়লে সম্পূর্ণ নিরাময় করা সহজ হয়ে যায়। কিন্তু যদি তা সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে, তবে চিকিৎসা হয়ে ওঠে কঠিন। তাই ক্যানসার প্রতিরোধে প্রয়োজন স্বাস্থ্যকর জীবনধারণ এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে স্ক্রিনিং টেস্ট করানো। এ ছাড়া কিছু ক্যানসারের টিকা আছে, যা ক্যানসার প্রতিরোধ করতে পারে।
শ্বসনতন্ত্রের দীর্ঘস্থায়ী রোগ (৮%)
শ্বসনতন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো ফুসফুস। ফুসফুসের ভেতর থাকে বেলুনের মতো অ্যালভিওলাস, যা প্রতিবার শ্বাস নেওয়ার সময় ফুলে ওঠে এবং অক্সিজেন ও কার্বন ডাই-অক্সাইড আদান–প্রদান করে। অক্সিজেন ও কার্বন ডাই-অক্সাইড ফুসফুসে প্রবেশ করায় ও বের করে নেয় শ্বাসনালি। সুস্থ থাকার জন্য ফুসফুসের এই কাজগুলো ঠিকভাবে হওয়া জরুরি।
শ্বসনতন্ত্রের দীর্ঘস্থায়ী রোগগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সিওপিডি (ক্রনিক অবসট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ) আর হাঁপানি। সিওপিডি রোগটিতে পরিবেশের বিভিন্ন দূষণ কিংবা ধূমপানের কারণে অ্যালভিওলাসের ক্ষতি হয়, তখন অ্যালভিওলাস প্রয়োজনমতো ফুলে উঠতে পারে না, আবার চুপসেও যেতে পারে না। ফলে ফুসফুসের কাজ ব্যাহত হয়। রোগীর ঘন ঘন কাশি, শ্বাসকষ্ট, কফ বের হওয়ার মতো লক্ষণ দেখা দেয়। এ লক্ষণগুলো বাড়ে কোনো ভারী কাজ করার সময়। কারণ, তখন দেহে অক্সিজেনের প্রয়োজনীয়তা বেড়ে যায়। ফলে ফুসফুস বেশি পরিমাণে অক্সিজেন গ্রহণ করতে চায়। কিন্তু সিওপিডির কারণে তা সম্ভব হয় না।
সন্তান জন্মদানের পর জরায়ু থেকে অমরা বা প্লাসেন্টা বিচ্ছিন্ন হয়ে বেরিয়ে আসে, কিন্তু জরায়ুতে প্লাসেন্টার আকারের একটি ক্ষত রেখে আসে। প্রসবের পর জরায়ু কোনো কারণে দ্রুত সংকুচিত না হলে সেই ক্ষত থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়।
অন্যদিকে হাঁপানিতে শ্বাসকষ্ট হয় রাতে বা সকালে। হাঁপানির এ শ্বাসকষ্ট মূলত একটি অ্যালার্জিক রি–অ্যাকশন। পরিবেশের কোনো উপাদান যখন ফুসফুসে সমস্যার সৃষ্টি করে, তখন এই প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। ফুসফুসে রক্তপ্রবাহ বেড়ে যায়। ফলে অ্যালভিওলাসে পানি জমে, আবার শ্বাসনালিও সংকুচিত হয়ে আসে। ফলে শুরু হয় শ্বাসকষ্ট।
সিওপিডি ও হাঁপানি—দুই ক্ষেত্রেই দায়ী বায়ুদূষণ ও ধূমপান। এ ছাড়া হাঁপানি জন্মগতও হতে পারে। এ রোগগুলোর নিরাময় নেই, তবে চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ ব্যবহার করে, ধূমপান ও অন্যান্য বায়ুদূষণ থেকে দূরে থেকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
শ্বসনতন্ত্রের সংক্রামক রোগ (৮%)
শ্বসনতন্ত্রের সংক্রামক রোগের মধ্যে প্রধান দুটি হলো নিউমোনিয়া ও যক্ষ্মা। নিউমোনিয়া বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, এমনকি ছত্রাক দিয়েও হতে পারে। বর্তমান মহামারি কোভিডের সমস্যাগুলোর একটিও এই নিউমোনিয়া। ফুসফুসের এই সংক্রামক রোগ যেকোনো বয়সের মানুষের দেহে মৃদু থেকে শুরু করে মারাত্মক রোগ পর্যন্ত সৃষ্টি করতে পারে। মূলত এ ক্ষেত্রে সংক্রমণ হয় ফুসফুসের অ্যালভিওলাসে। সংক্রমণ প্রতিরোধে দেহের রক্তের শ্বেতকণিকা সেখানে এসে জমা হয়। শ্বেতকণিকা মারা গিয়ে জমা হতে থাকে পুঁজ। ফলে স্বভাবতই অ্যালভিওলাসের অক্সিজেন ও কার্বন ডাই-অক্সাইড আদান–প্রদান ক্ষমতা কমে যায়, শুরু হয় শ্বাসকষ্ট। নিয়মিত হাত ধোয়া, পরিবেশ পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন রাখা, মাস্ক ব্যবহার করার মাধ্যমে এ রোগ প্রতিরোধ সম্ভব। আর অসুস্থ হলে তাড়াতাড়ি চিকিৎসা গ্রহণ করার মাধ্যমে এ রোগে মৃত্যু ঠেকানো যায়।
