কেমন আছেন?
নূর মোহাম্মদ: ভালো আছি।
বাংলাদেশের পত্রিকা ও টেলিভিশনে আপনাকে নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কেমন লাগেছে?
নূর মোহাম্মদ: ভালোই লেগেছে। আমি সবার প্রতি কৃতজ্ঞ।
ধানের জাত উদ্ভাবনের কাজটা কখন শুরু করলেন?
নূর মোহাম্মদ: ছোটবেলায় বাবাকে জমিতে ধান চাষ করতে দেখেছি। তখন তাঁকে ছোট ছোট কাজে সাহায্য করতাম। আমিও তাঁর মতো এক পাশে আলাদা একটু জমি নিয়ে নিজের মতো ধান লাগাতাম। এভাবেই আমার ধান চাষের শুরু। আমাদের বরেন্দ্র এলাকা খরাপ্রবণ। সেখানে ধান চাষ করা কঠিন। প্রতিবছর আমাদের ধান নষ্ট হয়ে যায়। এই ধান রক্ষা করার জন্যই আমি ধান নিয়ে গবেষণা শুরু করি। ২০০৫ সালের পর থেকে নতুন জাত উদ্ভাবন করতে শুরু করি। উৎপাদন বৃদ্ধির স্বার্থে উন্নত ধানের জিন সংমিশ্রণ করে আধুনিক ও উচ্চফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন করা হয়। এই উদ্ভাবনের কাজটা আমি শিখেছি রাজশাহী ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের হেলাল উদ্দিন আহমেদের কাছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিকস বিভাগের প্রধান নুরুল মতিনের কাছেও কাজ শিখেছি। আমার উদ্ভাবন করা ধানগুলো মজবুত, সহজে হেলে পড়ে না, রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ কম, স্বল্প জীবনকাল (অর্থাৎ দ্রুত ধান হয়), উচ্চফলনশীল, সরু, চিকন ও খরাসহিষ্ণু। এই ধানগুলো টানা ২০ দিন পানি না পেলেও খরা মোকাবিলা করতে পারে।
এখন পর্যন্ত আপনি এমন কতগুলো ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন?
নূর মোহাম্মদ: ২০০-এর বেশি (কৌলিক সারি ধান)। এর মধ্যে পাঁচ থেকে ছয়টি এখন কৃষকেরা মাঠপর্যায়ে চাষ করছেন। দেশের বিভিন্ন এলাকার কৃষকেরা এসব ধান এখন চাষ করছেন। এর মধ্যে ‘নূর ধান ১’ ও ‘নূর ধান ২’ অন্যতম।
এই দুই জাতের ধানের বৈশিষ্ট্য কী?
নূর মোহাম্মদ: নূর ধান ১-এর গাছ খাটো, মজবুত ও সহজে হেলে পড়ে না। এমনকি হালকা শিলাবৃষ্টিতেও এই ধানের ক্ষতি হয় না। খরাসহিষ্ণু, জীবনকালও কম। বোরো মৌসুমে এই ধান ১৩০ দিনে পাকে। বাংলাদেশের আর কোনো ধান এত কম সময়ে পাকে না। দেশের প্রচলিত অন্য ধানগুলো পাকতে ১৪০ থেকে ১৫০ দিন লাগে।
নূর ধান ২ সরু ও চিকন। পোলাও, বিরিয়ানিসহ খিচুড়ি রান্না করা যায়। এটা অবশ্য সুগন্ধি ধান (বা চাল) নয়। আমন মৌসুমে এ ধান হতে ১২৫ দিন লাগে। আর বোরো মৌসুমে লাগে ১৪৫ দিন। এই ধানেও পোকামাকড় কম আক্রমণ করে। নূর ১-এর চেয়ে নূর ধান ২ একটু লম্বা। বন্যা মৌসুমেও এই ধান চাষ করা যায়। নূর ১–এর গাছ খাটো হলেও বন্যা শুরু হওয়ার আগে ধান পেকে যাওয়ায় আর সমস্যা হয় না।
আপনি পড়ালেখা করেছেন কোন শ্রেণি পর্যন্ত?
নূর মোহাম্মদ: এসএসসি পর্যন্ত পড়েছি। আমাদের গ্রামের তানোর পাইলট স্কুলে পড়েছি। ছোটবেলায় মা–বাবা মারা যাওয়ায় দারিদ্র্যের কারণে আর পড়তে পারিনি। নানির কাছে মানুষ, পড়ালেখা যা করেছি তা-ও বড় হয়ে। ক্লাসে আমার বয়সী কেউ ছিল না। আমি ছিলাম অন্য শিক্ষার্থীদের চেয়ে বয়সে অনেক বড়।
আপনি এসএসসি পর্যন্ত পড়েও এই গবেষণার কাজ কীভাবে শিখলেন?
নূর মোহাম্মদ: কয়েকজন বিজ্ঞানীর কাছে এ কাজ শিখেছি। প্রথমে আবদুল মজিদ ও পরে হেলাল উদ্দিন আহমেদের কাছে। এরপর শফিকুল ইসলাম, মঞ্জুর হোসেন ও নুরুল মতিনের কাছে এ কাজ শিখি। ল্যাবে হাতে-কলমে আমাকে তাঁরা এ কাজ শিখিয়েছেন। এলাকার মানুষ এখন আমাকে ‘ধানপাগল’ বলে ডাকে।
আপনি কোন কাজের জন্য ২০০৫ সালে জাতীয় কৃষি পদক পেলেন?
নূর মোহাম্মদ: তখন পুরস্কারের জন্য ফরম পূরণ করতে হতো। আমি স্যারদের (কৃষিবিজ্ঞানী) জানালাম যে আমি এই ফরম পূরণ করতে চাই। তাঁরা করতে বললেন। এরপর ঢাকায় এলাম। মোট ৩২ জনকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। ৫টি স্বর্ণপদক, ৯টি রৌপ্যপদক ও ১৮টি ব্রোঞ্জপদক। প্রথম স্বর্ণপদকের জন্যই আমাকে ডাকা হয়। আমি স্বর্ণপদক পেলাম। সেখানে আমিই শুধু গরিব কৃষক, অন্যরা বিভিন্ন ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তা ছিলেন।
খেতে ফলনের জন্য আমাকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়। আমি ১ হেক্টরে ১০ টন ফলন ফলিয়েছিলাম তখন। সাধারণত এক হেক্টর জায়গায় পাঁচ থেকে ছয় টন ফলন হয়। কিন্তু আমি ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে উচ্চফলনশীল ধানের জাত সংগ্রহ করেছিলাম। সেই জাত থেকেই এমন ফলন পেয়েছি। সে ধান অবশ্য আমার উদ্ভাবিত ছিল না। এই পুরস্কার পাওয়ার পর আমি আরও উজ্জীবিত হই। এর পর থেকে ধান সংকরায়ণ করা শুরু করি।
কীভাবে করেন এ সংকরায়ণ? আমাদের পাঠকদের জন্য সহজ করে বলুন।
নূর মোহাম্মদ: আমরা যে ধানের চালের ভাত খাই, তার পিতৃফুল ছয়টি, মাতৃফুল দুটি। কোন জাতের সঙ্গে কোন জাত সংকর করব, তা আগের বছর ঠিক করে রাখি। দুই জাতের ফুল একসঙ্গে হতে হবে। আমি ক্রস পলিনেশনের মাধ্যমে এ কাজ করি। ধান লাগানোর পর ওই গাছের গোছা একটা টবে তুলে নিই। এটা মাতৃগাছ। সকালে গাছ তুলে বেলা তিনটার দিকে প্রতিটি ধানের এক-তৃতীয়াংশ কেটে দেওয়া হয়। এর মধ্যে ছয়টি পুরুষ ফুল বের করে নিই। এরপর গ্লসি পেপারের ব্যাগ দিয়ে ঢেকে দিই, যাতে অন্য কোনো ফুল এর সংস্পর্শে আসতে না পারে। পরদিন সকালে পিতৃগাছের শিষ ফুল না ফোটা গাছের নিচ থেকে কেটে নিই। এরপর একটা গ্লাসের মধ্যে পানি দিয়ে রাখি, রেণু যাতে না শুকায়।
সকাল ৯টা থেকে বেলা ১১টার মধ্যে ধানের পরাগায়ন হয়। এরপর গ্লসি পেপার খুলে ওটার মধ্যে পলিশ করে দেওয়া হয়। চার দিন পর ওখানে ধানের দুধ হয়। তখন খোসা থাকে না, ওটা তো আগেই কেটে দিয়েছি। এরপর গাছে চাল হয়। সেই চাল পাকলে সেগুলো শুকিয়ে রাখি। পরের মৌসুমে আবার জার্মিশন দিই। এরপর মুকুল বের হলে তা মাঠে নিয়ে যাই। এখান থেকে যা পেলাম, সেগুলো ‘এফ-ওয়ান’ (প্রথম প্রজন্মের সংকরায়িত প্রজাতি)। সেখান থেকে আবার ভালোগুলো বাছাই করি। এই ভালোগুলো আবার পরের বছর ‘এফ-টু’ (দ্বিতীয় প্রজন্মের সংকরায়িত প্রজাতি), এরপরের বছর ‘এফ-থ্রি’ (তৃতীয় প্রজন্মের সংকরায়িত প্রজাতি) নামে সংগ্রহ করি। এরপর প্রাথমিক ফলন পরীক্ষা, সেকেন্ডারি পরীক্ষা ও আঞ্চলিক পরীক্ষা হয়। মানে, ওই জাতই বিভিন্ন জায়গায় লাগানো হয়। কোন পরিবেশে কেমন উৎপাদন হয়, তা দেখা হয়। এরপর অগ্রগামী সারি পরীক্ষা শেষে পিভিটি পরীক্ষা (প্রপোজ ভ্যারাইটি ট্রায়াল বা প্রস্তাবিত জাতের ফলন পরীক্ষা) করা হয়। এরপর ধান রিলিজ (বাজারজাত) করার আগে ১০টা লোকেশনে ট্রায়াল হয়। তখন দুবার জাতীয় বীজ বোর্ড থেকে কর্মকর্তা এসে পরীক্ষা করেন। একদম ফলন পর্যন্ত দেখা হয়। এসব ভ্যারাইটির অনুমোদন নিতে হলে প্রায় ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা একসঙ্গে জমা দিতে হয় ১০ জায়গায় পরীক্ষার খরচ হিসেবে। এত টাকা আমি আজও জোগাড় করতে পারিনি।
তাহলে ‘নূর ধান ১’ ও ‘নূর ধান ২’ কীভাবে পেলেন?
