১৯২১ সালের গ্রীষ্মকাল। কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছোট্ট গবেষণাগারে কাজ করছিলেন এক তরুণ চিকিৎসক। নাম ফ্রেডরিক ব্যান্টিং। এর আগে তিনি কোনো গবেষণা করেননি, এটাই প্রথম। এ কাজে তাঁকে একেবারে আনাড়িই বলা চলে। কিন্তু তরুণটির চোখে অদ্ভুত এক স্বপ্ন সদাই ঝিকমিক করছে। তাঁর মাথা ভর্তি এক বিপ্লবী ভাবনা—অগ্ন্যাশয়ের একটা রহস্যময় রাসায়নিক যৌগ আলাদা করতে চান। ওই যৌগটিই মানুষের দেহে রক্তের চিনি বা গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। সেটা করা সম্ভব হলে, হয়তো ডায়াবেটিসের মতো মরণব্যাধি থেকে শত শত মানুষকে বাঁচানো যাবে।
সেসময় কারও ডায়াবেটিস হওয়া মানেই ছিল মৃত্যুর নিশ্চিত সনদ। বয়স্কদের পাশাপাশি অনেক শিশুও এ রোগে আক্রান্ত হতো। বিভিন্ন হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলো ভরে থাকত হাড্ডিসার, দুর্বল রোগীদের দিয়ে। আর একবার ডায়াবেটিস দেখা দিলে এসব শিশুদের বাবা-মা জানত যে তাদের সন্তানরা অচিরেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে।
সে সময় কিছু চিকিৎসক বলেছিলেন, ডায়াবেটিস হলে খাওয়া একেবারে কমিয়ে দিতে হবে। এ কথাকেই আপ্তবাক্য হিসেবে মেনে চলা হতো। কিন্তু তাতে রোগী কিছুদিন বাঁচত বটে, তবে সেটা ছিল ধীরে ধীরে অনাহারে মরার এক উপায়। আসলে চিকিৎসকদের হাতে তখন অন্য কোনো বিকল্প ছিল না। খাওয়া কমিয়ে দেওয়ার কারণে দেহের ওজন কমে রোগীরা হয়ে যেত কঙ্কালসার। তবে এটা শুধু উপসর্গ কমাত, আসল রোগ সারাত না। শিশুরা ধীরে ধীরে খাওয়া কমিয়ে, পানিতে তৃষ্ণায় কাতর হয়ে, রক্তে চিনি জমে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেত। চিকিৎসকরা তাকিয়ে থাকতেন অসহায়ভাবে। কারণ, তাদের হাতে কোনো কার্যকর চিকিৎসা ছিল না।
১৯১০ সালে স্যার এডওয়ার্ড অ্যালবার্ট শার্পে-শেফার বললেন, ‘ডায়াবেটিস রোগীদের অগ্ন্যাশয়ে কেবল একটি রাসায়নিকেরই অভাব থাকে। তিনি এই রাসায়নিকটির নাম দেন ইনসুলিন।
ডায়াবেটিস কেন হয়? তা নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছিল আরও প্রায় তিন দশক আগে। ১৮৮৯ সালে অস্কার মিনকোভস্কি এবং জোসেফ ফন মেরিং নামে দুই জার্মান গবেষক আবিষ্কার করেন, কুকুরদের শরীর থেকে অগ্ন্যাশয় গ্রন্থি কেটে বাদ দিলে তাদের ডায়াবেটিসের লক্ষণ দেখা দেয়। মারাও যায় দ্রুত। এ পরীক্ষার ফলে ধারণা করা হলো, অগ্ন্যাশয়েই ‘অগ্ন্যাশয়ের পদার্থ’ (বা ইনসুলিন) তৈরি হয়।
গবেষকেরা আরও অনুসন্ধান চালিয়ে অগ্ন্যাশয়ে বিশেষ কোষগুচ্ছ খুঁজে পান। এর নাম দেওয়া হয় আইলেটস অব ল্যাঙ্গারহ্যানস। অর্থাৎ ল্যাঙ্গারহ্যানসের দ্বীপপুঞ্জ। এই নামকরণ করা হয়েছিল জার্মান প্যাথলজিস্ট এবং জীববিজ্ঞানী পল ল্যাঙ্গারহ্যানসের সম্মানে। কারণ, ১৮৬৯ সালে অগ্ন্যাশয়ের এই কোষগুচ্ছ আবিষ্কার করেছিলেন তিনি।
যাই হোক, ১৯১০ সালে স্যার এডওয়ার্ড অ্যালবার্ট শার্পে-শেফার বললেন, ‘ডায়াবেটিস রোগীদের অগ্ন্যাশয়ে কেবল একটি রাসায়নিকেরই অভাব থাকে। তিনি এই রাসায়নিকটির নাম দেন ইনসুলিন। ল্যাটিন ইনসুলা (Insula) থেকে আসা এই শব্দের অর্থ দ্বীপ। কারণ, এ রসটি পাওয়া যায় অগ্ন্যাশয়ের আইলেট কোষে।’
