প্রাণিজগৎ
শামুকভাঙ্গা পাখির রোমাঞ্চকর জীবনাখ্যান
এ দেশে কত রকম, কত ধরনের পাখি। রং-বেরঙের এসব পাখি নিয়ে লিখেছেন পাখিবিশারদ ও প্রকৃতিবিদ শরীফ খান…
ফাগুন মাস। মেঘলা আকাশ। বাতাস বইছে বেশ জোরে। ওই বাতাসের অনুকূলে উড়ে আসছে বিশাল এক ঝাঁক পাখি, সংখ্যায় প্রায় তিন শ। ওরা আসছে বনবাগানের মাথার বেশ ওপর দিয়ে। ওরা আসছে যেন বাতাসে সাঁতার কাটতে কাটতে। ওরা আসছে পাশাপাশি সারিতে। সারির এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তের দূরত্ব ৫০ মিটারের কম হবে না। অবশ্য সারিটা একেবারে সরলরেখা নয়। কিছু পাখি সামান্য এগিয়ে আছে, কিছু পিছিয়ে। তবে রেখাটা ঠিকই আছে। উড়ছেও সমান গতিতে। পাখা নাড়ছে খুব কম। যেন-বা হিসেব কষে একই সঙ্গে পাখা নাড়ছে ওরা, থামছেও একই সঙ্গে। তারপর বেশ কিছুদূর এগোচ্ছে বাতাসে ভেসে, আবারো নাড়ছে পাখা দু-তিনবার করে। ওদের যেন তাড়া নেই কোনো।
শেষ বিকেল এখন। আকাশ মেঘলা থাকায় দিনের আলো নিভে আসছে দ্রুত। আলো থাকতে থাকতেই পাখিগুলোকে আশ্রয় নিতে হবে যুৎসই কোনো গাছে। কেননা, রাতের অন্ধকারে ওরা একেবারেই অসহায়। চাঁদনি রাতে অবশ্য প্রয়োজনে উড়তে পারে। তারাভরা রাতেও ওরা উড়তে পারে বেদিশার মতো। তবে বিপদে না পড়লে রাতে এই পাখিরা কখনো রাতের আশ্রয়স্থল ছেড়ে পাখা মেলে না।
পাশাপাশি লাইনে কী সুন্দর উড়ে আসছে বড় বড় পাখিগুলো! লম্বা লম্বা পাগুলো ওদের লেজের তলা দিয়ে পেছন দিকে টানটান হয়ে আছে। বাতাসের ধাক্কায় মাঝেমধ্যেই লেজ ও পিঠের দু-পাঁচটি পালক উল্টে যাচ্ছে। তবু উড়ছে ওরা ধীরগতিতে, যা ওদের স্বভাব।
পাখিগুলো আসছে সুন্দরবনের দিক থেকে। ওদিকেরই কোনো জলাভূমি বা নদীর চরে ওরা খাবার খুঁজেছে দিনভর। এখন গ্রামের দিকে আসছে রাতের আশ্রয়ের সন্ধানে। মেঘলা দিন না হলে ওরা আরও দেরি করে আকাশে উড়ত।
খেঁকশিয়ালের তিনটি ছানা মাঠের ধুলোয় প্রচণ্ড হুটোপুটি লাগিয়েছে। মাঠের ভেতরের তালগাছগুলো ঘিরে ওড়াওড়ি করছে বাতাসীরা। একটি তালগাছের পাতার ওপরে চুপচাপ বসে আছে একটি অসপ্রে পাখি। চোখ ওর মাঠের দিকে।
সবুজ বনবাগানে নেচে বেড়াচ্ছে পাগলা হাওয়া। মেঘলা দিনে সবুজ বনবাগানকে দূর থেকে লাগে কালচে-সবুজ। ও রকম একটি কালচে-সবুজ এলাকা পেরিয়ে পাখির ঝাঁক এসে পড়ল ছোট একটি খোলা মাঠের ওপরে। শুকনো মাঠটি প্রায় গোলাকার। মাঠের কিনারা জুড়ে কী সুন্দর সবুজ বেষ্টনী। বেষ্টনীর জায়গায় জায়গায় মাথা উঁচু করে আছে বড় বড় কাঠবাদাম, নারকেল আর দেবদারু গাছ। একটি মরা নারকেল গাছের মাথায় বসে আছে একটি রাজ শকুন। ওটা ওর রাতের স্থায়ী আস্তানা। একটি দেবদারু গাছের মাথায় রাতের আশ্রয় নিয়েছে তিনটি মানিক জোড়। দূরের একটি জলাশয়ে দিনভর চরেছে ওরা। বিশাল এক ঝাঁক বড় সাদা বক মাঠ পাড়ি দিয়ে পুব থেকে পশ্চিমে চলে যাচ্ছে। মাঠের ভেতরের একগুচ্ছ শ্যাওড়া গাছের ভেতর প্রচণ্ড কোলাহল জুড়েছে একঝাঁক ভাতশালিক। রোজ রাতেই ওরা আশ্রয় নেয় এখানে। ছোট এক রাখাল বালক তার গরুর পাল নিয়ে ফিরে চলেছে বাড়ির দিকে। একজোড়া শিয়াল পশ্চিমের বাগান থেকে বেরিয়ে মাঠটি পাড়ি দিচ্ছে আড়াআড়ি। খেঁকশিয়ালের তিনটি ছানা মাঠের ধুলোয় প্রচণ্ড হুটোপুটি লাগিয়েছে। মাঠের ভেতরের তালগাছগুলো ঘিরে ওড়াওড়ি করছে বাতাসীরা। একটি তালগাছের পাতার ওপরে চুপচাপ বসে আছে একটি অসপ্রে পাখি। চোখ ওর মাঠের দিকে। ব্যাঙ-ইঁদুর দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে এই তুখোড় শিকারি পাখি।
বিশাল ওই পাখির ঝাঁকটি মাঠটির মাঝ বরাবর এসে একটু যেন থমকে গেল। সামনের সর্দার পাখিটি একটু ওপরে উঠল, তারপর বাঁক নিল বাঁ দিকে। সর্দারকে অনুসরণ করতে গিয়ে পাখির ঝাঁকের লাইনটা ভেঙে গেল বটে, রইল ওরা কাছাকাছি। এই মাঠটির চার কিনারায় তো বটেই, মাঠের ভেতরেও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বেশ কিছু শিমুলগাছ। এই পাখিদের প্রথম পছন্দের গাছই হচ্ছে শিমুল। পাতা কম। ডালপালাও থাকে মাটির সমান্তরালে ছড়ানো-ছিটানো। লম্বা পা নিয়ে এসব ডালে বসতে যেমন সুবিধে, তেমনি সুবিধে হাঁটু মুড়ে যুৎসই হয়ে বসতে। এসব ডাল থেকে উড়তেও সুবিধে। পাখা ঝাপটালে ডাল-পাতায় আঘাত লাগে না।
কোন গাছটিতে নামা যায়, এই সিদ্ধান্ত নিয়ে সর্দার ধীরে ধীরে নামতে শুরু করল নিচের দিকে ধীরলয়ে পাক খেতে খেতে। লক্ষ্য তখন মাঠের ভেতরের একটি বড়সড় শিমুলগাছ—যে গাছটির পাশে দাঁড়ানো বড় বড় তিনটি তালগাছ ও দুটি ছোট শিমুলগাছ।
গাছের মাথা থেকে আনুমানিক ১০ মিটার উচ্চতায় এসে বিমানের চাকা নামিয়ে দেওয়ার কায়দায় সর্দার পাখিটি নামিয়ে দিল তার লম্বা দুটি পা, বসল এসে ডালে। তখনো পাখা দুটি মেলা তার। ভালোভাবে বসা হয়েছে বোঝার পর পাখা দুটি বুজল সে। তারপর একে একে নামতে লাগল অন্য পাখিগুলো। একই কায়দায়। একটু বাদেই শুরু হলো ধাক্কাধাক্কি অবস্থা। বড় শিমুলগাছটিতে আর পা ফেলার জায়গা নেই। তবু কিছু পাখি উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে জায়গা খুঁজছে। কিছু পাখি বসছে গিয়ে ছোট দুটি শিমুলের ডালে। ও দুটো গাছেও যখন পা ফেলার জায়গা নেই, তখন তিনটি পাখি বাধ্য হয়েই বসল গিয়ে তালগাছটির ডগার ওপরে। ব্যস, আজকের মতো রাতের আশ্রয় পেয়ে গেছে এরা। বড় কোনো ঝামেলা না হলে রাতের ভেতরে উড়বে না আর। উড়বে আবার আগামী দিন ভোরে। ধীরলয়ে পাখা মেলে চলে যাবে কোনো জলাশয়ের দিকে। খাদ্য খুঁজবে হেঁটে হেঁটে।
রাতের অন্ধকারে এরা একেবারেই অসহায়। মাটিতে বসা পাখিকে হাত বাড়িয়ে ধরা যায় সহজে। অবশ্য ধরার পরে শক্তি খাটায়, পাখা ঝাপটায়, ঠোঁটও চালায়। ঠোঁটের চোটটা বেশ ভারি হয়। এরা বেশ নিরীহ ও বোকাসোকা ধরনের পাখি।
এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়। পাখিগুলো পাশাপাশি ঠেলাঠেলি করে না বসলেও পারত। মাঠের ভেতরে রয়েছে আরও শিমুলগাছ। ওরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভাগ ভাগ হয়েও বসতে পারত। কিন্তু না, এই পাখিদের স্বভাবই এমন; গাছে জায়গা না হলে গাছতলার মাটিতে বসতে এরা রাজি আছে, কিন্তু দলছুট হয়ে দূরে বসবে না। এ রকম মাটিতে বসা পাখি আমি বাল্য-কৈশোরে বহুবার দেখেছি। নিজে খেপজাল দিয়ে ধরেছি। গুলি করেছি। মাটিতে বসা—এমনকি গাছে বসা পাখিকে বনবিড়াল ও মেছোবাঘের কবলে পড়তে দেখেছি। মাটি থেকে শিয়াল খাটাসেও ধরেছে। এখানে আমার একদিনের বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরছি।
তখন আমি কিশোর। বৈশাখ মাস। বিকেলে আকাশ ঢেকে গেল মেঘে। শুরু হলো ঝড়ো হাওয়া। তখন তাড়াতাড়ি গরু নিয়ে মাঠ থেকে ফেরার পথে দেখলাম একঝাঁক পাখি দ্রুতবেগে উড়ছে নিচু দিয়ে, যুদ্ধ করছে ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে। তড়িঘড়ি নেমে পড়ল ওরা মাঠের ভেতরের মস্ত বড় শিমুলগাছটির মাথায়। সেই বয়সের অভিজ্ঞতা আমার এ রকম যে এই পাখিরা ঝড়ো হাওয়ার কাছে একেবারেই অসহায়, ঝড়ের দিন বা রাতে এরা প্রয়োজনে খোলা মাঠে নেমে পড়ে। বসে থাকে অসহায়ের মতো। রাতের অন্ধকারে এরা একেবারেই অসহায়। মাটিতে বসা পাখিকে হাত বাড়িয়ে ধরা যায় সহজে। অবশ্য ধরার পরে শক্তি খাটায়, পাখা ঝাপটায়, ঠোঁটও চালায়। ঠোঁটের চোটটা বেশ ভারি হয়। এরা বেশ নিরীহ ও বোকাসোকা ধরনের পাখি। বন্দুক নিয়ে বেশ কাছে যাওয়া যায়। কিন্তু একবার গুলি খাওয়া ঝাঁকের প্রতিটি পাখিই চালাক হয়ে যায়। মানুষকে তখন নাগালের ভেতরে পৌঁছাতে দেয় না। মাঠে ছাড়া গাছে বসা অবস্থায় গুলি করলে একটির বেশি শিকার করা হয় কষ্টকর।
যাহোক, সেই কাল-বোশেখির বিকেলে পাখির ঝাঁককে শিমুলগাছে নামতে দেখে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় দিয়েছিলাম বাড়ির দিকে। বাবাকে খবরটা বলতেই তিনি বন্দুক-কার্তুজ বের করেছিলেন। তখন ঝড়ের গতি গিয়েছিল বেড়ে। বৃষ্টিও নেমেছিল মুষলধারায়। হঠাৎ করে ঘোর অন্ধকার নেমে পড়েছিল চরাচরে। অস্থির অপেক্ষা তখন বৃষ্টি কমার, ঝড় থামার। না, দুটোই বাড়ছে। নারকেল-সুপারি-আম-জামগাছের মাথায় ঝড়ের সে কী মাতম! গোয়াল চাপাপড়ার ভয়ে বাড়ির সব কটি গরুর গলার দড়ি খুলে দিয়ে বাবা ফিরে এলেন আবার। ওই সময়ই পাখি শিকারি বাবা আমার বন্দুক ছাড়াই পাখি শিকারের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। খেপজাল, ছাগলবাঁধা দড়ি আর দুই সেলের একটি টর্চ হাতে যখন বাবা, আমার এক মামা ও কাজের লোকটি নেমে পড়লেন উঠোনে, তখন আমিও নামলাম। বাবার প্রচণ্ড ধমকও ফেরাতে পারল না আমাকে, মাও হাত ধরে রাখতে পারলেন না।
খোলা মাঠে নামার পরে আমরা এগোতে পারি না আর। পায়ের তলায় নরম মাটি। ঝড় আমাদের মাটিতে পেড়ে ফেলতে চায়। তুমুল বৃষ্টির চাপে দমবন্ধ অবস্থা। তবু খোলা মাঠে গাছচাপা পড়ার ভয় নেই, ভয় আছে সাপের গায়ে পা পড়ার। কী কৌশলে যে বাবা লুঙ্গির আঁচলে চাপা টর্চটা মাঝে মাঝে জ্বালাচ্ছেন! ঘোলাটে আলোর বৃত্তে চারপাশটাকে মনে হচ্ছে ভৌতিক।
ঝড়ের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে বৃষ্টির সঙ্গে লড়তে লড়তে একসময় পৌঁছে গেলাম শিমুলতলায়। ঘোলাটে আলোর বৃত্তে আমরা অনেকগুলো পাখিকে মাটিতে জড়োসড়ো অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। বাবা চিৎকার দিয়ে বললেন, ঝড়ের জন্য গাছের সব কটি পাখি মাটিতে নেমে এসেছে। সেই ঝড়-বৃষ্টির ভেতরেও আমি কাছাকাছি এতগুলো বড় বড় পাখি দেখে কী রকম উল্লসিত যে হলাম! তাড়িয়ে জালে পাখি ফেললাম। বিপদের গন্ধ পেয়ে ওরা দৌড়ে-হেঁটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল। যখন আমরা ফিরতি পথ ধরলাম, তখন ছাগলের দড়িতে বাঁধা পড়েছে ১৯টি পাখি। এখন (২০০৮) আমার বয়স অনেক। সেই রাতটি আজও আমার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হয়। বিনা বন্দুকে এই জাতের পাখি একসঙ্গে এতগুলো পরে আর কখনো পাকড়াও করতে পারিনি। সেই রাতে চেষ্টা করলে আরও বহু পাখি আমরা ধরতে পারতাম। চেষ্টা করিনি। শীতে কাঁপছিলাম সবাই। পাশাপাশি এই পাখি নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখেছি আমি পাঁচবার।
বুজানো অবস্থায় ডানার অধিকাংশই সাদা, শুধু প্রান্তদেশটা কালো। তবে ঋতুভেদে এই যে সাদা রং, তা যেমন কিছুটা ঘোলাটে বা ফ্যাকাশে হয়, তেমনি কালো রংটাও হয় কিছুটা বিবর্ণ। এদের ঠোঁট লালচে-বাদামি। ঋতুভেদে এই রংও বদলায়।
এবার জানা যাক এই পাখিটির পরিচয়। পাখিটির নাম শামুকভাঙ্গা। শামুকখোল, শামুকখেকোও বলা হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশে এর আরও কিছু আঞ্চলিক নাম রয়েছে। ইংরেজি নাম এশিয়ান ওপেন-বিল (Asian open-bill)। বৈজ্ঞানিক নাম Anastomus oscitans। শরীরের মাপ ৯৯ সেন্টিমিটার। আমি নিজে বহুবার এই পাখির মাপজোক ও ওজন রেকর্ড করেছি। পা, ঠোঁট, জিভ, ঠোঁটের মাঝামাঝি জায়গাটার যেখানে একটু ফাঁকা মতন, ওই ফাঁকটুকু ধরে মাপসহ দাঁড়ানো অবস্থায় মাটি থেকে ওর মাথা পর্যন্ত কতটুকু উঁচু, তা-ও রেকর্ড করেছি।
শামুকভাঙ্গার ঠোঁট আমার সংগ্রহে রয়েছে। মাটিতে দাঁড়ানো অবস্থায় এর উচ্চতা প্রায় এর শরীরের মাপের সমান। বড়-সড় এই পাখিটির চেহারায় একটু বোকা বোকা ভাব যেমন আছে, তেমনি আছে নিরীহ নিরীহ চাহনি। মাথার চাঁদি থেকে ঘাড়-গলা-বুক-পেট হয়ে লেজের তলা পর্যন্ত সাদা। এই পাখিটির লেজের তলার কিছুটা ও উপরিভাগের কিছুটা কালো। বুজানো অবস্থায় ডানার অধিকাংশই সাদা, শুধু প্রান্তদেশটা কালো। তবে ঋতুভেদে এই যে সাদা রং, তা যেমন কিছুটা ঘোলাটে বা ফ্যাকাশে হয়, তেমনি কালো রংটাও হয় কিছুটা বিবর্ণ। এদের ঠোঁট লালচে-বাদামি। ঋতুভেদে এই রংও বদলায়। পা লালচে-হলুদ। লম্বা পায়ের একটিকে তুলে নিয়ে অন্যটির ওপর ভর দিয়ে এরা যেমন দিব্যি বিশ্রাম করতে পারে, তেমনি পারে দু-পা চমৎকারভাবে ভাঁজ করে আরাম করে বসতে।
শামুকভাঙ্গা মূলত জলাভূমির পাখি। তবে এদের জাতভাই মদনটাক, রঙিলা বক ও হাড়গিলার (হাড়গিলা বর্তমান বাংলাদেশে নেই বোধ হয়) মতো শুকনো জমিতেও চরে ব্যাঙ ও ফড়িংসহ পোকামাকড় খাওয়ার জন্য। এদের পেটে আমি বহুবার আস্ত ছোট ঝিনুক-শামুক, জলজোঁক ও জলসাপ দেখেছি। এদের খাদ্য তালিকায় আছে মাছ, কাঁকড়া, শামুকের ডিম, কচ্ছপের ছোট ছানা। ঝাঁকবেঁধে এরা যখন জলাভূমিতে হেঁটে খাবার খোঁজে, তখন দেখতে ভারি সুন্দর লাগে। অন্য জাতের পাখিকে ভয় দেখাবার জন্য এরা দুই ঠোঁটে চমৎকার ‘ঠোঁটতালি’ বাজায়। শব্দ ওঠে খটখট খটখট। আনন্দ ও উত্তেজনায় এরা ঠোঁটতালি বেশি বাজায়। যথেষ্ট শক্ত ও চোখা এদের ঠোঁট, কিন্তু আত্মরক্ষার ক্ষেত্রে এই ঠোঁটের ব্যবহার এরা জানেই না বলতে গেলে।
শামুকভাঙ্গা বর্তমান বাংলাদেশেও বেশ আছে। সুন্দরবন, সিলেট, চট্টগ্রামসহ প্রায় সারাদেশেই দেখা যায়। তবে সংখ্যায় কমে গেছে অনেক। বড় বড় ঝাঁক নজরে পড়ে না সহজে। বাসা বাঁধার গাছের বা খাবারের অভাব নেই। আছে নিরাপত্তার অভাব।
