ডেঙ্গু চিকিৎসায় পেঁপেপাতার রস

প্রচলিত গ্রামীণ ধারণা হলো, ডেঙ্গু হলে পেঁপেপাতার রস বা পাতাভর্তা খেলে উপকার হয়। কিন্তু ডেঙ্গু চিকিৎসায় পেঁপেপাতা বা এর অন্য কোনো অংশ কি আসলেই কাজে লাগে? বিষয়টি বিস্তারিত জেনে নিন...

পেঁপেছবি: সংগৃহীত

ডেঙ্গু চিকিৎসায় পেঁপেপাতা বা এর অন্য কোনো অংশ কি কাজে লাগে? বিষয়টি বোঝার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যবিষয়ক সরকারি ওয়েব ডেটাবেজ ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনে উঁকি দিলাম। যেহেতু ওয়েব ডেটাবেজ, তাই সশরীর নয়, উঁকি দিয়েছি অনলাইনে। নথিভুক্ত গবেষণা ও বৈজ্ঞানিক নিবন্ধগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেল, ডেঙ্গু চিকিৎসায় পেঁপেপাতা বা এর অন্যান্য অংশের ব্যবহারসংক্রান্ত পাঁচ শতাধিক এন্ট্রি রয়েছে। তার মধ্যে উচ্চ মানসম্পন্ন বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশিত নিবন্ধের সংখ্যা ৬০টির বেশি। উল্লেখিত ডেটাবেজ শুধু যুক্তরাষ্ট্রের নয়, সারা বিশ্বের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাবিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাগুলোর সংকলন হিসেবে ভূমিকা রাখে। বিশ্বব্যাপী চিকিৎসক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা এই ডেটাবেজ প্রতিনিয়ত ব্যবহার করেন।

ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনে নথিভুক্ত গবেষণাগুলো অনুসারে কয়েকটি তথ্য উল্লেখ করা যাক।

সীমিতসংখ্যক রোগীর ওপর ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে দেখা গেছে, ডেঙ্গু চিকিৎসায় পেঁপেপাতার রস ব্যবহার করার পর প্লেটলেটের (ভুল করে অনেকে প্লাটিলেট বলেন) সংখ্যা বাড়ে এবং ডেঙ্গি শক সিনড্রোম (মারাত্মক প্রাণঘাতী ধরনের ডেঙ্গু) হওয়ার ঝুঁকি কমে। তবে ব্যাপক আকারে এ বিষয়ে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এখনো হয়নি। তাই এর ফলাফল সম্পর্কে খুব বেশি আত্মবিশ্বাসী হওয়ার সময় আসেনি এখনো। এমনও হতে পারে, বেশির ভাগ ডেঙ্গু রোগীর প্লেটলেট এমনিতেই কিছুদিন পর বেড়ে স্বাভাবিক হয়ে যায়, সেটিই এখানে হয়েছে। তা ছাড়া, ডেঙ্গুতে আলাদা করে প্লেটলেটের সংখ্যা বৃদ্ধি করলে স্রেফ তার একটি লক্ষণের চিকিৎসা করা হয়। এতে রোগীর সার্বিক ডেঙ্গু রোগের কোনো উপকার হয় কি না কিংবা তার শরীরে বাইরে থেকে প্লেটলেট প্রবেশ করানোর প্রয়োজনীয়তা কমে যায় কি না, সেটা এখনো পরিষ্কার নয়।

আরও পড়ুন

পেঁপেপাতার রসের মধ্যে ঠিক কোন উপাদান এই ঔষধি গুণের জন্য দায়ী, সেটা আলাদা করা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। না হলে কোনো প্রমিতকরণ বা স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন সম্ভব নয়। অর্থাৎ নির্দিষ্ট মাত্রায় বা ডোজ নির্ধারণ করে চিকিৎসায় তা ব্যবহার করা যাবে না। হয়তো কোনো একটা জাতের পেঁপেপাতায় অন্য জাতের তুলনায় কোনো একটা কার্যকর উপাদান কম বা বেশি আছে। তাই ভিন্ন জাত থেকে বা ভিন্ন উপায়ে রস বানালে সেই উপাদানের মাত্রার হেরফের ঘটে। এসব কারণে চিকিৎসায় আদৌ কোনো ফল হলো নাকি সেটা ওই অজানা উপাদানের পার্থক্যের কারণে ঘটল, তা বোঝা যাবে না। কার্যকর ঔষধি উপাদান ও তার কার্যকারিতা নিয়ে ইতিমধ্যে যে গবেষণা হয়েছে, তাতে এখনো সর্বসম্মতিক্রমে কোনো স্থির সিদ্ধান্তে আসা যায়নি যে কোন উপাদান বা উপাদানগুলো প্রকৃতপক্ষে ডেঙ্গু রোগের উপশমে সাহায্য করতে পারে। উপাদান-নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে করা বেশির ভাগ গবেষণা এখনো কম্পিউটার সিমুলেশন বা ইন-সিলিকো ধাপে রয়েছে। সেখান থেকে প্রাণিদেহে ট্রায়াল শেষে মানবদেহের ট্রায়াল শুরু হতে এখনো অনেক সময় লাগবে।

প্রাথমিক তথ্য-উপাত্ত অনুসারে পেঁপেপাতা বেশির ভাগ রোগীর ক্ষেত্রে নিরাপদ, তবে সবার ক্ষেত্রে নয়। গর্ভাবস্থায় বিকাশমান ভ্রূণের ওপর এর বিরূপ প্রভাব নেই, এমনটি বলা যায় না। যাঁরা লিভারের কোনো অসুখে ভুগছেন, তাঁদের জন্য পেঁপেপাতা বা যেকোনো হারবাল ওষুধ বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। ডায়াবেটিক রোগী, বিশেষত যাঁরা রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমানোর জন্য ওষুধ ব্যবহার করেন, তাঁদের বেলায় পেঁপেপাতা ব্যবহারে হঠাৎ করে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা অনেক বেশি হারে কমে গিয়ে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হতে পারে, যা কখনো কখনো প্রাণঘাতী। তাই রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া আপাতত পেঁপেপাতা ব্যবহার না করা ভালো।

আরও পড়ুন

ডেঙ্গু যেহেতু পশ্চিমা বিশ্বের কোনো গুরুতর সমস্যা নয়, কেবল আফ্রিকা ও এশিয়ার নিম্ন থেকে মধ্যম আয়ের দেশগুলোর জন্য একটা হুমকি, তাই এটা নিয়ে বিশ্ব পরিসরে গবেষণা বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে না। আলোচনার শুরুতে যতগুলো গবেষণার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্ত অপ্রতুল। বাংলাদেশসহ যেসব দেশে ডেঙ্গুর মোকাবিলা করা বেশি জরুরি, দুঃখজনকভাবে সেসব দেশে চিকিৎসাসংক্রান্ত গবেষণায় বরাদ্দ অপ্রতুল। গবেষণার পরিবেশও অনুকূল নয়। আমরা যত দিন না বিজ্ঞানকে আপন করে নিতে পারছি, তত দিন কোভিড অতিমারির মতো বৈশ্বিক সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারলেও ডেঙ্গুর মতো ‘স্থানীয়’ সমস্যা থেকে আমাদের কেউ উদ্ধার করবে না।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা