আমরা কেন ডলফিনের মাংস খাই না
আমরা ডলফিন ভালোবাসি। প্রাণী হিসেবে এরা অসাধারণ। কিন্তু পৃথিবীতে এমন অনেক দেশ আছে, যেখানে প্রায় সব ধরনের প্রাণীই খাওয়া হয়। ঘানায় কুকুর, সুইজারল্যান্ডে বিড়াল, চীনে বিপন্ন হাঙরের পাখনা, ফ্রান্সে বিশেষ প্রক্রিয়ায় বানানো হাঁসের কলিজা। আসলে তালিকাটা বেশ লম্বা। তবে তিমি বা ডলফিনের মাংস খাওয়া নিয়ে বিতর্কটা একটু বেশি। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই ডলফিনের মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ।
এই তালিকার ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। যেমন, জাপান। তবে জাপানেও খুব কম মানুষই ডলফিনের মাংস খাওয়ার কথা স্বীকার করেন। আর এটা শুধু ডলফিনদের জন্যই নয়, বরং যারা খাচ্ছে তাদের জন্যও একটা বিরাট সৌভাগ্যের ব্যাপার! কারণ, ডলফিনের মাংসে আছে বিষ! নির্দিষ্টভাবে বললে, মার্কারি বা পারদ।
অস্ট্রেলিয়ার একটি অলাভজনক সংস্থা অ্যাকশন ফর ডলফিনস ২০২৩ সালের নভেম্বরে এক ভয়ঙ্কর তথ্য প্রকাশ করেছে। তারা জাপানের রিসো’স ডলফিনের মাংস পরীক্ষা করে দেখেছে, তাতে পারদের মাত্রা ১০৬ পিপিএম (ppm)।
পিপিএম মানে পার্টস পার মিলিয়ন। অর্থাৎ, প্রতি দশ লাখে কত অংশ কোনো নির্দিষ্ট পদার্থ আছে, তা বোঝায়। এক লিটার পানিতে যদি পারদের পরিমাণ ১ পিপিএম হয়, তাহলে বুঝতে হবে সেই এক লিটার পানিতে মাত্র এক মিলিগ্রাম পারদ আছে।
অস্ট্রেলিয়ার একটি অলাভজনক সংস্থা অ্যাকশন ফর ডলফিনস ২০২৩ সালের জাপানের রিসো’স ডলফিনের মাংস পরীক্ষা করে দেখেছে, তাতে পারদের মাত্রা ১০৬ পিপিএম।
জাপানের সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, এই মাত্রা ০.৪ পিপিএমের বেশি হওয়া চলবে না। অর্থাৎ, ওই মাংসে পারদ ছিল অনুমোদিত সীমার চেয়ে ২৬৫ গুণ বেশি!
এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ২০২৩ সালের শুরুতেও ‘ইয়াহু! জাপান’ সাইটে বিক্রি হওয়া ডলফিনের মাংসে পারদ পাওয়া গেছে অনুমোদিত সীমার চেয়ে ৯৭ গুণ বেশি। ২০১৫ সালেও একই জায়গা থেকে মাংসে পারদ মিলেছিল প্রায় ৫০ গুণ বেশি।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কেলেঙ্কারিটা ঘটেছিল ২০০৭ সালে। জাপানের যেখানে ডলফিন খায়, সেখানকার স্কুলের বাচ্চাদের যে মাংস খাওয়ানো হচ্ছিল, তাতে পারদ ছিল অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে ১০ থেকে ১৬ গুণ বেশি! একজন স্থানীয় কাউন্সিলর তখন ক্ষোভের সঙ্গে বলেছিলেন, এই মাংস আসলে বিষাক্ত বর্জ্য।
ডলফিনের মাংসে এত পারদ এল কোথা থেকে
মাংসে পারদ থাকার প্রধান কারণ খাদ্য শৃঙ্খল। ডলফিন সমুদ্রের খাদ্য শৃঙ্খলের একেবারে শুরুর দিকের প্রাণী। ফরাসি সমুদ্রবিজ্ঞানী লার্স-এরিক হাইমবুর্গার-বোয়াভিদা ব্যাপারটা খুব সহজ করে বুঝিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘খাদ্যশৃঙ্খলে আপনি যত ওপরে উঠবেন, পারদের ঘনত্ব তত বাড়তে থাকবে।’
সমুদ্রের পানিতে পারদ থাকে খুবই সামান্য, ৫০ মিলিয়ন লিটার পানিতে মাত্র ০.৫ মিলিগ্রাম। কিন্তু টুনা বা সোর্ডফিশের মতো বড় শিকারি মাছ যখন সেই পানি থেকে খাদ্য গ্রহণ করে, তাদের শরীরে সেই পারদ জমা হয় প্রতি কেজিতে ০.৫ মিলিগ্রাম। অর্থাৎ, ঘনত্ব বেড়ে যায় প্রায় ৫ কোটি গুণ!
২০২৩ সালের শুরুতেও ‘ইয়াহু! জাপান’ সাইটে বিক্রি হওয়া ডলফিনের মাংসে পারদ পাওয়া গেছে অনুমোদিত সীমার চেয়ে ৯৭ গুণ বেশি।
ডলফিন যেহেতু ওই টুনা বা সোর্ডফিশের মতো বড় মাছ খায়, তার শরীরে পারদের মাত্রা বেড়ে গেছে। ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের চিকিৎসকেরা হুঁশিয়ার করে বলেছেন, এই মিথাইলমার্কারি একটি ভয়াবহ বিষ। এটি গর্ভবতী মায়েদের পেটে থাকা শিশুর মস্তিষ্কের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। শিশুদের জন্য এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক। এমনকি মায়ের বুকের দুধের মাধ্যমেও এই বিষ শিশুর শরীরে যেতে পারে। দীর্ঘদিন এই বিষ শরীরে গেলে তা প্রাণঘাতী হতে পারে।
সুতরাং, আপনি যত কৌতূহলীই হোন না কেন, ডলফিনের মাংস এড়িয়ে চলাই ভালো। তাছাড়া, যারাই এই মাংস খেয়েছেন, তাঁরা জানিয়েছেন, ডলফিনের মাংস খেতে মোটেই সুস্বাদু নয়। এটা মোটেই খেতে মাছের মতো নয়।