অপারেশন থিয়েটারে চিকিৎসকরা সবুজ বা নীল পোশাক পরেন কেন

পোশাকের রং কি মানুষের জীবন বাঁচাতে পারে? অপারেশন থিয়েটারে সার্জনরা নীল বা সবুজ, কিংবা বলা ভালো পেস্ট রঙের একধরনের পোশাক পরেন। অপারেশনের রোগীদের জীবন বাঁচাতে এই পোশাকের গুরুত্ব এবং পেছনের বিজ্ঞান…

হাসপাতাল বা অপারেশন থিয়েটারে ডাক্তার ও নার্সদের প্রায়ই সবুজ বা নীল রঙের পোশাক পরতে দেখা যায়। আরও সুনির্দিষ্ট করে বলা যায়, পেস্ট রঙের পোশাক। সাদা অ্যাপ্রন বা ইউনিফর্ম ছাড়াও তাঁরা এই বিশেষ রঙের পোশাক পরেন। বিশেষ করে অপারেশন থিয়েটারে। প্রশ্ন হলো, কেন? এই রঙের পেছনে কি লুকিয়ে আছে কোনো গোপন রহস্য? নাকি এটা শুধুই ডাক্তারি ফ্যাশন? আসলে অপারেশনের সাফল্যের পেছনে থাকতে পারে এই রঙের পরোক্ষ ভূমিকা। বিষয়টা খুলেই বলি।

আগে ডাক্তাররা সব সময় অপারেশন থিয়েটারে এমন বিশেষ পোশাক পরতেন না। ১৯১৮ সালের ফ্লু মহামারী ও জীবাণু প্রতিরোধের ধারণা আসার পর থেকে সার্জিক্যাল মাস্ক, রাবার গ্লাভস, জীবাণুমুক্ত কাপড়, গাউন ও টুপির ব্যবহার শুরু হয়। এর পরপরই ডাক্তাররা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বোঝানোর জন্য অপারেশনের সময় সাদা পোশাক পরতে শুরু করেন।

বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ডাক্তাররা বুঝতে পারলেন, তাঁদের সাদা পোশাকের কিছু সমস্যা আছে। সার্জনরা যখন অপারেশন থিয়েটারে অপারেশনের সময় রক্তের গাঢ় লাল রং থেকে চোখ সরিয়ে সহকর্মীদের সাদা পোশাকের দিকে তাকাতেন, কিছুক্ষণের জন্য তাঁদের চোখ ধাঁধিয়ে যেত। দেখতে অসুবিধা হতো। অনেকটা শীতকালে বরফের ওপর সূর্যের আলো পড়লে যেমন চোখ ঝলসে যায়, সে রকম। এমনকি, অনেকক্ষণ ধরে সহকর্মীদের সাদা পোশাকের দিকে তাকিয়ে থাকার কারণে ডাক্তারদের মাথাব্যথাও শুরু হতো। ১৯৯৮ সালের ‘টুডেস সার্জিক্যাল নার্স’ নামে এক লেখায় বলা হয়, ১৯১৪ সালে প্রথম একজন ডাক্তার অপারেশনের সময় সবুজ পোশাক পরা শুরু করেন। তিনি ভেবেছিলেন, এতে তাঁর চোখের ওপর চাপ কম পড়বে। সেই শুরু।

সাদা আলোয় রংধনুর সব রং থাকে। এর মধ্যে লাল এবং সবুজ—দুটোই আছে। কিন্তু মস্তিষ্ক ও চোখের স্নায়ুগুলোর লাল শনাক্ত করার পথটা এ সময় ক্লান্ত থাকে।

ইতিহাস বলে, এরপর থেকেই সারা বিশ্বের সার্জনেরা সাদা পোশাকের বদলে নীল বা সবুজ মতন পেস্ট রঙের পোশাক ব্যবহার করা শুরু করেন। এতে হাসপাতালের কর্মীদেরও সুবিধা হলো। কারণ সাদা পোশাকে রক্তের দাগ তোলা ছিল খুব কঠিন কাজ।

আরও পড়ুন

কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন সবুজ বা নীল রং বেছে নেওয়া হলো। বেগুনি বা হলুদ নয় কেন? এর আসল কারণ হলো, সবুজ ও নীল রং দৃশ্যমান আলোর বর্ণালিতে লালের একদম বিপরীত দিকে থাকে। আর অপারেশনের সময় একজন সার্জন প্রায় সব সময়ই রক্ত বা কোনো অঙ্গের ভেতরে অংশের ওপর মনোযোগ দেন। এতে সবুজ বা নীলের মতো এই রং ডাক্তারদের অপারেশন কক্ষে আরও ভালোভাবে দেখতে সাহায্য করে। ফলে এই সবুজ বা নীলের পটে তাঁদের দৃষ্টি রক্তের বিভিন্ন লাল শেডের প্রতি আরও সংবেদনশীল হয়ে ওঠে। এতে তাঁরা মানবদেহের সূক্ষ্ম পার্থক্যগুলো ভালোভাবে বুঝতে পারেন, যা অপারেশনের সময় ভুল হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটা কমিয়ে দেয়।

অপারেশনের সময় একজন সার্জনের লাল রঙের ওপর গভীর মনোযোগের সঙ্গে আরও একটি বিষয় জড়িত। দীর্ঘক্ষণ লাল রং দেখলে সাদা পৃষ্ঠে একধরনের বিভ্রান্তিকর সবুজ-বিভ্রম দেখা দিতে পারে। অর্থাৎ কোনো সার্জন রক্তাক্ত অঙ্গ থেকে চোখ সরিয়ে যদি সাদা ল্যাব কোটের দিকে তাকান, তাহলে তাঁর চোখে একধরনের সবুজ বিভ্রম হতে পারে। অর্থাৎ সাদাকে তাঁরা কেমন ঘোলাটে সবুজের মতো দেখেন। এই বিভ্রম ডাক্তারের দৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে নড়তে থাকে। ঠিক যেমন ক্যামেরার ফ্ল্যাশের পর আমাদের চোখে ভাসমান দাগ ভেসে বেড়ায়, সে রকম।

বিংশ শতাব্দীর কাছাকাছি সময় থেকে শুরু হয় এই স্ক্রাবের ব্যবহার, যা আগেই বলেছি। এর আগে সার্জনরা শুধু তাদের সাধারণ পোশাকের ওপর অ্যাপ্রোন পরতেন।

এই ঘটনা ঘটার কারণ, সাদা আলোয় রংধনুর সব রং থাকে। এর মধ্যে লাল এবং সবুজ—দুটোই আছে। কিন্তু মস্তিষ্ক ও চোখের স্নায়ুগুলোর লাল শনাক্ত করার পথটা এ সময় ক্লান্ত থাকে। ফলে বিভ্রান্ত ও ক্লান্ত মস্তিষ্কে চোখ থেকে একধরনের সবুজ সংকেত পৌঁছায়।

চোখের বিভ্রম নিয়ে গবেষণা করছেন ইতালির পাডোভা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক পাওলা ব্রেসান। তিনি জানান, ‘কোনো ডাক্তার যদি সাদা পোশাকের বদলে সবুজ বা নীল রঙের পোশাকের দিকে তাকান, তাহলে এই বিভ্রান্তিকর সবুজ সরাসরি পোশাকের রঙের সঙ্গে মিশে যায়। ফলে কোনো সমস্যা তৈরি হয় না।’

আরও পড়ুন

এবার আসা যাক এই সবুজ বা নীল পোশাকের নামের দিকে। এই পোশাকগুলোকে বলা হয় স্ক্রাবস (Scrubs)। অস্ত্রোপচারের আগে ডাক্তাররা সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হন। এই পদ্ধতিকে বলা হয় ‘স্ক্রাবিং ইন’। সেই নাম থেকেই এই পোশাকগুলোর অমন নাম হয়েছে।

বিংশ শতাব্দীর কাছাকাছি সময় থেকে শুরু হয় এই স্ক্রাবের ব্যবহার, যা আগেই বলেছি। এর আগে সার্জনরা শুধু তাদের সাধারণ পোশাকের ওপর অ্যাপ্রোন পরতেন। তখন তাঁরা গ্লাভসও ব্যবহার করতেন না, অস্ত্রোপচারের সরঞ্জামগুলোও জীবাণুমুক্ত করা হতো না। ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু মহামারী থেকে শিক্ষা নিয়ে এবং বিজ্ঞানী জোসেফ লিস্টারের অ্যান্টিসেপটিক বা জীবাণু প্রতিরোধের ধারণা আসার পর সার্জনরা স্ক্রাব পরা এবং জীবাণুমুক্তকরণ পদ্ধতি ব্যবহার করা শুরু করেন। তবে পুরোপুরিভাবে জীবাণুমুক্ত পদ্ধতি ১৯৪০ সালের আগে চালু হয়নি।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ

সূত্র: বোর্ডভাইটালস, লাইভ সায়েন্স, সায়েন্স লাইন

আরও পড়ুন