আমের সাতসতেরো

আম বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌসুমি ফল। বর্তমানে এ দেশে অনেক ধরনের ফল জন্মাতে দেখা যায়। এসব ফলের মধ্যে আমের উত্পাদন এবং জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি। আম ছোট-বড় সবার পছন্দের ফল। কাঁচা ও পাকা—দুই রকমই খাওয়া হয়। প্রতিবছরই এ দেশে আম চাষাবাদের এলাকা এবং উত্পাদন বাড়ছে। ফলে আমের প্রক্রিয়াজাতকরণ সম্ভাবনাও বেশি।

বর্তমানে দেশের ২৩টি জেলায় আমের বাণিজ্যিক চাষাবাদ হচ্ছে। এর মধ্যে শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় ৩৮ হাজার হেক্টর জমিতে আমের চাষ হচ্ছে এবং উত্পাদন প্রায় সোয়া ৩ লাখ মেট্রিক টন। রাজশাহী জেলায় ১৮ হাজার হেক্টর ও নওগাঁ জেলায় ২৩ হাজার হেক্টর জমিতে আমের চাষ হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সারা দেশে প্রায় দুই লাখ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়। মোট উত্পাদন ২৫ লাখ মেট্রিক টন। তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বিবিএস-২১ অনুসারে, এ দেশে ৯৫ হাজার ২৮৩ হেক্টর জমিতে ১২ দশমিক ২২ লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদিত হচ্ছে।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ দুটি প্রতিষ্ঠান আম উৎপাদনের দুই ধরনের তথ্য প্রকাশ করছে। বিবিএসের তথ্য বিবেচনায় বাংলাদেশ বিশ্বে আম উৎপাদনে সপ্তম। কিন্তু ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন অব ইউএস বা এফওর তথ্য অনুযায়ী, আম উৎপাদনের পরিমাণ ও বিশ্বে বাংলাদেশে অবস্থান আরেকটু নিচে। এর কারণ, তথ্যের ঘাটতি। সঠিক তথ্য প্রকাশ পেলে বাংলাদেশ আম উৎপাদনে আরও দুই ধাপ এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এ দেশে উত্পাদিত আমের ৯০ ভাগই তাজা অবস্থায় ব্যবহার হয়ে থাকে এবং ১০ ভাগ প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজে ব্যবহৃত হয়।

আম অত্যন্ত পুষ্টিকর ফল। খাদ্যমানের দিক থেকে অন্যান্য দেশীয় ফলের মধ্যে আমের স্থান অনেক ওপরে। পাকা আমে যথেষ্ট পরিমাণে ক্যারোটিন বা ভিটামিন এ থাকে। ভিটামিন এ-এর বিবেচনায় আমের স্থান পৃথিবীর প্রায় সব ফলের শীর্ষে। আমে ভিটামিন সি-এর পরিমাণও সন্তোষজনক। কাঁচা ও পাকা আমে ভিটামিন সি পাওয়া যায়। তবে কাঁচা আমে ভিটামিন সি-এর পরিমাণ বেশি। গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, কাঁচা আমে পাকা আমের চেয়ে দেড় গুণ বেশি ভিটামিন সি থাকে। গুটি থেকে শুরু করে আঁটি হওয়া পর্যন্ত প্রচুর আম ঝরে যায়। উপযুক্ত পরিচর্যায় ব্যবহারের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। ফলে ভিটামিন সি–এর ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া ১৬৫ গ্রাম সদ্য সংগ্রহ করা পাল্পে ৯৯.০ ক্যালরি শক্তি, ১.৩৫ গ্রাম প্রোটিন, ০.৬৩ গ্রাম চর্বি, ২৪.৭ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ২২.৫ গ্রাম সুগার ও ২.৬৪ গ্রাম আঁশ থাকে।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

দেশের বিভিন্ন এলাকায় আমের চাষাবাদ হলেও দেশের উত্তরাঞ্চলে আমের ফলন ও গুণগত মান ভালো। সবার মনে একটি কথা প্রায়ই আসে, কেন উত্তরাঞ্চলে আমের ফলন ও গুণগত মান ভালো। আমের ফলন ও গুণগত মান নির্ভর করে মাটি ও আবহাওয়ার ওপর। এ ছাড়া বাগান ব্যবস্থাপনা আমের গুণগত মানকে প্রভাবিত করে।

আমের ফুল আসা থেকে ফল সংগ্রহ পর্যন্ত আবহাওয়া আমের ফলন ও গুণমানকে প্রভাবিত করে। ফুল আসার আগের দুই মাস আবহাওয়া যত ঠান্ডা থাকবে, গাছের পুষ্পায়ন তত ভালো হবে। ফুলের বৃদ্ধির সময় শুষ্ক আবহাওয়া পুষ্পমঞ্জরির বৃদ্ধি ও ফল ধারণে ভূমিকা রাখে। কিন্তু এ সময়ে বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ বেশি হলে বিভিন্ন ধরনের রোগ ও পোকার আক্রমণ দেখা দেয়। এ ছাড়া ফল বেড়ে ওঠার সময় ঝড়-বৃষ্টি কম হলে ভালো মানের আম পাওয়া যায়। মাটির অম্লত্ব; অর্থাৎ পিএইচ (pH) মান ৫.৮-৮.০ হলে আমের মান ভালো হয়। শুষ্ক মাটির গাছের আমের মিষ্টতা বেশি হয়। ফল পাকার সময় রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়া ও উচ্চ তাপমাত্রার কারণে বায়োকেমিক্যাল কার্যকলাপ দ্রুত হয় এবং সুগারের পরিবর্তন বেশি হয়। ফলে আম বেশি মিষ্টি হয়। মূলত এসব কারণেই দেশের উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমের অঞ্চলে এত বাহারি ও সুস্বাদু আম জন্মায়।

লেখক: ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ফল বিভাগ, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, বারি, গাজীপুর

*লেখাটি ২০২২ সালে বিজ্ঞানচিন্তার মে সংখ্যায় প্রকাশিত