শামুকভাঙ্গারা বাসা বেশি করে ভাদ্র মাসে। জ্যৈষ্ঠ মাসেও বাসা করতে দেখেছি আমি। শামুকভাঙ্গার শেষ বাসাটি আমি দেখেছিলাম ১৯৯২ সালের শরৎকালে, সুন্দরবনের বাইরের একটা তেঁতুলগাছে। অবশ্য, ২০০৭ সালে জয়পুরহাট জেলার ক্ষেতলাল উপজেলার শাখিদার পাড়া গ্রামে প্রায় ২০০ পাখির কলোনি বাসা দেখি। এক জোড়া পাখি ছিল সেই ১৯৯২ সালে। তবে এক গাছে কয়েক জোড়া পাখি মিলেও বাসা করে, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আলাদা আলাদা গাছেও করে। দুজনেই বাসা সাজায়। পুরুষটি উপকরণ বেশি আনে। মেয়েটি গাছে বসে থাকে, উপকরণ সাজায়। প্রধান উপকরণ গাছের শুকনো বা কাঁচা ডালপাতা, শুকনো খড়। বাসা বাঁধতে সময় লাগে ৭-৯ দিন। পছন্দের জায়গা খুঁজতে লাগে ২-৩ দিন। এই পাখিরা দলে থাকে, থাকে দলপতি। দলপতিই দল চালায়। শামুকভাঙ্গাদের ডিম হয় ৩টি। ২টি বা ৪টিও হয়। ডিমের রং ঘোলাটে সাদা। দুজনেই পালা করে ডিমে তা দেয়। ৩০-৩৩ দিনে ডিম ফুটে বাচ্চা হয়। দুজনেই বাচ্চাদের খাওয়ায়। বাচ্চারা উড়তে শেখে ৫০-৬০ দিনে। তারপর থেকে মা-বাবার সঙ্গে উড়ে ঝাঁকে মেশে। শীতকালে বিশাল ঝাঁকে থাকে অনেক বাচ্চা। বোকা-বোকা চাহনি আর রং দেখে বাচ্চাদের আলাদাভাবে চেনা সম্ভব। গুলির শব্দ শুনে বয়স্ক পাখিরা উড়ে গেলেও বাচ্চারা অনেকেই ঝাঁকবেঁধে বসে থাকে, বিপদ বোঝে না। এই না বোঝার কারণেই বাচ্চারা বিপদে পড়ে বেশি। ১৯৭৫ সালের বৈশাখ মাসে আমি আমার গ্রামের ওপর দিয়ে প্রায় ছহাজার শামুকভাঙ্গার একটি ঝাঁককে উড়ে যেতে দেখেছিলাম। লেখার শুরুতে যে বর্ণনা দিয়েছি, সেটা আমার গ্রামের। সাল ছিল ১৯৬৪।
শামুকভাঙ্গা বর্তমান বাংলাদেশেও বেশ আছে। সুন্দরবন, সিলেট, চট্টগ্রামসহ প্রায় সারাদেশেই দেখা যায়। তবে সংখ্যায় কমে গেছে অনেক। বড় বড় ঝাঁক নজরে পড়ে না সহজে। বাসা বাঁধার গাছের বা খাবারের অভাব নেই। আছে নিরাপত্তার অভাব। তবে গত ৩/৪ বছর যাবৎ শামুকভাঙ্গাদের সংখ্যা ও নিরাপত্তা বেশ বেড়েছে। রাজশাহী জেলার পুঠিয়া উপজেলার পচামাড়িয়া গ্রামে ও পিরোজপুর জেলার ভাণ্ডারিয়া উপজেলার হেতালিয়া গ্রামে বড়-সড় কলোনি আছে ওদের এই ২০০৮ সালেও।
সর্বশেষ একটি বড় ঝাঁক দেখি ফেনী জেলার ত্রিপুরা সীমান্তে। শামুকভাঙ্গা নিয়ে বর্তমানে মূল্যবান গবেষণা চালাচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াইল্ড লাইফের মেধাবী ছাত্রী পাবনার মেয়ে রেজভীন আক্তার লিপি (এটা ২০০৮ সালের কথা)। তার ফিল্ড মূলত ওই জয়পুরহাটের শাখিদার পাড়া। তার বাড়ির কাছেই একটি কলোনি গড়ে উঠছিল, কিন্তু সেটা মানুষের অত্যাচারে নষ্ট হয়ে গেছে।