বিশ্বের প্রথম টেস্টটিউব বেবি লুইস ব্রাউন আজও কেন প্রাসঙ্গিক
গল্পটা ইংল্যান্ডের ব্রিস্টল শহরের লেসলি ও জন ব্রাউন দম্পতির। ষাটের দশকে একে অপরকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেওয়া এই দম্পতি প্রায় দশ বছর ধরে নিঃসন্তান ছিলেন। সাধ্যের মধ্যে সম্ভব সব ধরনের চিকিৎসা শেষে ১৯৭৭ সালের নভেম্বরে লেসলি ব্রাউন জানতে পারলেন, তাঁর ফ্যালোপিয়ান টিউব ব্লক থাকার কারণে স্বাভাবিকভাবে তিনি মা হতে পারবেন না। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল এই নিঃসন্তান দম্পতির। তবু একটি মিরাকলের আশায় বিভিন্ন হাসপাতালে ধরনা দিতে লাগলেন তাঁরা।
অবশেষে ব্রিস্টলের একজন ডাক্তার লেসলি ব্রাউনকে ওল্ডহ্যামের একটি ক্লিনিকে পাঠালেন। ওই ক্লিনিকে গাইনোকোলজিস্ট প্যাট্রিক স্টেপটো, ফিজিওলজিস্ট রবার্ট এডওয়ার্ডস এবং নার্স ও ভ্রূণতত্ত্ববিদ জিন পারডি বন্ধ্যাত্ব নিয়ে গবেষণা করছিলেন। ১৯৬৮-১৯৭৭ সালের মধ্যে তাঁরা শতাধিক ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন (In Vitro Fertilisation—IVF) বা আইভিএফ পদ্ধতিতে ভ্রূণ প্রতিস্থাপনের চেষ্টা করেন। কিন্তু কোনোটিতেই তাঁরা সফল হতে পারেননি।
১৯৭৭ সালের বড়দিনের আগে লেসলি ব্রাউন একটি চিঠি পেলেন প্রফেসর এডওয়ার্ডসের কাছ থেকে। এডওয়ার্ড যেন এই অসুখী দম্পতির জীবনে দেবদূত হয়ে এলেন! চিঠিতে তিনি লিখলেন, ‘আপনার রক্ত ও ইউরিন পরীক্ষার ফলাফলে আমরা ইঙ্গিত পাচ্ছি, আপনি সম্ভবত প্রাথমিক গর্ভাবস্থায় আছেন। তাই আপনাকে সতর্ক করছি, অনুগ্রহ করে পাহাড়ে চড়া, স্কিইং করাসহ ঝুঁকিপূর্ণ কোনো কাজ করা থেকে বিরত থাকবেন। এমনকি ক্রিসমাসের শপিং করাও নিষেধ!’ লেসলি ব্রাউন আমৃত্যু প্রফেসরের সেই চিঠিটি আগলে রেখেছিলেন।
১৯৭৮ সালের ২৫ জুলাই, প্রায় মধ্যরাতে ইংল্যান্ডের ওল্ডহ্যাম জেনারেল হাসপাতালে ঠিক রাত ১১টা ৪৭ মিনিটে সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে জন্ম নিলো জন ও লেসলি ব্রাউনের কন্যাসন্তান লুইস জয় ব্রাউন। এই শিশুই বিশ্বের প্রথম আইভিএফ শিশু। লুইস ব্রাউন টেস্টটিউব বেবি হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিতি পায়। কিন্তু তার জন্ম প্রক্রিয়ায় নিষিক্তকরণের ক্ষেত্রে টেস্টটিউবের বদলে পেট্রিডিশের (ল্যাবরেটরিতে ব্যবহৃত এক ধরনের পাত্র) ভূমিকা ছিল বেশি। নিষিক্তকরণ সম্পন্ন হয় একটি পেট্রিডিশে ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর মিলনের মাধ্যমে এবং পরে সৃষ্ট ভ্রূণটি মায়ের জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করা হয়। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা মেডিকেল মিরাকল ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের উদাহরণ লুইস ব্রাউন তার জন্মের আগেই সেলিব্রিটি হয়ে গিয়েছিল। তখন মিডিয়াতে ঘটনাটি এতই চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে যে, ওল্ডহ্যাম হসপিটালের সামনে সাংবাদিকদের তাঁবু পড়ে গিয়েছিল।
