বিষ শব্দটি শুনলে আপনার মনে কীসের ছবি ভাসে? কোনো বিষাক্ত গাছের নির্যাস, নাকি বিষধর সাপের বিষ? নাকি অন্য কিছু? কিন্তু সব বিষের উৎস এমন নাও হতে পারে। যেসব জিনিস মানুষের জীবন বাঁচায়, কখনও কখনও সেটা মৃত্যুও ডেকে আনতে পারে। ষোড়শ শতকের বিখ্যাত রসায়নবিদ ও চিকিৎসক পারাসেলসাস বলেছিলেন: ডোজ বা মাত্রাই কোনোকিছুকে বিষ করে তোলে। মানে হলো, কোনো কিছু কী পরিমাণ নেওয়া হচ্ছে, সেটার উপরই তার বিষাক্ততা নির্ভর করে। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ ডায়াবেটিসের ওষুধ ইনসুলিন। এই জীবনদায়ী রাসায়নিকটিই একবার একটি ভয়ংকর মারণাস্ত্রে পরিণত হয়েছিল। ঘটনাটা খুলেই বলি।
দিনটি ছিল ১৯৫৭ সালের ৪ মে। শনিবার, ভোরবেলা। ঘটনাস্থল ইংল্যান্ডের ব্র্যাডফোর্ড শহরের থর্নবারি ক্রিসেন্টে একটি বাড়ি। একটু আগেই সেখানে এসে পৌঁছেছে স্থানীয় পুলিশ। তারও কিছুক্ষণ পরেই ডাক পড়ল ডিটেকটিভ সার্জেন্ট জন নেইলরের। বাড়িটায় ঢুকতেই এক কোণ থেকে তাঁর কানে কান্নার শব্দ ভেসে এল। তাকিয়ে দেখলেন, এক শোকার্ত স্বামী এক নারীর ছবি বুকে চেপে ধরে কাঁদছে। লোকটি এ বাড়ির কর্তা—কেনেথ বার্লো। আর ছবির নারীটি তাঁর স্ত্রী এলিজাবেথ বার্লো।
ডিটেকটিভ নেইলরকে উপর তলার বাথরুমে নিয়ে গেল এক পুলিশ কনস্টেবল। সেখানে দেখা গেল, ভয়ংকর এক দৃশ্য। বাথটাবে এক নারীকে প্রায় নগ্ন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখলেন ডিটেকটিভ। দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেঁচে নেই। ছবির সেই নারী—এলিজাবেথ বার্লো। তার শোকগ্রস্ত স্বামীর পাশে নীরবে দাঁড়িয়ে ছিল প্রতিবেশীরা। তাদের বিশ্বাস মানুষটির শোক একদম খাঁটি। কিন্তু ডিটেকটিভ নেইলরের মনে কেন যেন খটকা লাগল।
এলিজাবেথ বার্লোকে সবাই ডাকত বেটি বলে। তার বয়স ২৮ বছর। কেনেথের চেয়ে সে ছিল নয় বছরের ছোট। বেটিকে যারা চিনত, তাদের মতে স্বামী কেনেথের সঙ্গে তার ছিল সুখের সংসার। পরে প্রতিবেশীরা জানায়, তাদের মধ্যে কখনও ঝগড়া হতো না। এলিজাবেথ ছিল কেনেথের দ্বিতীয় স্ত্রী। তার আগের স্ত্রীর মৃত্যুর পর ১৯৫৬ সালে তাদের বিয়ে হয়। কেনেথের ছেলে ইয়ানের সৎ মা এলিজাবেথ। কেনেথ এবং এলিজাবেথ দুজনেই হাসপাতালে কাজ করত। এলিজাবেথ ছিল নার্স, আর কেনেথ রেজিস্টার্ড নার্স। সম্ভবত হাসপাতালেই তাদের পরিচয় হয়েছিল। বিয়ের পর কেনেথ ব্র্যাডফোর্ড রয়্যাল ইনফার্মারিতে চাকরি চালিয়ে গেলেও নার্সিং ছেড়ে দেয় এলিজাবেথ। এরপর একটি লন্ড্রিতে ইস্ত্রি করার কাজ নেয়। লন্ড্রির কাজ মামুলি। কিন্তু বেতনটা বেশ ভালো।
সন্ধ্যায় পরিবারটি বসার ঘরে সময় কাটাচ্ছিল। কিছুক্ষণ সোফায় শুয়ে রইল এলিজাবেথ। কিন্তু ক্রমেই এক ধরনের অস্থিরতা বোধ করতে লাগল। অবশেষে সে কেনেথকে জানায় যে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে যাচ্ছে।
এলিজাবেথের মৃত্যুর দিনটি ছিল শুক্রবার, ৩ মে। শুক্রবার তার অর্ধদিবস ছুটি থাকত। সেদিন কাজ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে এলিজাবেথ সহকর্মীদের বলেছিল, সে নিজের জন্য কিছুটা সময় কাটাবে। চুলও ধোবে। বাড়ি ফেরার পথে সে পরিবারের জন্য দুপুরের খাবার হিসেবে মাছ ও চিপস কেনে। দুপুর সাড়ে বারোটায় সেগুলো টেবিলে পরিবেশন করা হলো রুটি-মাখন আর চায়ের সাথে।
দুপুরের খাবার শেষে ঘরের টুকিটাকি কাজ করতে লাগল এলিজাবেথ। কিছু কাপড় ধুয়ে নিল। ওদিকে সেদিন গাড়ি ধুতে ব্যস্ত কেনেথ। বিকেল চারটায় পাশের বাড়ির প্রতিবেশী মিসেস স্কিনারের সঙ্গে দেখা করতে গেল এলিজাবেথ। মিসেস স্কিনার পরে সাক্ষ্য দিয়েছে, এলিজাবেথকে সেদিন খুব প্রাণবন্ত দেখাচ্ছিল।
সন্ধ্যায় পরিবারটি বসার ঘরে সময় কাটাচ্ছিল। কিছুক্ষণ সোফায় শুয়ে রইল এলিজাবেথ। কিন্তু ক্রমেই এক ধরনের অস্থিরতা বোধ করতে লাগল। অবশেষে সে কেনেথকে জানায় যে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে যাচ্ছে। ঘড়িতে তখন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা। সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় কেনেথকে বলল, এক ঘণ্টা পর তাকে যেন ডেকে দেওয়া হয়। কারণ কেনেথের সঙ্গে টেলিভিশনে একটা অনুষ্ঠান দেখতে চায় সে। কিন্তু এলিজাবেথের আর কখনও টেলিভিশন দেখা হয়নি।
পঞ্চাশ মিনিট পর স্ত্রীকে ডাকতে উপরে যায় কেনেথ। এলিজাবেথ তখন পায়জামা পরে বিছানায় শুয়ে। স্বামীকে বলল, সে বেশ আরামেই আছে, বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছা করছে না। অগত্যা নিচে নেমে একা একাই টিভি দেখতে লাগল কেনেথ। প্রায় আধাঘণ্টা পর সে স্ত্রীর জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে যায়। এলিজাবেথ তখনও বিছানায়। তবে খুব ক্লান্ত বোধ করছিল। ছেলে ইয়ানকে শুভরাত্রি বলার মতো শক্তিও যেন নেই।
নিজেদের পারিবারিক ডাক্তারকে টেলিফোন করল প্রতিবেশি স্কিনার দম্পতি। ঘটনা কী, তা দেখতে একটু পর ছুটেও এল। বাথরুমে গিয়ে দেখল, এলিজাবেথ খালি বাথটাবে পড়ে আছে।
রাত সাড়ে নয়টার কিছু আগে স্ত্রীর ডাক শুনতে পায় কেনেথ। শোবার ঘরে গিয়ে দেখে, এলিজাবেথ বিছানায় বমি করেছে। দুজন মিলে চাদরটা বদলায়। নোংরা চাদরটা রান্নাঘরের গামলায় রাখে কেনেথ। শুধু ক্লান্তিই নয়, খুব গরমও লাগছিল এলিজাবেথের। তাই নতুন পাতা চাদরেই শুয়ে পড়ে। রাত দশটার দিকেও এলিজাবেথ অসুস্থ বোধ করছিল। ঘামছিলও প্রচণ্ড। তাই গায়ের প্রায় সব কাপড় খুলে শরীর ঠান্ডা করতে গোসলে যায় সে। বিছানায় শুয়ে বাথরুমে পানি পড়ার শব্দ শুনতে থাকে কেনেথ। তা শুনতে শুনতেই কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ল সে।
রাত তখন ১১টা ২০ মিনিট। হঠাৎ একটা শব্দে আচমকা ঘুম ভাঙে কেনেথের। অবাক হয়ে দেখল, তাঁর স্ত্রী তখনও গোসলে। বিছানায় ফেরেনি। চিন্তিত হয়ে তাকে ডাকতে লাগল, কিন্তু উত্তর পাওয়া গেল না। বাথরুমে গিয়ে দেখে, এলিজাবেথ পানির নিচে পুরো ডুবে আছে। নড়াচড়াও করছে না। আতঙ্কিত কেনেথ ভাবল, তার স্ত্রী পানিতে ডুবে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি বাথটাবের প্লাগটি খুলে দেয়। তাতে বাথটাবের পানি বেরিয়ে যেতে লাগল। এরপর স্ত্রীকে বাথটাব থেকে টেনে বের করার চেষ্টা করে কেনেথ। কিন্তু পারল না। প্রশিক্ষিত নার্স হওয়ায় সে বুঝতে পারল, এলিজাবেথকে বাথটাবের মধ্যেই কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস দিতে হবে। মরিয়া হয়ে সে সেই চেষ্টা করে গেল। কিন্তু বিশেষ লাভ হলো না। বাইরের সাহায্যের দরকার মনে করল কেনেথ। তাদের বাড়িতে টেলিফোন নেই। অগত্যা শুধু পায়জামা পরেই পাশের বাড়িতে তড়িঘড়ি ছুটে গেল। প্রতিবেশীকে ডাক্তার ডাকার অনুরোধ জানাল কেনেথ। তারপর দ্রুত স্ত্রীর কাছে ছুটে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে লাগল।
নিজেদের পারিবারিক ডাক্তারকে টেলিফোন করল প্রতিবেশি স্কিনার দম্পতি। ঘটনা কী, তা দেখতে একটু পর ছুটেও এল। বাথরুমে গিয়ে দেখল, এলিজাবেথ খালি বাথটাবে পড়ে আছে। কেনেথ তার কাঁধে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ডাক্তারের জন্য অপেক্ষা করার সময় মিসেস স্কিনার দেখল, কেনেথ চেয়ারে বসে মুখ হাতে দিয়ে কাঁদছে। ডাক্তার আসার পর দেখা গেল, অনেক দেরি হয়ে গেছে। আর কিছু করার নেই। এলিজাবেথকে মৃত ঘোষণা করা হলো।