যক্ষ্মা শুধু ফুসফুসের রোগ নয়, এটি দেহের অন্যান্য অংশেও হতে পারে। তবে শুধু ফুসফুসের যক্ষ্মাই সংক্রামক। যক্ষ্মা রোগের ব্যাকটেরিয়াকে শ্বেত রক্তকণিকা খেয়ে ফেলতে চেষ্টা করলে ব্যাকটেরিয়া শ্বেতকণিকার ভেতরেই বেঁচে থাকে। ব্যাকটেরিয়াকে দমন করতে আসা অন্যান্য শ্বেতকণিকা তখন এর বাইরে একটা আবরণ সৃষ্টি করে। ব্যাকটেরিয়া যেমন এ আবরণের ভেতরে লুকানো থাকে, তেমনি আবরণ ভেদ করে ওষুধও সহজে ঢুকতে পারে না। একসময় এ আবরণ ভেদ করে ব্যাকটেরিয়া বেরিয়ে আসে ও বংশবৃদ্ধি করতে শুরু করে। যক্ষ্মা যদি ফুসফুসে হয়, তবে রোগীর বহুদিন ধরে কাশি হয়। কফের সঙ্গে ব্যাকটেরিয়া বেরিয়ে এসে পরিবেশে ছড়ায়।
একসময় যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হলে আর কোনো উপায় ছিল না, রোগীকে ধুঁকে ধুঁকে মরতে হতো। অথচ এখন যক্ষ্মার চিকিৎসা বেশ সহজলভ্য। কিন্তু সমস্যা হলো, যক্ষ্মার ওষুধ মাসের পর মাস ধরে নিয়মিত খেতে হয়। আর এ ওষুধগুলো শরীরকে একটু দুর্বলও করে দেয়। তাই অনেকেই যক্ষ্মার ওষুধ প্রয়োজনীয় পুরো সময় ধরে গ্রহণ করেন না। মানে, ডোজ সম্পূর্ণ করেন না। তখন যক্ষ্মার ব্যাকটেরিয়া আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তার বিরুদ্ধে আর আগের ওষুধগুলো কাজ করে না। তখন চিকিৎসা হয়ে ওঠে ব্যয়বহুল এবং কঠিন। তাই যক্ষ্মার ওষুধ নিয়মিত ও পুরো সময় ধরে গ্রহণ করে এ রোগে মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব।
নবজাতক ও মাতৃমৃত্যু (৬%)
নবজাতক বলতে বোঝায় ০-২৮ দিন বয়সী শিশুদের। এদের মৃত্যুর কারণ হতে পারে মস্তিষ্কে আঘাত, নির্ধারিত সময়ের আগেই, অর্থাৎ অপরিণত অবস্থায় জন্মগ্রহণ, জন্ডিস, ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ইত্যাদি। নবজাতকের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হতে পারে জন্মের সময় মা থেকে, কিংবা পরিষ্কার ধারালো যন্ত্র দিয়ে নাড়ি না কাটলে, কিংবা জন্মের পরপর নবজাতকের পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতার দিকে নজর না দিলে। তাই নবজাতকের সুরক্ষায় মায়ের সুস্থতা নিশ্চিত করা যে রকম প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন প্রসবকালীন পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা।
দেহের বিভিন্ন বিষাক্ত পদার্থের রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটিয়ে দেহ থেকে বের করে দেওয়ার উপযোগী করে তোলা, রক্তের গ্লুকোজকে গ্লাইকোজেন হিসেবে সংরক্ষিত রাখা, দেহের নাইট্রোজেনঘটিত বর্জ্য পদার্থকে ইউরিয়ায় পরিণত করা, সব কটিই করে যকৃৎ।
অন্যদিকে মাতৃমৃত্যু বলতে বোঝায় গর্ভাবস্থায়, কিংবা বাচ্চার জন্মের ৪২ দিনের মধ্যে গর্ভধারণসংক্রান্ত জটিলতায় মায়ের মৃত্যু। মাতৃমৃত্যুর অন্যতম কারণ সন্তান জন্মদানকালে জটিলতায় রক্তক্ষরণ। সন্তান জন্মদানের পর জরায়ু থেকে অমরা বা প্লাসেন্টা বিচ্ছিন্ন হয়ে বেরিয়ে আসে, কিন্তু জরায়ুতে প্লাসেন্টার আকারের একটি ক্ষত রেখে আসে। প্রসবের পর জরায়ু কোনো কারণে দ্রুত সংকুচিত না হলে সেই ক্ষত থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। তা ছাড়া সেই ক্ষত দিয়ে বিভিন্ন জীবাণু প্রবেশ করে পরবর্তী সময়ে মায়ের জীবন বিপন্ন করে তুলতে পারে। এ ছাড়া গর্ভাবস্থায় নানা জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে, যা অভিজ্ঞ কেউ সমাধান না করলে মা ও শিশু দুজনের জন্যই মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে পারে।