নূর মোহাম্মদ: এগুলো সরকারিভাবে অনুমোদিত নাম নয়। আমার নিজের দেওয়া নাম। আমার ধানগুলো এক হাত থেকে আরেক হাত করে করে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে গেছে। টাকার অভাবে আমি সরকারি অনুমোদন পাইনি। তবে মানুষ আমার কাছে এসে ধান সংগ্রহ করেছে। এভাবেই ছড়িয়েছে। ধান গবেষণা কেন্দ্রের অনুমোদিত নয় এই ধান। মানুষ ভালো ফলন পেয়েছেন এবং তাঁরা আবার অন্যদের দিয়েছেন।
আপনার কোনো সহকারী আছেন বা কাউকে এ কাজ শেখাচ্ছেন?
নূর মোহাম্মদ: আমি একাই কাজ করি। অনেক কষ্ট করে এ কাজ শিখেছি। কিন্তু এখন কেউ আগ্রহ নিয়ে শিখতে চায় না। অনেক সময় আর পরিশ্রমের ব্যাপার এটা।
আপনার পরিবারে কে কে আছেন?
নূর মোহাম্মদ: আমার তিন ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলেরা কৃষিকাজ করে। একজন ইলেকট্রিকের কাজ করে।
সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় কৃষকবিজ্ঞানী সম্মেলনে গিয়েছিলেন আপনি। আপনার খোঁজ তারা কোথায় পেল?
নূর মোহাম্মদ: আমাদের ‘বারসিক’ নামের একটা এনজিও আছে। ওরা আমার কাজের কথা জানে। বাংলাদেশ থেকে যখন কৃষক খোঁজা হয়েছে, তখন এনজিও থেকে আমার নাম দিয়েছে তারা।
ওখানে গিয়ে কী দেখলেন, অন্য দেশের চেয়ে আমরা এগিয়ে আছি নাকি পিছিয়ে?
নূর মোহাম্মদ: কৃষিতে আমরা ওদের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছি। আমাদের মতো এত ফলন ওদের নেই। খরাপ্রবণ এলাকা হওয়ায় ফলন কম। ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ও চীনের ফলন মোটামুটি ভালো। ওখানে তো ১৭টি দেশের বিজ্ঞানী এসেছিলেন। এর মধ্যে ভারত, চীন, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামের কৃষকবিজ্ঞানীরা ছিলেন।
কৃষিতে আরও ভালো করতে আমাদের কী করা উচিত?
নূর মোহাম্মদ: কৃষকদের দক্ষ হতে হবে। জাতের উন্নয়ন করতে হবে। উচ্চফলনশীল ধানের জাত তৈরি করতে হবে।
সরকার বা মানুষ থেকে কোন ধরনের সহযোগিতা পেলে আপনি নিজের কাজটা আরও ভালোভাবে করতে পারবেন?
নূর মোহাম্মদ: ধানবিজ্ঞানীদের গবেষণার কাজে বরাদ্দ বাড়ানো দরকার। আমাদের গবেষণার জন্য বরাদ্দ অনেক কম।
আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
নূর মোহাম্মদ: আরও উচ্চফলনশীল ধানের জাত উৎপাদন করে দেশের খাদ্যের চাহিদা মেটাতে চাই।
বাংলাদেশের কৃষকদের উদ্দেশে কিছু বলতে চান?
নূর মোহাম্মদ: অনেকে কৃষিকাজ থেকে সরে যাচ্ছেন। কিন্তু আমি কৃষকদের বলতে চাই, কৃষিকাজের সঙ্গে থাকুন। প্রয়োজনে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করুন। কারণ, বেঁচে থাকতে হলে খাদ্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের বেশির ভাগ পাঠক কিশোর ও তরুণ। তাদের উদ্দেশে কিছু বলতে চান?
নূর মোহাম্মদ: বাংলাদেশে কৃষি বিষয়টিতে কম গুরুত্ব দেওয়া হয়। আমি চাই, দেশের শিক্ষার্থীরা অন্যান্য বিষয়ের মতো এটিও গুরুত্বসহকারে পড়ুক। শিক্ষার্থীদের কৃষি বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে পড়া উচিত। কৃষিকে নিয়মিত বিষয় হিসেবে গুরুত্ব দিয়ে পড়ানো উচিত।