যেকোনো মৃত্যুই কষ্টকর। আর কোনো সুস্থ তরুণীর মৃত্যু তো আরও বেশি। সুস্থসবল স্ত্রীর এমন মৃত্যু ডাক্তারের কাছে স্বাভাবিক মনে হয়নি। তার মনে হচ্ছিল, কিছু একটা যেন ঠিক নেই। এলিজাবেথ ডুবে মারা গেছে বলে মনে হলেও তাঁর চোখের মণি ছিল অস্বাভাবিকভাবে বড়। ডুবে মরা কারও ক্ষেত্রে এমনটা আগে দেখেনি ডাক্তার। তার মনে উঁকি দেওয়া কিছু প্রশ্নের উত্তর মিলল না। প্রথমত, কী কারণে এলিজাবেথের চোখের মণি এত বড় হয়েছিল? কেনই-বা তাঁর এত গরম লাগছিল যে রাতদুপুরে ঠান্ডা পানিতে গোসল করতে গেল? আর কেনই-বা এক প্রাণবন্ত নারী হুট করে এতটা ক্লান্ত হয়ে পড়ল?
২.
এসব প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে অতি পরিচিত একটা জিনিসে। বিশ্বের লাখো মানুষ রোজ চা-কফিতে বস্তুটা মিশিয়ে খান—চিনি। দোকান থেকে যে চিনি কেনা হয়, সেটা সুক্রোজ। কিন্তু আমাদের দেহের রক্তের চিনির গ্লুকোজ। সহজভাবে এ দুইয়ের পার্থক্য হলো, গ্লুকোজ সরল শর্করা অণু, যা আমাদের দেহ সহজেই হজম করতে পারে। তাই তা সরাসরি রক্তে শোষিত হয়। বিভিন্ন মিষ্টি ফল ও মধু গ্লুকোজের উৎস। অন্যদিকে গ্লুকোজ ও ফ্রুক্টোজ মিলে যে জটিল অণু তৈরি হয়, তাই সুক্রোজ। এটি হজমের জন্য এনজাইম দরকার হয়।
আমরা শর্করাজাতীয় যেসব খাবার খাই, তা পেটে এনজাইমের মাধ্যমে ভেঙে গ্লুকোজে পরিণত হয়। তারপর সেগুলো রক্তে চলে যায়। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থাকে। এই মাত্রা খুব কম হলে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কাজে বাধা পায়। আবার রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা খুব বেশি হলেও স্নায়ু ও চোখের ক্ষতি হয়। গ্লুকোজ ছাড়া মস্তিষ্ক চলতে পারে না। কিন্তু মস্তিষ্কে গ্লুকোজ জমা রাখার ব্যবস্থা নেই। তাই রক্ত থেকে সেখানে ক্রমাগত গ্লুকোজের যোগান দিতে হয়। রক্তে গ্লুকোকের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে অর্ধেক হয়ে গেলে হাত-পা অবশ হয়ে যায়। মস্তিষ্ক ধীর হয়ে যায়। চিন্তা প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। এ সময় দেহ ঘামে। হৃদপিণ্ড দ্রুত কাজ করে। গলার স্বরও বদলে যায়। দৃষ্টি হয়ে যায় ঝাপসা। সবশেষে রোগী কোমায় চলে যেতে পারে। হতে পারে মৃত্যুও।
রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে ইনসুলিন হরমোন। লিভারের কাছে পেটের নিচেই থাকে অগ্ন্যাশয়। এটি খাবার হজমে সাহায্য করে এবং ইনসুলিন তৈরি করে। খাবার পর আমাদের রক্তে গ্লুকোজ বেড়ে যায়। তখন অগ্ন্যাশয় ইনসুলিন নিঃসরণ করে। এই হরমোন রক্ত থেকে গ্লুকোজ শোষণ করে। তাই খাবার পর শুরুতে রক্তে গ্লুকোজ বাড়লেও তা দ্রুত কমেও যায়। শরীরের কোষগুলোর জ্বালানি হিসেবে কাজ করে গ্লুকোজ। কিন্তু এই যৌগটি একা কোষে ঢুকতে পারে না—তার জন্য দরকার ইনসুলিন। ইনসুলিন এক ধরনের চাবির মতো, যা কোষের দরজা খুলে দেয়, যাতে গ্লুকোজ ভেতরে ঢুকতে পারে। এভাবে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে ইনসুলিন।
দেহে যখন ইনসুলিন কাজ করে না, কিংবা শরীরে যথেষ্ট ইনসুলিন না থাকলে গ্লুকোজ রক্তেই থেকে যায়, কোষে ঢুকতে পারে না। এতে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায়। একে আমরা ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র রোগ বলি। তাই রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে ডায়াবেটিস রোগীরা ইনসুলিন ইনজেকশন নেন।
ধরা যাক, কোনো কারণে রক্তে যদি ইনসুলিনের পরিমাণ বেশি থাকে, তাহলে কী হবে?
