ল্যাজারাস সিনড্রোম: যেভাবে ক্লিনিক্যালি ডেড ঘোষণার পরেও ফিরে আসতে পারে মানুষ
ভোরবেলা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেন শাহিনুর বেগম নামে এক নারী। জন্মের পরেই নবজাতকটিকে মৃত ঘোষণা করেন দায়িত্বরত চিকিৎসক। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয়, ক্লিনিক্যালি ডেড। এখানেই হয়তো ঘটনা শেষ হতে পারত। কিন্তু তা হয়নি। শিশুটির বাবা ইয়াসিন মোল্লা। তিনি সন্তানকে মৃত ভেবে দাফন করতে নিয়ে যান কবরস্থানে। আর সেখানেই ঘটে অপ্রত্যাশিত এক ঘটনা। দাফনের আগেই নড়ে ওঠে শিশুটি। বিবিসি বাংলার ২০২০ সালের ১৬ অক্টোবরের খবর এটা।
এবার আরেকটি ঘটনা শুনুন। ২০১৫ সালের অক্টোবরে প্রথম আলোয় খবরটি প্রকাশিত হয়। সেই প্রতিবেদনে লেখা ছিল, গত রোববার ভারতের মুম্বাইয়ের লোকমান্য তিলক মিউনিসিপ্যাল জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আসা হয় প্রকাশ নামে এক ব্যক্তিকে। সেখানকার জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এরপর মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হয় লাশ কাটা ঘরে। কিন্তু ময়নাতদন্তের আগ মুহূর্তে জেগে ওঠেন প্রকাশ।
ওপরে যে দুটি ঘটনার কথা বললাম, তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও এগুলো সত্যি। পৃথিবীতে এ ধরনের ঘটনা খুব কমই ঘটে। বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় ল্যাজারাস সিনড্রোম। কী এই সিনড্রোম? এ ব্যাপারে বিজ্ঞান কী বলে? চলুন, জেনে নিই।
প্রথমে জানা যাক, ল্যাজারাস সিনড্রোম নামটি কোথা থেকে এল। খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় গ্রন্থ বাইবেলে বর্ণিত ল্যাজারাস নামে এক ব্যক্তির মৃত থেকে জীবিত হওয়ার কাহিনি থেকে এই নামের উদ্ভব। এই গ্রন্থ অনুসারে, ল্যাজারাসকে তার মৃত্যুর চার দিন পর জীবিত করেছিলেন যিশু। সেখান থেকেই এ ধরনের ঘটনাকে বলা হয় ল্যাজারাস সিনড্রোম।
আঠারো শতকের দিকে জীবন্ত কবরস্থ হয়ে যাওয়ার ভয় ছিল মানুষের মধ্যে। আর সে জন্যই অনেকে মৃত্যুর আগে করা উইলে উল্লেখ করতেন, দাফন করার আগে যেন পরীক্ষার মাধ্যমে তাঁদের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে ১৯৮২ সালে প্রথম এ ধরনের ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। এরপর ১৯৯৩ সালে এই ঘটনাগুলোকে ‘ল্যাজারাস সিনড্রোম’ হিসেবে নামকরণ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ-এর তথ্য অনুযায়ী, কার্ডিওপালমোনারি রিসাসিটেশন দেওয়ার পর স্বতঃস্ফূর্তভাবে দেহের রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া ফিরে আসাকে ল্যাজারাস সিনড্রোম বলে।
জার্নাল অব দ্য রয়্যাল সোসাইটি অব মেডিসিন-এর মতো বিভিন্ন মেডিকেল জার্নালের তথ্য অনুসারে, বিশ্বজুড়ে এখন পর্যন্ত এমন অনেক ঘটনা নথিবদ্ধ হয়েছে। বিভিন্ন গবেষণাপত্রে এই সংখ্যার ভিন্নতা থাকলেও কিছু পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২২ সাল পর্যন্ত বিশ্বে ৭৬টির মতো ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। এর মধ্যে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রেই ঘটেছে প্রায় ৩৮টি। তবে গবেষকদের মতে, এ ধরনের অনেক ঘটনাই নথিবদ্ধ হয়নি।
মেডিকেল জার্নালে উল্লিখিত এমন ৩৮টি ঘটনার এক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৭ জন বাদে বাকিদের গড়ে ২৭ মিনিট ধরে সিপিআর দেওয়া হয়েছিল। জেগে ওঠার পর ১৭ জনই আবার মারা যায়। বাকি ২১ জনকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়, যাদের মধ্যে ৩ জন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান এবং ১৪ জন চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন। অন্য ৪ রোগীর ক্ষেত্রে তেমন কোনো তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।
আঠারো শতকের দিকে জীবন্ত কবরস্থ হয়ে যাওয়ার ভয় ছিল মানুষের মধ্যে। আর সে জন্যই অনেকে মৃত্যুর আগে করা উইলে উল্লেখ করতেন, দাফন করার আগে যেন পরীক্ষার মাধ্যমে তাঁদের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। জীবন্ত দাফন হয়ে যাওয়ার এই ভয়কে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় টাফোফোবিয়া।
১৯৭৯ সালে যুক্তরাজ্যের মেডিকেল রয়্যাল কলেজের একটি কনফারেন্সের পর দেওয়া স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়, মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার শারীরিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে হৃৎস্পন্দন এবং শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া। তাই সিপিআর দেওয়া বন্ধ করা এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে হৃদযন্ত্র চালু হওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে কাউকে মৃত বলে ঘোষণা করা হতেই পারে।
ল্যাজারাস সিনড্রোম কেন হয়, সে বিষয়ে এখনো তেমন কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। তবে ১৯৮২-২০২২ সাল পর্যন্ত রিপোর্ট করা ৭৬টি কেস পর্যালোচনা করে কয়েকটি সম্ভাব্য কারণ বা লক্ষণ চিহ্নিত করা হয়েছে। যেমন কোনো কোনো রোগীকে জরুরি অবস্থায় হাসপাতালে আনার পর সিপিআর দেওয়া হয়। সিপিআর থামানোর পর তাৎক্ষণিকভাবে রোগীকে মৃত মনে হলেও কিছুক্ষণ পর তার হৃৎপিণ্ডের বৈদ্যুতিক কার্যকলাপ ও রক্ত সঞ্চালন পুনরায় চালু হয়ে ব্যক্তিটি জেগে উঠতে পারে। যখন সিপিআর দেওয়া হয়, তখন ফুসফুসে অতিরিক্ত বাতাস জমে চাপ সৃষ্টি করতে পারে। সিপিআর দেওয়া বন্ধ করলে সেই বাতাস ধীরে ধীরে বের হয়ে যায়। ফলে হৃৎপিণ্ডে রক্ত সঞ্চালন পুনরায় শুরু হতে পারে।
বাড়িতে মৃত্যুর চেয়ে হাসপাতালে মৃত ঘোষিত রোগীদের ক্ষেত্রে ল্যাজারাস সিনড্রোম হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ, মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে রোগীকে সিপিআর বা ইনজেকশন দেওয়া হয়।
এ ছাড়াও জরুরি অবস্থায় রোগীকে অ্যাড্রেনালিনের মতো যে ইনজেকশন দেওয়া হয়, সেটি হয়তো তাৎক্ষণিকভাবে কাজ করে না। কিছুক্ষণ পর সেই ওষুধের কার্যকারিতা শুরু হলে হৃদযন্ত্র পুনরায় চালু হতে পারে এবং ব্যক্তির জ্ঞান ফিরে আসতে পারে। এ ছাড়া স্বতঃস্ফূর্তভাবে হৃদযন্ত্র পুনরায় চালু হওয়ার পেছনে আরও কিছু কারণকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়।
মেডিকেল তথ্যমতে, বাড়িতে মৃত্যুর চেয়ে হাসপাতালে মৃত ঘোষিত রোগীদের ক্ষেত্রে ল্যাজারাস সিনড্রোম হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ, মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে রোগীকে সিপিআর বা ইনজেকশন দেওয়া হয়।
নিউইয়র্কের স্টোনি ব্রুক ইউনিভার্সিটির রিসাসিটেশন রিসার্চ বিভাগের পরিচালক স্যাম পারনিয়া বলেছেন, ‘মৃত্যুর কিছুক্ষণ পরের সময়টা এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এখন জানি, অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা মৃত ঘোষিত হওয়ার তিন, চার বা পাঁচ ঘণ্টা পরেও ফিরে এসেছেন এবং স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন।’
এ জন্য চিকিৎসকদের নির্দেশনা দেওয়া থাকে, কাউকে সিপিআর বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে মৃত ঘোষণা না করে ধাপে ধাপে মৃত্যুর সব উপসর্গ নিশ্চিত হয়ে তারপর মৃত ঘোষণা করা উচিৎ। আর এ জন্য চিকিৎসাবিজ্ঞানে সিপিআর থামানোর পর অন্তত ১০ মিনিট অপেক্ষা করার কথা বলা হয়।
সবশেষে একটা চমৎকার ঘটনা দিয়ে শেষ করি। একজন চিকিৎসক ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাফিতে কোনো সাড়া না পাওয়ায় ৪৪ বছর বয়সী এক মহিলাকে মৃত ঘোষণা করেন। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে মৃত্যুর ৬ মিনিট পর তিনি মনিটরে হালকা হার্টবিটের শব্দ শুনতে পান। ব্যাপারটা এমন ছিল, যেন রোগী নিজেকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি চূড়ান্তভাবে মারা যান।
এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক অবাক হন এবং এটিকে একটি ‘অসম্পূর্ণ ল্যাজারাস সিনড্রোম’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।