সাধারণ মানুষের মধ্যে ছিল মিশ্র প্রতিক্রিয়া। অনেক ধর্মীয় ও সামাজিক গোষ্ঠী ঘটনাটিকে ‘খোদার ওপর খোদকারি’ বলে মনে করল। কিছু মানুষ তো লুইসের নামই দিয়ে দিল ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের শিশু’! যেন চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা কোনো দানব তৈরি করেছেন! এমনকি ভ্যাটিকানসহ বিভিন্ন ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ বিষয়টিকে মানবশিশুর জন্ম প্রক্রিয়ায় বিজ্ঞানের অযাচিত হস্তক্ষেপ হিসেবে আখ্যায়িত করে। কিন্তু লুইসের সুস্থ, স্বাভাবিক জন্ম ও বেড়ে ওঠা প্রমাণ করে, আইভিএফ প্রক্রিয়ায় ভয়ের কিছু নেই। বরং চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক পরম আশীর্বাদ এই টেস্টটিউব বেবি।
লেসলির গর্ভধারণের খবর মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে গবেষকরা অনাগত শিশুটির নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তায় পড়েন। ডক্টর স্টেপটো তখন লেসলিকে নিজ গাড়িতে করে নিয়ে যান এবং লুকিয়ে রাখেন। সিজারিয়ান অপারেশনের আগ পর্যন্ত সাংবাদিকরা আর তাঁদের খবর জানতে পারেনি। রাতারাতি মিডিয়া সেনসেশন বনে যাওয়া ‘বেবি লুইস’ তার জন্মের পর বিশ্বজুড়ে ভ্রমণ করে। তার এই ভ্রমণ বিশ্বের অসংখ্য নিঃসন্তান মানুষকে নতুন করে আশার আলো দেখায়! তারকা শিশু হিসেবে জন্ম নিলেও বর্তমানে লুইস ব্রাউন তাঁর স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে সাধারণ জীবনযাপন করছেন।
তাঁর দুই পুত্র স্বাভাবিক পদ্ধতিতেই জন্মগ্রহণ করেছে, যা আইভিএফ পদ্ধতির নিরাপত্তা ও কার্যকারিতাকে আরও দৃঢ়ভাবে প্রমাণ করে। লুইস বর্তমানে বোর্ন হল আইভিএফ ক্লিনিকে (Bourn Hall IVF Clinic) অ্যাম্বাসেডর হিসেবে কাজ করছেন। এটি ড. স্টেপটো, ড. এডওয়ার্ডস এবং জিন পারডির প্রতিষ্ঠিত ক্লিনিক। তিনি বিশ্বের বিভিন্ন সেমিনারে আইভিএফ পদ্ধতি নিয়ে অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য দেন। দুঃখজনক হলেও সত্যি, নোবেল কমিটি আইভিএফ প্রযুক্তির এই তিন অগ্রদূতের অবদান দেরিতে স্বীকার করে। ড. রবার্ট এডওয়ার্ডস ২০১০ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান। ড. স্টেপটো (মৃত্যু: ১৯৮৮) ও জিন পারডি (মৃত্যু: ১৯৮৫) আগেই মৃত্যুবরণ করায় নোবেল পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হননি। কারণ, মরণোত্তর নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় না।
লুইস ব্রাউন ২০১৫ সালে মাই লাইফ অ্যাস দ্য ওয়ার্ল্ডস ফার্স্ট টেস্টটিউব বেবি নামে আত্মজীবনী প্রকাশ করেন। তাঁর জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে ২০২৪ সালে নেটফ্লিক্সে জয় (Joy) নামে একটি মুভি মুক্তি পেয়েছে। লুইস ব্রাউনের জন্মের পর থেকে আজ পর্যন্ত সারা বিশ্বে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখেরও বেশি শিশু আইভিএফ পদ্ধতিতে জন্মেছে। বাংলাদেশেও এই পদ্ধতি এখন অত্যন্ত পরিচিত, সহজলভ্য ও নিরাপদ। বন্ধ্যাত্ব বা আঁটকুড়ো অপবাদে সংকুচিত থাকা অসংখ্য নিঃসন্তান দম্পতির মুখে হাসি ফুটিয়েছে এই আইভিএফ পদ্ধতি। লুইসের জন্মের রাতেই ড. স্টেপটো তাঁর নাম রেখেছিলেন জয় বা আনন্দ। এই আনন্দ যেন আইভিএফ পদ্ধতিতে জন্ম নেওয়া প্রতিটি শিশুর হাসিমুখের আনন্দেরই প্রতিচ্ছবি। লুইসের জন্ম চিকিৎসাবিজ্ঞান ও মানুষের অধ্যবসায়ের ইতিহাস বদলে দিয়েছে। এই ঘটনা প্রমাণ করে, মানুষ তার আশার সমান বড়।