রক্তে ইনসুলিনের পরিমাণ বেশি হওয়া বিপজ্জনক। এ অবস্থার নাম হাইপোগ্লাইসেমিয়া বা লো ব্লাড সুগার। অতিরিক্ত ইনসুলিন রক্তের গ্লুকোজকে খুব দ্রুত কোষের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়। ফলে রক্তে চিনির পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কমে যায়। স্বাভাবিকভাবে দেহে সেটা ঘটে না। কিন্তু কেউ যদি কৃত্রিমভাবে ইনসুলিন ইনজেকশন দেয়, তাহলে কী হবে?
১৯৩৫ সালে তেরোটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেন সাকেল। তিনি দাবি করলেন, এ চিকিৎসায় ৮৮ শতাংশ রোগী সুস্থ হয়েছেন। তাঁর খ্যাতি দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ল। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার স্বপ্ন দেখতে লাগলেন তিনি।
বিশ শতকের শুরুতে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিলেন বার্লিনের এক তরুণ ডাক্তার—নাম ম্যানফ্রেড জোশুয়া সাকেল। ইনসুলিন বাজারে আসার এক দশকের মধ্যে সেটা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য অপরিহার্য হয়ে ওঠে। ১৯২৮ সালে ডাক্তার সাকেল এক ডায়াবেটিস রোগীর চিকিৎসা করছিলেন। তার সিজোফ্রেনিয়াও ছিল। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য রোগীকে ইনসুলিন দিলেন সাকেল। কিন্তু একবার ভুল করে খানিকটা বেশি দিলেন। দেখা গেল, রোগীর সিজোফ্রেনিয়া ভালো হয়ে গেছে। অন্য সিজোফ্রেনিয়া রোগীদের ক্ষেত্রে কী হয়, তা পরীক্ষা করে দেখলেন সাকেল।
দেখা গেল, রোগীদের ইনসুলিন দিলে তাদের রক্তে গ্লুকোজ কমে যায়। মস্তিষ্কে পুষ্টি পৌঁছায় না। রোগীরা প্রচুর ঘামেন। বার বার গোসল করতে হয়। আরও কমে গেলে অস্থিরতা দেখা যায়। তারপর খিঁচুনি। শেষে কোমা। কোমায় গেলে চোখের মণি বড় হয়ে যায়। ঠিক এই সব লক্ষণই এলিজাবেথ বার্লোর শেষ কয়েক ঘণ্টায় দেখা গিয়েছিল। ইনসুলিন কোমার প্রধান লক্ষণ হলো চোখের মণি বড় হয়ে যাওয়া।
ডাক্তার সাকেল দেখলেন, এভাবে সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ কমে গেছে। তাদের হ্যালুসিনেশন নেই, উত্তেজনাও নেই। কিন্তু রোগীদের কোমা থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। সাকেল নিজের রান্নাঘরে পশুর উপর পরীক্ষা করলেন। দেখা গেল, গ্লুকোজ দিলে কোমা থেকে ফিরে আসে। এ পরীক্ষার পর অস্ট্রিয়া ফিরে যান সাকেল। কাজ শুরু করেন ভিয়েনার বিশ্ববিদ্যালয় ক্লিনিকে। মানসিক রোগীদের উপর ইনসুলিন শক থেরাপি প্রয়োগ করলেন। রোগীদের কোমায় পাঠানো খুব বিপজ্জনক। তাই দ্রুত গ্লুকোজ দিতে হয়। তা নাহলে মস্তিষ্কের ক্ষতি হয়।
১৯৩৫ সালে তেরোটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেন সাকেল। তিনি দাবি করলেন, এ চিকিৎসায় ৮৮ শতাংশ রোগী সুস্থ হয়েছেন। তাঁর খ্যাতি দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ল। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার স্বপ্ন দেখতে লাগলেন তিনি। ইউরোপ ও আমেরিকায় ডাক্তাররাও এ পদ্ধতি ব্যবহার করতে লাগলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অনেক ইউরোপীয় ডাক্তার হিটলারের নাৎসি বাহিনির হাত থেকে পালিয়ে গেলেন। তাদের মাধ্যমেই এই পদ্ধতি বিশ্বের আরও অনেক জায়গায় ছড়িয়ে পড়ল।
