প্রতিদিন কয় পা হাঁটলে হৃদরোগসহ ৬টি ভয়ানক রোগের ঝুঁকি কমে
হৃদরোগ, হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া, এমনকি ডিমেনশিয়ার মতো রোগেরও ঝুঁকি কমে এই একটি কাজ করলেই! এমন কোনো মহার্ঘ্য বা সর্বরোগের ওষুধ নয়, কোনো জাদুও নয়। গবেষকেরা দেখিয়েছেন, নিয়ম করে সকালে হাঁটলেই হবে, মুক্তি মিলতে পারে এসব ভয়ংকর রোগের হাত থেকে। কিন্তু কতটা হাঁটবেন? প্রতিদিন কয় পা হাঁটলে এসব রোগের ঝুঁকি কমে?
সুস্থ থাকার জন্য প্রতিদিন হাঁটা দরকার। কতটা হাঁটবেন? হয়তো শুনেছেন, সুস্বাস্থ্যের জন্য দিনে ১০ হাজার স্টেপ বা কদম হাঁটা জরুরি। কিন্তু এই সংখ্যাটা কি সত্যিই বিজ্ঞানসম্মত, নাকি নিছকই প্রচলিত ধারণা?
১০ হাজার কদম হাঁটার একটা কথা বেশ প্রচলিত। গুগল করলেও হয়তো পাবেন এ তথ্য। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলছেন, সংখ্যাটা স্টেপ কাউন্টার বা পেডোমিটার, অর্থাৎ কয় পা হাঁটলেন, তা মাপার যন্ত্র বিক্রির একটা কৌশল। প্রচলিত এই ধারণা কোনো বৈজ্ঞানিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ছড়ায়নি। তাহলে কতটা হাঁটবেন?
যুক্তরাজ্যভিত্তিক খ্যাতনামা ল্যানসেট পাবলিক হেলথ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে এ বিষয়ে একটি গবেষণা। সুস্থ থাকতে প্রতিদিন ঠিক কয় পা হাঁটা প্রয়োজন, তা এই গবেষণাপত্রে দেখানো হয়েছে। বিজ্ঞানীদের মতে, রোগ প্রতিরোধের জন্য প্রতিদিন ১০ হাজার কদম হাঁটা বাধ্যতামূলক নয়। এই গবেষণা গত দশকের হাঁটাহাটি ও স্বাস্থ্যের ওপর যত গবেষণা হয়েছে, সেগুলোকে আরও পর্যবেক্ষণ এবং পর্যালোচনা করে প্রকাশ করা হয়েছে।
৭ হাজার কদম হাঁটলে মৃত্যুহার প্রায় অর্ধেক কমে—অন্তত ডেটা তা-ই বলছে। এ ছাড়াও বিষণ্ণতা ও টাইপ ২ ডায়াবেটিসের মতো রোগের ঝুঁকিও কিছুটা কমে। যদিও অন্য রোগের ঝুঁকির মতো অত বেশি কমে না।
গবেষকদের মতে, দিনে মাত্র ৭ হাজার পা হাঁটলেই অন্তত ছয়টি ভয়ংকর রোগের ঝুঁকি কমে। এমনকি কমে অকাল মৃত্যুর আশঙ্কাও। অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য ও নরওয়ের বিজ্ঞানীরা প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ওপর কয়েক ডজন গবেষণা করেছেন। সেসব গবেষণার তথ্য বিশ্লেষণ করে এই তথ্য পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
হয়তো ভাবছেন, মাত্র ৭ হাজার পা হাঁটার কী এমন প্রভাব পড়ে শরীরে? গবেষণা বলছে, যাঁরা প্রতিদিন মাত্র ২ হাজার পা হাঁটেন, তাঁরা যদি তা বাড়িয়ে ৭ হাজারে নিয়ে যান, তাহলে স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া ডিমেনশিয়া রোগের ঝুঁকি কমে প্রায় ৩৮ শতাংশ। অর্থাৎ, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিশক্তি হারানোর ভয় অনেকটা কমে যায়।
হৃদরোগের ঝুঁকিও কমে ২৫ শতাংশ। পাশাপাশি হঠাৎ পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি কমে ২৮ শতাংশ। বিশেষ করে বয়স্কদের জন্য এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, পড়ে যাওয়া থেকে গুরুতর আঘাত লাগতে পারে।
সবচেয়ে বড় বিষয়, ৭ হাজার কদম হাঁটলে মৃত্যুহার প্রায় অর্ধেক কমে—অন্তত ডেটা তা-ই বলছে। এ ছাড়াও বিষণ্ণতা ও টাইপ ২ ডায়াবেটিসের মতো রোগের ঝুঁকিও কিছুটা কমে। যদিও অন্য রোগের ঝুঁকির মতো অত বেশি কমে না।
নিয়মিত হাঁটাচলার মতো শারীরিক পরিশ্রম স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। কিন্তু এবারই প্রথম গবেষকেরা দেখিয়েছেন, ঠিক কয় পা হাঁটলে বিভিন্ন রোগ থেকে বাঁচা যায়। অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব সিডনির পাবলিক হেলথের গবেষক এবং এই গবেষণাপত্রের প্রধান লেখক মেলোডি ডিং জানান, ‘প্রায় সবার কাছেই এখন কদম গোনার যন্ত্র আছে। কেউ চাইলেই দেখতে পারেন, কতটুকু হেঁটেছেন আর কতটা হাঁটতে হবে। এখন তাঁরা দিনে ৭ হাজার কদম হাঁটার লক্ষ্য পূরণ করে নিজেদের নিয়ে আত্মবিশ্বাসী হতে পারবেন।’
গবেষকেরা মোট ৩৫টি দলের ৫৭টি গবেষণার ফলাফল খুব ভালোভাবে দেখেছেন। এই গবেষণাগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং আরও অনেক দেশের মানুষ অংশ নিয়েছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের ডার্টমাউথ কলেজের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ মাইকেল রোচা বলেছেন, ‘গবেষণাটা সত্যিই দারুণ। কারণ, এটা প্রমাণ করে যে প্রতিদিন প্রায় ৭ হাজার কদম হাঁটলে স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়। রোগীদের আমরা এখন পরামর্শ দিই, সুস্থ জীবনের জন্য প্রতিদিন ১০ হাজার কদম হাঁটার দরকার নেই, ৭ হাজার কদম হাঁটলেই চলবে।’
গবেষকদের মতে, ২০২০ সাল পর্যন্তও বিজ্ঞানীরা মানুষের জন্য প্রতিদিন হাঁটার কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা ঠিক করতে পারেননি। কারণ, তাঁদের কাছে যথেষ্ট ডেটা ছিল না। এ কারণেই ১০ হাজার কদম হাঁটার ধারণাটা স্থায়ী হয়ে গিয়েছিল। যদিও অনেকেই এটা পূরণ করতে পারতেন না। তবে, গত দশকে অনেক নতুন গবেষণা হওয়ায় এখন যথেষ্ট ডেটা পাওয়া গেছে। এই তথ্যগুলো দিয়ে হাঁটার একটি কার্যকর সংখ্যা জানা সম্ভব হয়েছে। ২০২৩ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র ২ হাজার ৮০০ কদম হাঁটলেই হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকটা কমে যায়। আর প্রতিদিন ৭ হাজার ২০০ কদম হাঁটলে উপকার পাওয়া যায় সবচেয়ে বেশি।
গবেষকদের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ১০ হাজার কদম হাঁটলে ক্যান্সারজনিত মৃত্যু, ডিমেনশিয়া এবং বিষণ্ণতার মতো কিছু রোগের ঝুঁকি আরও কমে। তবে ৭ হাজার কদম হাঁটার পর থেকে এর বাড়তি উপকার খুব বেশি দেখা যায় না। টাইপ ২ ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য বেশির ভাগ স্বাস্থ্য সমস্যার ক্ষেত্রে ৭ হাজার কদমের পর অতিরিক্ত আরও ৩ হাজার কদম হাঁটলে, অর্থাৎ মোট ১০ হাজার কদম হাঁটলে তেমন কোনো বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায় না। তবু গবেষণায় বলা হয়েছে, ‘যাঁরা আরও বেশি সক্রিয় থাকতে চান, তাঁদের জন্য ১০ হাজার কদম হাঁটা একটি ভালো লক্ষ্য হতে পারে।’
২০২০ সাল পর্যন্তও বিজ্ঞানীরা মানুষের জন্য প্রতিদিন হাঁটার কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা ঠিক করতে পারেননি। কারণ, তাঁদের কাছে যথেষ্ট ডেটা ছিল না। এ কারণেই ১০ হাজার কদম হাঁটার ধারণাটা স্থায়ী হয়ে গিয়েছিল।
গবেষকেরা মোট ৩৫টি দলের ৫৭টি গবেষণার ফলাফল খুব ভালোভাবে দেখেছেন। এই গবেষণাগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং আরও অনেক দেশের মানুষ অংশ নিয়েছিলেন। কিছু গবেষণায় বয়স্ক ব্যক্তিরা বা যাঁরা আগে থেকেই কোনো দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভুগছিলেন, তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে বেশির ভাগ গবেষণা চালানো হয়েছিল সুস্থ তরুণ ও প্রাপ্তবয়স্কদের ওপর। গবেষকেরা জানান, হাঁটার গতিও স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে। কিন্তু তাঁরা এর সঠিক প্রভাব বা আদর্শ গতি কী হওয়া উচিত, তা পরিষ্কারভাবে বলতে পারেননি।
যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল স্কুল অব মেডিসিনের স্নায়ু-মনোবিজ্ঞানী স্টেফানি টাউনস বলেন, ‘ডিমেনশিয়া প্রতিরোধ করার সবচেয়ে কার্যকর উপায়গুলোর একটি হলো হাঁটা। কারণ, হাঁটলে মস্তিষ্কে অক্সিজেন ও পুষ্টির সরবরাহ বাড়ে। পাশাপাশি কমে উচ্চ রক্তচাপের মতো রোগের ঝুঁকি।’