বর্তমানে গর্ভকালে মায়ের চেকআপ, প্রসবকালে অভিজ্ঞ ধাত্রীর সহায়তা, প্রসবের পর নবজাতক ও মায়ের চেকআপ এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকায় দেশে নবজাতক ও মাতৃমৃত্যুর হার অনেক কমে এসেছে।
ডায়াবেটিস ও কিডনি রোগ (৫%)
ডায়াবেটিস একটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির অগ্ন্যাশয় যথেষ্ট পরিমাণ ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না অথবা তাঁর দেহ এ ইনসুলিন ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারে না। ইনসুলিনের অভাবে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়। এর ফলে সৃষ্টি হয় হৃদ্রোগ, কিডনির রোগ, স্নায়বিক সমস্যা, অন্ধত্বসহ স্বাস্থ্যগত নানা জটিলতা। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ অতিরিক্ত বেড়ে গিয়ে, বিপাকক্রিয়ায় নানা সমস্যা ঘটিয়ে শেষে হতে পারে মৃত্যু। ডায়াবেটিস প্রতিরোধে স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন এবং নিয়ন্ত্রণে চিকিৎসকের পরামর্শমতো ওষুধ বা ইনসুলিন গ্রহণ করতে হবে। ডায়াবেটিস–সংক্রান্ত জটিলতার একটি বিশেষ দিক হচ্ছে, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগী তাঁর রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে গ্লুকোজ–স্বল্পতায় পড়ে যান। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিকে অবশ্যই এ বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। নাহয় রক্তে গ্লুকোজের স্বল্পতার কারণে মস্তিষ্কেও গ্লুকোজ–স্বল্পতা দেখা দেবে, যার ফল হলো মৃত্যু।
দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ ডায়াবেটিসের ফলে হওয়া স্বাস্থ্যগত সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি। এ ছাড়া উচ্চ রক্তচাপ ও রক্ত সংবহনতন্ত্রের অন্যান্য রোগ থাকলেও এতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। কিডনির কাজ হচ্ছে দেহের রক্ত ছেঁকে তা থেকে বিষাক্ত পদার্থ, অতিরিক্ত পানি ও খনিজ লবণ বের করে দেওয়া। আবার দেহের প্রয়োজনে কিডনি পানি বা খনিজ লবণ ধরে রাখতে পারে। এ ছাড়া কিডনি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণেও কাজ করে। কিডনির এই বিশাল কর্মযজ্ঞে সহায়তা করে কিডনির প্রতিটি নেফ্রনে থাকা কৈশিক জালিকা। দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে এই সূক্ষ্ম রক্তবাহিকাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ফলে কিডনি তার কাজ ভালোভাবে করতে পারে না। একপর্যায়ে বিকল হয়ে পড়ে। দুটি কিডনিই বিকল হয়ে গেলে রোগীকে বাঁচিয়ে রাখা কঠিন হয়ে যায়। তখন প্রতি সপ্তাহে ব্যয়বহুল ডায়ালাইসিস করতে হয়, অথবা কিডনি প্রতিস্থাপন করতে হয়। কিডনির রোগ প্রতিরোধে ডায়াবেটিস বা রক্ত সংবহনতন্ত্রের রোগ প্রতিরোধ করতে হবে বা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
পরিপাকতন্ত্রের দীর্ঘস্থায়ী রোগ (৫%)