কিন্তু ১৯৫৩ সালে চিকিৎসাজগতে যেন বোমা ফাটালেন ব্রিটিশ মনোচিকিৎসক হ্যারল্ড বোর্ন । তিনি এক গবেষণাপত্রে বললেন ভিন্ন কথা। পেপারটার নাম ‘দ্য ইনসুলিন মিথ’। তাঁর দাবি, এ চিকিৎসার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। প্রাথমিক রোগ নির্ণয়ই ভুল ছিল, ফলাফলও পক্ষপাতদুষ্ট। ডাক্তার বোর্নের সমালোচনায় ফেটে পড়ল অনেকেই। কিন্তু পাঁচ বছর পর এক গবেষণায় স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেল যে ইনসুলিন শক থেরাপি আসলে স্রেফ প্রতারণা। গবেষণাটা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৭ সালে—এলিজাবেথ বার্লোর মৃত্যুর মাত্র ক’সপ্তাহ আগে।
পৌনে ছয়টায় এলিজাবেথের মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে যাওয়া হল। প্রাইস পরীক্ষা করে দেখলেন, এলিজাবেথের নাক আর মুখে রক্তমিশ্রিত ফেনা লেগে আছে।
৩.
এলিজাবেথ-কেনেথ দম্পতির কাছে ফেরা যাক। ১৯৫৭ সালের ৪ মে। রাত তখন দুটো। বার্লোদের বাড়িতে পৌঁছালেন হোম অফিসের ফরেনসিক প্যাথলজিস্ট ড. ডেভিড প্রাইস। তিনি এলিজাবেথের মৃতদেহ পরীক্ষা করতে লাগলেন। শুরুতেই প্রাইসের সন্দেহ হলো। কারণ একজন সুস্থ মধ্যবয়সী নারীর বাড়িতে বাথটাবে ডুবে মৃত্যু খুবই বিরল ঘটনা। এলিজাবেথের হাত ও বাথটাবের মধ্যে তখনও এক কাপ পানি জমে ছিল। তা দেখে ড. প্রাইসের সন্দেহ আরও গভীর হলো। কেনেথ বলেছিল, সে স্ত্রীকে বাথটাব থেকে তুলতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সেই পানি এতই নিশ্চল যে তাতে কোনো নাড়াচাড়ার চিহ্ন নেই। কেনেথ যদি সত্যিই এলিজাবেথকে টেনে তোলার চেষ্টা করত, তাহলে এই সামান্য পানিটুকু স্থির থাকার কথা নয়। আর কেনেথের গল্পের এ অংশটি যদি মিথ্যা হয়, তাহলে পুরো রাতের ঘটনা নিয়েই সন্দেহ জাগে।
পুলিশ পুরো বাড়ি তল্লাশি চালালো। একে একে বমি লাগানো চাদর, ঘামে ভেজা পায়জামা পেল তারা। রান্নাঘরের তাকে একটি পোর্সেলিনের পাত্রও পাওয়া গেল। তাতে মিলল রুমালে মোড়ানো দুটি ব্যবহৃত সিরিঞ্জ ও চারটি হাইপোডার্মিক সুচ। কিন্তু অনেক খুঁজেও কোনো ওষুধের খালি শিশি পাওয়া গেল না।
পৌনে ছয়টায় এলিজাবেথের মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে যাওয়া হল। প্রাইস পরীক্ষা করে দেখলেন, এলিজাবেথের নাক আর মুখে রক্তমিশ্রিত ফেনা লেগে আছে। ফুসফুসে জমে আছে পানি। মনে হচ্ছে সে ডুবে মারা গেছে। কিন্তু এত সহজে মামলা শেষ হয়ে গেল না। একটা বিষয় সবার চোখে পড়ল। এলিজাবেথের চোখের মণি অস্বাভাবিক বড় হয়ে গেছে। এটা পানিতে ডুবে মরার লক্ষণ নয়। কিন্তু কেন তিনি বাঁচার চেষ্টা করেননি? ময়নাতদন্তে আরেকটা চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া গেল। এলিজাবেথ সন্তানসম্ভবা ছিলেন— আট সপ্তাহের। তাঁর রক্ত আর প্রস্রাবের নমুনা পরীক্ষা করা হলো। কিন্তু কোনো বিষ বা গর্ভপাতের ওষুধ পাওয়া গেল না। তাহলে সেদিন রাতে কী হয়েছিল?
আরও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ড. প্রাইস নিশ্চিত হলেন, অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পর ডুবে এলিজাবেথের মৃত্যু হয়েছে। এমন সময় ইনসুলিন কোমা থেরাপির কথা মনে পড়ল ড. প্রাইসের। তাঁর সন্দেহ হলো, কেউ এলিজাবেথকে ইনসুলিন ইনজেকশন দিয়েছে। কিন্তু সে কথার প্রমাণ কী? ইনজেকশনের চিহ্ন কোথায়?
এদিকে এলিজাবেথের মৃত্যুর চার দিন পর, শেষকৃত্যের আয়োজন করা হলো। কিন্তু তার মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে, এলিজাবেথের শরীর আবারও পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেন ডাক্তার প্রাইস। এবার ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে তন্নতন্ন করে খোঁজা হলো। অবশেষে সূত্র মিলল। এলিজাবেথের দুই নিতম্বে দুটি করে ইনজেকশনের চিহ্ন পাওয়া গেল। মোট চারটা সুই ফোটানোর দাগ।
এবার কেনেথ বার্লোকে জেরা করতে শুরু করল পুলিশ। রান্নাঘরে সিরিঞ্জ পাওয়া গেছে। তার স্ত্রীর শরীরে ইনজেকশনের দাগ। জিজ্ঞাসাবাদের মুখে কেনেথ শেষপর্যন্ত এলিজাবেথকে ইনজেকশন দেওয়ার কথা স্বীকার করল। কিন্তু দাবি করল যে তার অনুমতি নিয়েই কাজটা করেছে সে। তাছাড়া সেটা নাকি ইনসুলিন নয়, এরগোমেট্রিন। সাধারণত গর্ভপাতের জন্য এরগোমেট্রিন ওষুধ ব্যবহার করা হয়।
ইনসুলিন প্রস্তুতকারক কোম্পানির কাছে সাহায্য চাইল পুলিশ। সেসময় ইনসুলিন প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো পণ্য পরীক্ষার জন্য এক অদ্ভুত পদ্ধতি ব্যবহার করত। সেটি মাউস কনভালশন মেথড নামে পরিচিত।
কেনেথ পুলিশকে জানায় যে তারা আরেকটি সন্তান চায়নি। কিন্তু ফরেনসিক দল আগেই এ সম্ভাবনা বাতিল করে দিয়েছিল। কারণ এলিজাবেথের শরীরে বা সিরিঞ্জে আরগোমেট্রিনের অস্তিত্ব মেলেনি। তাছাড়া আরগোমেট্রিনের কারণে চোখের মণি প্রসারিত হওয়া, ঘাম বা বমির মতো লক্ষণ দেখা দেয় না। কেনেথের সিরিঞ্জেও এরগোমেট্রিন ছিল না। পুলিশ এবার নিশ্চিত, এলিজাবেথকে অতিরিক্ত ইনসুলিন ইনজেকশন দিয়ে হত্যা করেছে কেনেথ। কিন্তু এটুকুতে মামলাটি আদালতে ধোপে টিকবে না। আদালতে তোলার জন্য দরকার চূড়ান্ত প্রমাণ—এলিজাবেথের শরীরে ইনসুলিনের উপস্থিতি প্রমাণ করতে হবে। সমস্যা হলো, ১৯৫৭ সালে মানুষের দেহে ইনসুলিন মাপার কোনো পদ্ধতি জানা ছিল না। সমস্যাটা একদম নতুন। তাহলে কী করা যায়?
ইনসুলিন প্রস্তুতকারক কোম্পানির কাছে সাহায্য চাইল পুলিশ। সেসময় ইনসুলিন প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো পণ্য পরীক্ষার জন্য এক অদ্ভুত পদ্ধতি ব্যবহার করত। সেটি মাউস কনভালশন মেথড নামে পরিচিত। এ পদ্ধতিতে তারা ইঁদুরের শরীরে ইনসুলিন ইনজেকশন দিত। ইঁদুরের তাদের রক্তে শর্করার মাত্রা কমে খিঁচুনিতে আক্রান্ত হয়ে কোমায় না যাওয়া পর্যন্ত তা চলত। ইনসুলিন বেশি হলে ইঁদুরের খিঁচুনি শুরু হয়ে প্রাণীটি কোমায় চলে যেত। গিনিপিগের ক্ষেত্রে একই ব্যাপার। এরাও ইনসুলিন পেলে ঘুমিয়ে পড়ত।
কিন্তু পুলিশ বিভাগের বিজ্ঞানীরা পরীক্ষাটি করতে পারত না। কারণ পশুদের উপর পরীক্ষা করার তাদের লাইসেন্স ছিল না। সৌভাগ্যবশত এলিজাবেথের শরীরের টিস্যুতে ইনসুলিন খোঁজার জন্য একটা প্রাইভেট ল্যাবরেটরি রাজি হলো। মৃত মানুষের দেহ থেকে ইনসুলিন বের করার পদ্ধতি খুঁজে বের করতে তারা সপ্তাহের পর সপ্তাহ চেষ্টা করতে লাগল। অবশেষে সফলতা এল। এলিজাবেথের নিতম্বের টিস্যু থেকে নির্যাস বের করে একটি ইঁদুরের উপর প্রয়োগ করা হলো। চোখের পলকে ইঁদুরটির খিঁচুনি শুরু হলো। পরে গ্লুকোজ দিতেই সুস্থ হলো ইঁদুরটা। কিন্তু একটা ইঁদুরের প্রমাণ দিয়ে তো আর আদালতে জেতা যায় না। তাই মোট বারোশো ইঁদুর এবং বেশ কটি গিনিপিগ ব্যবহার করে নিশ্চিত করা হলো যে এলিজাবেথের শরীরে মারাত্মক পরিমাণ ইনসুলিন ছিল।
সবশেষে চূড়ান্ত রিপোর্ট পাঠানো হলো ১৯৫৭ সালের ১৬ জুলাই। এলিজাবেথের মৃত্যুর কারণ হিসেবে লেখা হলো: ইনসুলিনের অতিরিক্ত ডোজের কারণে হাইপোগ্লাইসেমিক কোমা। এই কোমার মধ্যে পানিতে ডুবে মৃত্যু। এদিকে নিজের স্ত্রী খুনের দায়ে গ্রেফতার করা হলো কেনেথ বার্লোকে।
কিন্তু এই যুক্তিও ধোপে টিকল না। কারণ বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে অ্যাড্রেনালিন ইনসুলিন বাড়ায় না, বরং কমায়। পাঁচ দিনের বিচারের পর জজ জুরিদের বললেন, ‘এটা হয় খুন, নাহয় কিছুই না।
৪.
১৯৫৭ সালের ডিসেম্বরে আদালতে কেনেথ বার্লোর বিচার শুরু হলো। প্রসিকিউশন দুজন সাক্ষী হাজির করল— হ্যারি স্টর্ক এবং জোয়ান ওয়াটারহাউস। তারা কেনেথের প্রাক্তন সহকর্মী। তিন বছর আগে তারা কেনেথের সঙ্গে কথা বলেছিল। তাদের কথা শুনে সবাই চমকে গেল। হ্যারি একটা স্যানাটোরিয়ামে কেনেথের সঙ্গে কাজ করত। সেখানে ডায়াবেটিস রোগীদের ইনসুলিন দেওয়া হতো। হ্যারি সাক্ষ্য দিল, ‘কেনেথ আমাকে বলেছিল, ইনসুলিন দিয়ে নিখুঁতভাবে খুন করা যায়। এটা খুঁজে পাওয়া যায় না কারণ রক্তে মিশে যায়।’ দ্বিতীয় সাক্ষী জোয়ান ছিল নার্সিং স্টুডেন্ট। একবার কেনেথ তাকে বলেছিল, ‘ইনসুলিন দিয়ে কাউকে খুন করা যায়। শরীরে খুব বেশি না থাকলে এটা সহজে ধরা পড়ে না।’ সেন্ট লুক হাসপাতালের সিনিয়র নার্স মিস এলেন সিম্পসন আদালতে জানান, হাসপাতালে কাজ করার সময় কেনেথের ইনসুলিনের কাছে যাওয়ার সুযোগ ছিল। সে রোগীদের ইনসুলিন দিত। কতটা ইনসুলিন ব্যবহার করেছে, তার হিসাব রাখা হতো না।
প্রসিকিউশন বলল, কেনেথের খুনের মোটিভ ছিল। আর্থিক অবস্থা খারাপ থাকার কারণে সে আরেকটা সন্তান চাইত না। কাজেই কেনেথের কাছে ইনসুলিন ব্যবহারের সুযোগ, জ্ঞান ও উদ্দেশ্য সবই ছিল। কিন্তু কেনেথ সারাক্ষণ নিজেকে নির্দোষ দাবি করতে থাকে। তার একটাই যুক্তি: এলিজাবেথ নিজেই ইনসুলিন নিয়েছে। কিন্তু এই যুক্তি কেউ মানল না। কেনেথের পক্ষে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হবসন বললেন, ‘এলিজাবেথের শরীরে যে পরিমাণ ইনসুলিন পাওয়া গেছে, সেটা স্বাভাবিক। ভয় পেলে বা রেগে গেলে শরীরে অ্যাড্রেনালিন বের হয়। এতে ইনসুলিনের মাত্রা বেড়ে যায়। এলিজাবেথ যখন বুঝল যে সে ডুবে যাচ্ছে, তখন সে ভয় পেয়েছিল। এতেই ইনসুলিনের মাত্রা বেড়ে গেছে।’
কিন্তু এই যুক্তিও ধোপে টিকল না। কারণ বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে অ্যাড্রেনালিন ইনসুলিন বাড়ায় না, বরং কমায়। পাঁচ দিনের বিচারের পর জজ জুরিদের বললেন, ‘এটা হয় খুন, নাহয় কিছুই না। কেনেথ যদি জেনেবুঝে নিজের স্ত্রীকে ইনসুলিন দিয়ে থাকে, তাহলে সে খুন করতে চেয়েছিল।’ এরপর জুরিদের সিদ্ধান্ত নিতে সময় লাগল পঁচাশি মিনিট। তারা কেনেথকে দোষী সাব্যস্ত করল। জজ তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিলেন। বিচারক বলেন, বার্লো একজন ‘ঠান্ডা মাথার, নিষ্ঠুর এবং পূর্বপরিকল্পিত খুনি, যাকে উচ্চ মানের গোয়েন্দা তৎপরতা ছাড়া খুঁজে বের করা যেত না।’
সাতাশ বছর কারাভোগের পর ১৯৮৩ সালে কেনেথ বার্লো মুক্তি পায়। তখনও সে নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করত। কেনেথই ইতিহাসে প্রথম ব্যক্তি যে ইনসুলিনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে খুন করেছিল।
কেনেথ বার্লো জেলে যাওয়ার পর পুলিশ তার প্রথম স্ত্রী ন্যান্সির মৃত্যু নিয়ে নতুন তথ্য প্রকাশ করল। ন্যান্সিও নার্স ছিল। তাদের বিয়ে হয়েছিল বারো বছর আগে। ১৯৫৬ সালের ৯ মে ন্যান্সি হঠাৎ অসুস্থ হয়। বারো ঘন্টা পর সে মারা যায়। একটি বেনামী ফোন কলের কারণে পুলিশ তার শেষকৃত্য থামিয়ে ময়নাতদন্তের আদেশ দেয়। কিন্তু সেবার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। শুধু মস্তিষ্কে সামান্য ফোলাভাব ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়নি। পরে ন্যান্সিকে দাফন করা হয়। তার মৃত্যুর দুই মাস পর এলিজাবেথকে বিয়ে করে কেনেথ। এক বছরের মধ্যে এলিজাবেথও মারা গেল।
এলিজাবেথ ডুবে মারা গেলেও, তার মৃত্যুর জন্য দায়ী ইনসুলিন। ইনসুলিনের কারণে সে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। তারপর হয়তো কেনেথ তাকে পানির নিচে ডুবিয়ে রেখেছিল। অথবা সে নিজেই অজ্ঞান অবস্থায় পানিতে ডুবে গিয়েছিল।
সাতাশ বছর কারাভোগের পর ১৯৮৩ সালে কেনেথ বার্লো মুক্তি পায়। তখনও সে নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করত। কেনেথই ইতিহাসে প্রথম ব্যক্তি যে ইনসুলিনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে খুন করেছিল। কিন্তু এটা গর্বের কিছু নয়, বরং লজ্জাজনক। সে ভেবেছিল, যেহেতু এর আগে কেউ ইনসুলিন দিয়ে খুন করেনি, তাই পদ্ধতিটি সবার চোখ এড়িয়ে যাবে। কেউই তাকে সন্দেহ করবে না। কিন্তু তার চালাকি কাজে লাগেনি। এই অভিনব খুনের কৌশল তাকে আইনের হাত থেকে বাঁচাতে পারেনি। বিজ্ঞান ও আইনের জোরে শেষপর্যন্ত সে ধরা পড়ে। বারো শত ইঁদুর তার অপরাধের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
ইনসুলিন দিয়ে খুন করা সহজও নয়, নিরাপদও নয়। এটা করতে অনেক সময় লাগে। আবার হাইপোগ্লাইসেমিয়ার লক্ষণ সহজেই বোঝা যায়। আর এর চিকিৎসাও সহজ। শুধু গ্লুকোজ দিলেই হয়। আজকের দিনে ইনসুলিন পরীক্ষা করাও সহজ। কৃত্রিম ইনসুলিন আর প্রাকৃতিক ইনসুলিনের মধ্যে পার্থক্য করা যায়। তবুও ইনসুলিন দিয়ে প্রায় সত্তরটা খুনের ঘটনা ঘটেছে। বেশিরভাগ খুনিই ছিল ডাক্তার, নার্স বা স্বাস্থ্যকর্মী। কিন্তু কেউই শেষপর্যন্ত রেহাই পায়নি। বিজ্ঞান দিয়েই তাদের অপরাধ প্রমাণ করা সম্ভব হয়েছে। বিজ্ঞানের শক্তি অসীম। যতই জটিল অপরাধ হোক, সত্য একদিন না একদিন বেরিয়ে আসে। এলিজাবেথ আর কেনেথ বার্লোর এ ঘটনা তারই জলজ্যান্ত প্রমাণ।