গবেষকেরা একসময় বুঝতে পারেন, এ কোষগুলোই ইনসুলিন তৈরি করে। আর টাইপ ১ ডায়াবেটিসে এই কোষগুলোই ধ্বংস হয়ে যায়। টাইপ ১ ডায়াবেটিসের কারণ বুঝতে পারার ফলে গবেষকদের কাছে রোগটি চিকিৎসার দুয়ার খুলে গেল। এর আগে কয়েকজন অগ্ন্যাশয়ের কোষ পিষে ইনসুলিন বের করার অনেক চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সবাই ব্যর্থ হন। এখানে চ্যালেঞ্জটি ছিল, এমন এক উপায় খুঁজে বের করা, যার মাধ্যমে অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন বের করা যাবে, কিন্তু পুরো প্রক্রিয়ায় তা নষ্ট হবে না।
তরুণ ফ্রেডেরিক ব্যান্টিংয়ের এসব বিষয়ে কৌতূহল ছিল। ১৯২০ সালের অক্টোবরের এক রাতে এ সংক্রান্ত একটি গবেষণাপত্র পড়ছিলেন তিনি। সেখানে বলা হয়েছে, অগ্ন্যাশয়ের অন্য কোষের তুলনায় ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষগুলো ধীরে নষ্ট হয়। ব্যান্টিং বুঝতে পারলেন, এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অগ্ন্যাশয়কে এমনভাবে প্রক্রিয়াজাত করা যেতে পারে, যাতে শুধু ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষগুলোই অক্ষত থাকে। তিনি ভাবলেন, অগ্ন্যাশয়ের যে অংশ হজমের জন্য এনজাইম তৈরি করে, সেটিই হয়তো ইনসুলিন নামে জীবন রক্ষাকারী পদার্থটিকে নষ্ট করে ফেলে। তাই সিদ্ধান্ত নেন, কুকুরের অগ্ন্যাশয়ের নালী বেঁধে দিয়ে হজমকারী কোষগুলোকে ধ্বংস করে দেবেন। তারপর সেখান থেকে পদার্থটি নিষ্কাশন করবেন। কিন্তু কাজটা করবেন কীভাবে? তাঁর কোনো ল্যাব নেই, গবেষণার কোনো অভিজ্ঞতাও নেই। তাহলে উপায়?
১৯২২ সালের জানুয়ারি মাসের ঘটনা। টরেন্টো জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল ১৪ বছরের এক কিশোর। নাম লিওনার্ড থম্পসন। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে গিয়েছিল ছেলেটি।
একটা উপায়ের খোঁজে ছুটে গেলেন অধ্যাপক জন ম্যাকলিওডের সঙ্গে। ম্যাকলিওড তখন টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিওলজি বিভাগের প্রধান। এই যুগান্তকারী ভাবনা নিয়ে তাঁর সঙ্গে ৭ নভেম্বর দেখা করলেন ব্যান্টিং। ম্যাকলিওড শুরুতে সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু ব্যান্টিংয়ের উদ্যম এবং গবেষণার গুরুত্ব অনুধাবন করে শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন। ব্যান্টিংকে গবেষণার জন্য একটি ল্যাব, দশটি কুকুর এবং চার্লস বেস্ট নামে এক মেডিকেল ছাত্রকে সহকারী হিসেবে দেন ম্যাকলিওড।
১৯২১ সালের গ্রীষ্মকালে ব্যান্টিং ও বেস্ট দিনরাত এক করে কাজ শুরু করলেন। একে দুঃসাহসী পরীক্ষাই বলতে হয়। তাঁরা কুকুরের অগ্ন্যাশয়ের নালী বন্ধ করে দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন। কয়েক সপ্তাহ পর দেখা গেল, অগ্ন্যাশয়ের পাচক এনজাইম তৈরি করা অংশগুলো নষ্ট হয়ে গেছে, কিন্তু আইলেটস অব ল্যাঙ্গারহানস নামে বিশেষ কোষগুলো রয়ে গেছে। কোষগুলো থেকে নিষ্কাশন করলেন এক বিশেষ রস। শুরুতে এর নাম দেওয়া হলো আইলেটিন।
এই রস ডায়াবেটিক আক্রান্ত একটা কুকুরের শরীরে প্রয়োগ করতেই ঘটল অবিশ্বাস্য ঘটনা। কুকুরটির রক্তে চিনির পরিমাণ নাটকীয়ভাবে কমে গেল এবং সে সুস্থ হয়ে উঠল। ব্যান্টিং এবং বেস্ট বুঝতে পারলেন, তাঁরা এমন কিছু আবিষ্কার করেছেন যা লাখো মানুষের জীবন বাঁচাতে পারে। পরে এই পদার্থের নাম দেওয়া হয় ইনসুলিন।
প্রশ্ন হলো, ইনসুলিন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত কুকুরের রক্তে শর্করার মাত্রা কমিয়ে দিতে পারলেও সেটা কি মানুষের ক্ষেত্রেও একই ফল দিতে পারবে? ইনসুলিন আবিষ্কারের পর এই প্রশ্নটাই ঘুরপাক খাচ্ছিল ব্যান্টিংয়ের মনে। সে প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাওয়া গেল কয়েক দিন পরেই।
১৯২২ সালের জানুয়ারি মাসের ঘটনা। টরেন্টো জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল ১৪ বছরের এক কিশোর। নাম লিওনার্ড থম্পসন। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে গিয়েছিল ছেলেটি। অনাহারে থাকতে থাকতে চোখে-মুখে ফুটে উঠেছিল হাড়ের ছায়া। দেহেও কোনো শক্তি ছিল না। তার ওজন দাঁড়িয়েছিল মাত্র ৩০ কেজি—বয়সের তুলনায় অর্ধেক। ডাক্তাররাও ততদিনে হাল ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁরা ছেলেটির বাবা-মাকেও জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের আর কিছুই করার নেই।
এই আবিষ্কারের জন্য ১৯২৩ সালে ফ্রেডেরিক ব্যান্টিংয়ের সঙ্গে যৌথভাবে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান অধ্যাপক জন ম্যাকলিওড। অবশ্য ম্যাকলিওড এ গবেষণায় সরাসরি অংশ নেননি।
ঠিক এ সময় সেখানে নতুন আবিষ্কারটা নিয়ে হাজির হলেন ব্যান্টিং এবং বেস্ট। একটা দ্বিধা নিয়ে ১১ জানুয়ারি (১৯২২ সাল) প্রথম ইনজেকশনটি দেওয়া হলো লিওনার্ড থম্পসনকে। কিন্তু সেটা তেমন কাজ করল না, বরং তার দেহে এলার্জিও দেখা দিল। আসলে প্রথম ইনসুলিন ততটা বিশুদ্ধ ছিল না। ঠিক এ সময় দৃশ্যপটে এগিয়ে আসেন জেমস কলিপ।
ব্যান্টিং এবং বেস্টের আবিষ্কারে বড় সীমাবদ্ধতা ছিল, কুকুরের অগ্ন্যাশয় থেকে পাওয়া ইনসুলিন মানুষের ব্যবহারের জন্য যথেষ্ট ছিল না। আবার সেটি বিশুদ্ধও নয়। এই পর্যায়ে এ প্রকল্পে বায়োকেমিস্ট জেমস কলিপকে নিযুক্ত করেন ম্যাকলিওড। কলিপ নির্যাসটিকে বিশুদ্ধ করার দায়িত্ব নেন। তিনি একটানা ১২ দিন খেটে গরুর প্যানক্রিয়াস থেকে ইনসুলিন সংগ্রহ ও বিশুদ্ধ করেন। এরপর ২১ জানুয়ারি দ্বিতীয়বার এই পরিশোধিত ইনজেকশন দেওয়া হলো লিওনার্ডকে। এবার অবস্থার নাটকীয় পরিবর্তন ঘটল। তার রক্তে চিনির পরিমাণ কমে গেল। সে খেতে শুরু করল। আস্তে আস্তে ফিরে আসতে লাগল তার স্বাস্থ্যও। যে ছেলেটি কয়েক সপ্তাহ আগে মৃত্যুর দিন গুনছিল, সে এখন আবার জীবনের স্বাদ পেতে শুরু করল।
এই সাফল্যের খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল সারা বিশ্বে। বিভিন্ন হাসপাতালে যেসব শিশু ও প্রাপ্তবয়স্করা মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছিলেন, তাদের কাছে এল নতুন আশার আলো। বাবা-মায়েরা সন্তানদের নিয়ে ছুটে এলেন টরেন্টোতে। যেখানে একসময় হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলো ভরে থাকত মৃত্যুপথযাত্রী রোগীদের দিয়ে, সেখানে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। শিশুরা সুস্থ হয়ে আবার খেলতে শুরু করল। প্রাপ্তবয়স্করা ফিরে যেতে লাগল স্বাভাবিক জীবনে।
রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে ইনসুলিন নামের হরমোন। লিভারের কাছে পেটের নিচে কলার মতো দেখতে একটা অঙ্গাণু আছে, একে বলে অগ্ন্যাশয়। রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে গেলে অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইনসুলিন নিঃসরণ করে।
এই আবিষ্কারের জন্য ১৯২৩ সালে ফ্রেডেরিক ব্যান্টিংয়ের সঙ্গে যৌথভাবে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান অধ্যাপক জন ম্যাকলিওড। অবশ্য ম্যাকলিওড এ গবেষণায় সরাসরি অংশ নেননি। তাই তাঁর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি নিয়ে কিছুটা বিতর্ক রয়েছে। তবে এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের পথ সুগম করতে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর তত্ত্বাবধান ও সহযোগিতার কারণেই ব্যান্টিং এবং বেস্টের পক্ষে গবেষণাটি চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছিল।
ইনসুলিন কীভাবে কাজ করে
প্রশ্ন হলো, ইনসুলিন কীভাবে কাজ করে? আমরা কার্বোহাইড্রেট বা শর্করাজাতীয় যেসব খাবার খাই, তা পেটে এনজাইমের মাধ্যমে ভেঙে গ্লুকোজে পরিণত হয়। সেগুলোই রক্তে মিশে যায়।
সাধারণত দেহে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থাকে। এই মাত্রা খুব কম হলে মস্তিষ্ক ও দেহের স্বাভাবিক কাজ বাধা পায়। আবার রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা খুব বেশি হলেও আমাদের স্নায়ু ও চোখের ক্ষতি হয়। মস্তিষ্ক গ্লুকোজ ছাড়া স্বাভাবিক কাজ চালাতে পারে না। কিন্তু মস্তিষ্কে গ্লুকোজ জমা রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই রক্ত থেকে সেখানে ক্রমাগত গ্লুকোজের যোগান দিতে হয়। কোনো কারণে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে অর্ধেক হয়ে গেলে হাত-পা অবশ হয়ে যায়। মস্তিষ্ক ধীর হয়ে যায়, চিন্তা প্রক্রিয়া হয় বাধাগ্রস্ত। এ সময় দেহ ঘামতে থাকে, হৃদপিণ্ড দ্রুত কাজ করে, গলার স্বরও বদলে যায়। আবার দৃষ্টি হয়ে যায় ঝাপসা। সবশেষে কোমায় চলে যেতে পারে রোগী। এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।
রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে ইনসুলিন নামের হরমোন। লিভারের কাছে পেটের নিচে কলার মতো দেখতে একটা অঙ্গাণু আছে, একে বলে অগ্ন্যাশয়। রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে গেলে অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইনসুলিন নিঃসরণ করে। ইনসুলিন রক্তে থাকা গ্লুকোজের পরিমাণ কমিয়ে দেয় এবং গ্লুকোজকে দেহের বিভিন্ন কোষে ঢুকতে সহায়তা করে। আসলে রক্তের গ্লুকোজ দেহকোষগুলোর জন্য জ্বালানি হিসেবে কাজ করে। কিন্তু গ্লুকোজ একা একা কোষে ঢুকতে পারে না—তার জন্য দরকার ইনসুলিন। ইনসুলিন এক ধরনের চাবির মতো কাজ করে। এটাই কোষের দরজা খুলে দেয়, যাতে গ্লুকোজ ভেতরে ঢুকতে পারে। এভাবে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে ইনসুলিন।
সাধারণত খাবার পর আমাদের রক্তে গ্লুকোজ বেড়ে গেলে অগ্ন্যাশয় ইনসুলিন নিঃসরণ করে। তাই এ সময় রক্তের গ্লুকোজ দ্রুত কমে যায়। কিন্তু দেহে ইনসুলিন কাজ না করলে কিংবা যথেষ্ট ইনসুলিন না থাকলে গ্লুকোজ রক্তেই থেকে যায়, কোষে ঢুকতে পারে না। এতে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায়। একে আমরা ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র রোগ বলি। ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে এই ইনসুলিন হয় তৈরি হয় না, অথবা ঠিকমতো কাজ করে না। টাইপ ১ ডায়াবেটিসে অগ্ন্যাশয় একেবারেই ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না। এটি সাধারণত শিশু ও তরুণদের মধ্যে দেখা যায়। আর টাইপ ২ ডায়াবেটিসে অগ্ন্যাশয় কিছু ইনসুলিন তৈরি করলেও তা যথেষ্ট নয়, অথবা কোষগুলো ইনসুলিনের প্রতি সংবেদনশীলতা হারিয়ে ফেলে। দুই ক্ষেত্রেই রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে নানা জটিলতা তৈরি করে। সে কারণেই রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে ডায়াবেটিস রোগীরা ইনসুলিন ইনজেকশন নেন।
বিশ্বের প্রায় ৪৫ কোটি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এর মধ্যে কোটি কোটি মানুষ প্রতিদিন ইনসুলিনের ওপর নির্ভর করে এখন স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছেন। যে রোগটি একসময় মৃত্যুর নিশ্চিত কারণ ছিল, আজ সেটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য।
ইনসুলিনের নিছক কোনো আবিষ্কার ছিল না, এটি ছিল মানবিকতার জয়। কারণ, ব্যান্টিং এবং তাঁর সহকর্মীরা এ আবিষ্কারের পেটেন্ট মাত্র এক ডলারে বিক্রি করেছিলেন, যাতে সবাই এর সুবিধা পেতে পারে। তাঁরা বলেছিলেন, ইনসুলিন আমাদের নয়, এটি বিশ্বের সকল মানুষের।’ এই মহৎ সিদ্ধান্তের কারণে আজ পর্যন্ত কোটি কোটি মানুষ বেঁচে থাকতে পারছে।
একশ বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও ইনসুলিনের গল্প শেষ হয়নি। আধুনিক বিজ্ঞানীরা নতুন ধরনের ইনসুলিন তৈরি করেছেন। সেগুলো আরও কার্যকর ও দীর্ঘস্থায়ী। আজ ইনসুলিন পাওয়া যায় নানা রকম ফর্মে—ইনজেকশন, পেন, এমনকি ইনসুলিন পাম্পও। এখন আর ইনসুলিন নেওয়ার জন্য রোগীকে হাসপাতালে যেতে হয় না, বাড়িতে বসে নিজেরাই চিকিৎসা নিতে পারেন।
ইনসুলিন পাম্পের মতো আরও উন্নত প্রযুক্তিও এসেছে। এটি রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ অনুযায়ী স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইনসুলিন সরবরাহ করে। আবার কৃত্রিম অগ্ন্যাশয়ের মতো প্রযুক্তির নিয়েও চলছে গবেষণা। এটি সফল হলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। আবার স্টেম সেল গবেষণার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা নতুন বিটা কোষ তৈরির চেষ্টা করছেন। সেটা ইনসুলিনের চিরস্থায়ী সমাধান দিতে পারে।
সাধারণত খাবার পর আমাদের রক্তে গ্লুকোজ বেড়ে গেলে অগ্ন্যাশয় ইনসুলিন নিঃসরণ করে। তাই এ সময় রক্তের গ্লুকোজ দ্রুত কমে যায়। কিন্তু দেহে ইনসুলিন কাজ না করলে কিংবা যথেষ্ট ইনসুলিন না থাকলে গ্লুকোজ রক্তেই থেকে যায়, কোষে ঢুকতে পারে না।
বিশ্বের প্রায় ৪৫ কোটি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এর মধ্যে কোটি কোটি মানুষ প্রতিদিন ইনসুলিনের ওপর নির্ভর করে এখন স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছেন। যে রোগটি একসময় মৃত্যুর নিশ্চিত কারণ ছিল, আজ সেটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য। এই সবকিছুর পেছনে রয়েছে সেই ১৯২১ সালের গ্রীষ্মের দিনগুলোতে একটি ছোট্ট গবেষণাগারে ঘটে যাওয়া অলৌকিক আবিষ্কার। তাই অনেকে বলেন, ইনসুলিন শুধু ওষুধ নয়, এটি মানব ইতিহাসের অন্যতম বড় আবিষ্কার।
সবশেষে প্রথম ইনসুলিন নেওয়া লিওনার্ড থম্পসনের কথাটা বলা দরকার। সেই ছেলেটি নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসে বেঁচে ছিল আরও ১৩ বছর।