এর মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতী হচ্ছে যকৃতের দীর্ঘস্থায়ী রোগ, যেমন লিভার সিরোসিস। যকৃতের রোগে আক্রান্ত হওয়ার পেছনে দায়ী অস্বাস্থ্যকর খাবার, মদ্যপান, রক্তে অতিরিক্ত কোলেস্টেরল ও কিছু ওষুধ। এসব উপাদান যকৃতের রক্তনালিকা এবং যকৃৎ কোষের ক্ষতি করে। এতে যকৃতে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। রোগ যত বৃদ্ধি পায়, যকৃতে ক্ষতের পরিমাণও তত বাড়ে। তখন যকৃৎ আর আগের মতো কাজ করতে পারে না।
যকৃৎ দেহের গুরুত্বপূর্ণ বিপাকীয় কাজগুলো করে। দেহের বিভিন্ন বিষাক্ত পদার্থের রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটিয়ে দেহ থেকে বের করে দেওয়ার উপযোগী করে তোলা, রক্তের গ্লুকোজকে গ্লাইকোজেন হিসেবে সংরক্ষিত রাখা, দেহের নাইট্রোজেনঘটিত বর্জ্য পদার্থকে ইউরিয়ায় পরিণত করা, সব কটিই করে যকৃৎ। তাই লিভার সিরোসিসে যকৃৎ তার কাজগুলো ঠিকমতো করতে না পারলে দেহের অনেক বিপাকীয় কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি দ্রুতই মৃত্যুর সম্মুখীন হন।
অন্যদিকে টাইফয়েডের ক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়া অন্ত্রে ক্ষতের সৃষ্টি করে। এর ফলে ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য, যেকোনোটি হতে পারে। এ ছাড়া দুর্বলতা, পেটে ব্যথা, ক্ষুধামান্দ্যসহ বিভিন্ন লক্ষণ দেখা দেয়।
পানিবাহিত রোগ (৫%)
ডায়রিয়া ও টাইফয়েড দুটি প্রাণঘাতী পানিবাহিত রোগ। ডায়রিয়ায় মৃত্যুর মূল কারণ দেহ থেকে পানি বেরিয়ে গিয়ে প্রচণ্ড পানিশূন্যতা তৈরি হওয়া। তাই ডায়রিয়ায় মূল চিকিৎসা হলো পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি এবং খনিজ লবণ খাওয়ানো। কারণ, ডায়রিয়ায় পানির সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে লবণও বেরিয়ে যায়। বাংলাদেশে ঘরোয়া খাওয়ার স্যালাইনের প্রচলন থাকায় ডায়রিয়ায় মৃত্যুর হার অনেক কমে এসেছে।
অন্যদিকে টাইফয়েডের ক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়া অন্ত্রে ক্ষতের সৃষ্টি করে। এর ফলে ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য, যেকোনোটি হতে পারে। এ ছাড়া দুর্বলতা, পেটে ব্যথা, ক্ষুধামান্দ্যসহ বিভিন্ন লক্ষণ দেখা দেয়। টাইফয়েডের দ্রুত চিকিৎসা না হলে অন্ত্রের ক্ষত থেকে প্রথমে রক্তক্ষরণ এবং পরবর্তী সময়ে অন্ত্রে ছিদ্র হয়ে পুরো পেটে ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে যেতে পারে, ফলে হতে পারে মৃত্যু।
এ রোগগুলো মূলত দূষিত পানির মাধ্যমে ছড়ায়। তাই পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন থাকা, পানি ফুটিয়ে পান করা, রান্না বা থালাবাসন ধোয়ার কাজেও বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করে এ রোগগুলো প্রতিরোধ করা সম্ভব। এ ছাড়া দুটি রোগেরই এখন টিকা রয়েছে। ডায়রিয়া বা টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে গেলে অবশ্যই দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। এ রোগগুলোতে মৃত্যুর অন্যতম কারণ দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণ না করা।
অন্যান্য (১৩%)
মৃত্যুর অন্যান্য কারণের মধ্যে আছে স্নায়বিক রোগ, দুর্ঘটনা, পুষ্টির অভাব, এইডস, মানসিক রোগ ও অন্যান্য সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ।