মানবদেহের মূল্য কত

আমরা মানুষ তৈরি হয়েছি নক্ষত্রের ধুলায়—এ কথাটি এখন প্রবাদে পরিণত হয়েছে। এর পেছনের বিজ্ঞানটি হলো, পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহের অধিকাংশ মৌল তৈরি হয় নক্ষত্রের একদম কেন্দ্রস্থলে। অতি ভারী কোন নক্ষত্র জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে প্রচণ্ড চাপ ও তাপে বিস্ফোরিত হলে এসব মৌল মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে পর্যায় সারণির ভারী মৌলগুলো তৈরি হয়। ভারী মৌলগুলো এ প্রক্রিয়ায় তৈরি না হলে গোটা মহাবিশ্বে শুধু হাইড্রোজেন আর হিলিয়াম গ্যাসেই পরিপূর্ণ থাকত। তাহলে এই সৌরজগৎ, সবুজ পৃথিবী, বৈচিত্র্যময় গাছপালা, জীবজন্তু শুধু নয়, খোদ মানুষেরও কোনো অস্তিত্ব সম্ভব হতো না।

পর্যায় সারণিতে ১১৮টি মৌল দেখা গেলেও এদের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয় ৯২টি মৌল। বাকিগুলো কৃত্রিমভাবে বিজ্ঞানীরা তৈরি করেন গবেষণাগারে। বিজ্ঞানীদের হিসাবে, প্রাকৃতিক এই ৯২টি মৌলের মধ্যে মানবদেহে থাকে প্রায় ৫৯টি। তবে বেশির ভাগ মানুষের দেহে মোটামুটি ৪১টি মৌল থাকতে পারে। বয়স, দেহের ওজনভেদে মৌলের সংখ্যা ওঠানামা করে। নিছক মজা করতে বিজ্ঞানীরা মাঝেমধ্যে প্রশ্ন করেন, মানবদেহে যেসব পদার্থ আছে, সাকল্যে তা দাম কত? প্রশ্নটাকে ঘুরিয়ে এভাবেও বলা যায়, একটা মানবদেহ গড়ে তুলতে কত খরচ হতে পারে? কয়েক বছর আগে ব্রিটেনের রয়্যাল সোসাইটি অব কেমিস্ট্রি বা আরএসসি কেমব্রিজ বিজ্ঞান মেলায় এ প্রশ্নের সম্ভাব্য একটি উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছে। ২০১৩ সালে তারা প্রমাণ সাইজের একটি মানবদেহের অতি প্রয়োজনীয় পদার্থগুলোর খরচ হিসাব করে দেখেছে।

আরএসসির ওই হিসাবে, মানবদেহে থাকা ৫৯টি মৌলের মধ্যে তুলনামূলকভাবে অতিগুরুত্বপূর্ণ ছয়টি হলো কার্বন, অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন, ক্যালসিয়াম এবং ফসফরাস। আমাদের দেহের ৯৯.১ শতাংশ গঠিত হয় এ ছয়টি মৌল দিয়ে। কিন্তু বাকি মৌলগুলোর কোনটা কতটুকু থাকবে, তা সঠিকভাবে বলা না গেলেও সেগুলোর পরিমাণ যে খুবই সামান্য, তা নিশ্চিত। যেমন দেহের স্বাভাবিক কার্যক্রমের জন্য প্রতি ৯৯৯৯৯৯৯৯৯.৯টি (প্রায় এক শ কোটি) পরমাণুর মধ্যে গুণে গুণে স্রেফ ২০টি কোবাল্ট আর ৩০টি ক্রোমিয়াম হলেই যথেষ্ট (মানবদেহে মোট পরমাণুর সংখ্যা প্রায় (৭×১০২৭টি)।

অক্সিজেন ছাড়া আমরা যেমন একমুহূর্তের জন্যও বাঁচতে পারি না, তেমনি মানবদেহের সিংহভাগ অক্সিজেন দিয়ে গঠিত। যেকোনো মানুষের প্রায় ৬১ শতাংশ জায়গা দখল করে থাকে অক্সিজেন। কাজেই আমাদের দেহ প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এই স্বাদহীন-গন্ধহীন গ্যাসে গঠিত। অক্সিজেন ছাড়াও এখানে আরেকটি গ্যাস মানে হাইড্রোজেন থাকে ১০ শতাংশ। তাহলে দেখা যাচ্ছে, মানবদেহের কমপক্ষে ৭১ শতাংশই গ্যাসীয়। প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে আমরা বেলুনের মতো বাতাসে ভাসি না কেন? কিংবা বাতাসের মতো হালকা নই কেন? এর কারণটা সহজ। আসলে দেহের বেশির ভাগ অক্সিজেন হাইড্রোজেনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পানি গঠন করে। আর পানি বেশ ভারী পদার্থ। মজার ব্যাপার হলো, হালকা এই গ্যাস দুটি পরস্পর যুক্ত হয়ে প্রকৃতির অন্যতম ভারী বস্তু পানিতে পরিণত হয়। সে কারণেই চাইলেই বেলুনের মতো উড়তে পারি না আমরা।

অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন সবচেয়ে সস্তা দুটি মৌল। বর্তমান বাজারমূল্যের হিসাবে, আপনার দেহে থাকা অক্সিজেনের দাম ধরে নেওয়া যায় ১৪ মার্কিন ডলার বা প্রায় ১ হাজার ১৯০ টাকা। অন্যদিকে হাইড্রোজেনের খরচ পড়বে একটু বেশি, ২৬ মার্কিন ডলার বা ২ হাজার ২১০ টাকা। অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনের পর আপনার দেহে আরেকটি গ্যাস থাকে। সেটি নাইট্রোজেন, যার পরিমাণ ২ দশমিক ৬ শতাংশ। অবশ্য এর বাজারমূল্য বেশি হলেও আপনার দেহে এর যে পরিমাণ, তাতে মাত্র ৩৪০ টাকা (৪০ সেন্ট) খরচ করলেই চলবে। কিন্তু বাকি মৌলগুলো পেতে গেলে গাঁটের পয়সা খরচ হবে বেশ।

আপনার দেহ যদি হালকা-পাতলা হয়, তাহলে সে জন্য প্রায় ৩০ পাউন্ড বা সাড়ে ১৩ কেজি কার্বন দরকার। রয়্যাল সোসাইটি অব কেমিস্ট্রির হিসাবে, এই পরিমাণ বিশুদ্ধ কার্বনের জন্য খরচ পড়বে ৬৯ হাজার ৫৫০ মার্কিন ডলার বা প্রায় ৬০ লাখ টাকা। এতক্ষণে কিছুটা বোঝা যাচ্ছে, অন্তত অর্থের মূল্যে আমাদের দেহ মোটেও সস্তা কিছু নয়। ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও পটাশিয়াম খুব অল্প পরিমাণ দরকার হয় আমাদের দেহে। এগুলোর জন্য লাগবে আরও ৬২ লাখ টাকা (৭৩ হাজার ৮০০ মার্কিন ডলার)। এর পরের প্রয়োজনীয় মৌলগুলোর জন্য গুনতে হবে আরও বেশি অর্থ। তবে আমাদের সৌভাগ্যই বলতে হবে, বাকি মৌলগুলো খুবই সামান্য পরিমাণ দরকার হয়। যেমন থোরিয়ামের কথা ধরা যাক। এ মৌলের এক গ্রামের দাম প্রায় আড়াই লাখ টাকা (তিন হাজার মার্কিন ডলার)। তবে আমাদের দেহের জন্য থোরিয়াম দরকার মাত্র ০.০০০০০০১ শতাংশ। কাজেই মাত্র ২৮ টাকা (৩৩ সেন্ট) খরচ করেও সে চাহিদা মেটানো সম্ভব। একইভাবে মানবদেহের জন্য মোটামুটি ৫ টাকার (৬ সেন্ট) টিন আর আড়াই টাকার (৩ সেন্ট) জিরকোনিয়াম ও নিওবিয়াম হলেও চলে যায়। এদিকে সামারিয়ামের জন্য তেমন খরচ লাগবে না বলে মনে করে আরএসসি। কারণ মানবদেহে এ মৌলটির পরিমাণ মাত্র ০.০০০০০০০০৭ শতাংশ। এত অল্প সামারিয়াম বোধ হয় দোকানির কাছ থেকে ফ্রি নেওয়া যাবে।

মানবদেহে ৫৯টি মৌলের মধ্যে ২৪টিকে অতিদরকারী মনে করা হয়। কারণ, এসব মৌল ছাড়া মানবদেহ চলতে পারে না। বাকিগুলোর কয়েকটি দেহের জন্য বেশ উপকারী এবং কিছু অবশ্যই অপকারী। অন্যগুলো উপকারী হতে পারে, তবে সেগুলো কী কাজে লাগে, তা এখনো বুঝতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। আবার এমন কিছু মৌলও থাকে, যেগুলো উপকারীও নয়, ক্ষতিকরও নয়। যেমন ক্যাডমিয়ামের কথাই ধরা যাক। এটি আমাদের ২৩তম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যার শূন্য দশমিক ১ শতাংশ থাকে। কিন্তু মৌলটি খুবই ক্ষতিকর। আমাদের দেহে ক্যাডমিয়াম থাকার অর্থ এই নয় যে মৌলটি খুব দরকারী। আসলে মাটি থেকে গাছপালায় মৌলটি আসে। পরে আমরা যখন ওই গাছের ফলমূল বা অন্য কিছু খাই, তখন তা আমাদের দেহে চলে আসে। সাধারণত উত্তর আমেরিকার মাটিতে এ মৌলের পরিমাণ বেশি। হিসাবে দেখা গেছে, এ এলাকার মানুষের খাদ্যের সঙ্গে প্রতিদিন প্রায় আট মাইক্রোগ্রাম ক্যাডমিয়াম দেহে চলে যেতে পারে।

আপনার দেহের কোন জায়গার কোষের নমুনা নিলে সেখানে এক লাখ বা তারও বেশিসংখ্যক সেলিনিয়াম পরমাণু পাওয়া যাবে। অনেক দিন পর্যন্ত মানবদেহে এই মৌলটির কাজ কী তা জানা ছিল না। তবে সম্প্রতি দেখা গেছে, দুটি গুরুত্বপূর্ণ এনজাইম গঠন করে সেলেনিয়াম। এর অভাবে হাইপারটেনশন, আর্থ্রাইটিস, রক্তস্বল্পতা, কয়েক ধরনের ক্যানসার এবং এমনকি শুক্রাণু উৎপাদনও কমে যেতে পারে। তাই খাবারের সঙ্গে কিছু সেলেনিয়াম গ্রহণ করা বুদ্ধিমানের কাজ (বাদাম, গম ও মাছে পাওয়া যায়)। তবে এটি বেশি গ্রহণ করলেও বিপদ। তাতে দেহের যকৃতে বিষক্রিয়া হতে পারে। তাই বুঝেশুনে পরিমাণমতো সেলেনিয়াম গ্রহণ করাই ভালো।

কাজেই সব মিলিয়ে আরএসসির হিসাবে মানবদেহের খরচ দাঁড়াচ্ছে প্রায় ১ লাখ ৫১ হাজার ৫৭৮ দশমিক ৪৬ মার্কিন ডলার বা প্রায় ১ কোটি ২৯ লাখ টাকা। অবশ্য এর সঙ্গে শ্রমের মূল্যটাও যোগ করতে হবে। আর নতুন বাজেট অনুযায়ী বর্তমানে তো আমাদের পদে পদে ট্যাক্স লাগে। তাই স্বাভাবিকভাবেই শ্রম ও ট্যাক্স যোগ করলে খরচ যাবে আরও বেড়ে। তখন হয়তো সাকল্যে তিন লাখ মার্কিন ডলার (প্রায় আড়াই কোটি টাকা) লেগে যেতে পারে।

তবে আপনি কত খরচ করলেন বা কত যত্ন নিয়ে সব উপাদান জোড়াতালি দিলেন, তাতে কিন্তু কিছুই আসে যায় না। কারণ এত কষ্ট করেও কোনো মানবদেহ বানানো সম্ভব নয়। পৃথিবীতে এ পর্যন্ত যত মেধাবী মানুষ এসেছে কিংবা চলে গেছে, তাদের সবার জ্ঞান একত্র করেও এখনো একটা জীবন্ত কোষ বানানো সম্ভব হয়নি। সেখানে গোটা একটা মানবদেহ বানানো তো বহু দূরের ব্যাপার। শুরুতেই বলেছি, মানবদেহের আর্থিক মূল্যের এই হিসাবটি করা হয়েছিল, নিছক মজা করার জন্য। আসলে মানবদেহকে ডলার বা টাকার হিসাবে পরিমাপ করা সম্ভব নয়; উচিতও নয়। কারণ, প্রত্যেক মানুষের দেহ আসলে অমূল্য।

মজার ব্যাপারটি হলো, স্রেফ ধুলাবালুতে যেসব পদার্থ থাকে, সেই একই পদার্থ মানবদেহেও খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু আপনার দেহের এই পদার্থ বা মৌলের বিশেষত্ব হলো, সেগুলো একত্র হয়ে গঠিত হয়েছেন আপনি। নিছক জড় ধুলাবালু দিয়ে তৈরি হয়েছে মহামূল্যবান জীবন্ত একটা সত্তা। সম্ভবত এটাই মানবদেহ তথা জীবনের সবচেয়ে বড় বিস্ময়কর ব্যাপার।

লেখক: সাংবাদিক

সূত্র: দ্য বডি/বিল ব্রাইসন, উইকিপিডিয়া, স্পেস ডট কম