শীতকালে প্রাণীরা কী করে

প্রতিবছর শীতকালে অতিথি পাখিতে ভরে যায় আমাদের খাল-বিল ও জলাশয়

শীত এলে অনেকেই খুশি হয়। গরম পোশাক পরে পিঠা-মিঠা, সবজি-খিচুড়ির আয়োজন করে অনেকে। যাদের এসব সামর্থ্য নেই, তারা জবুথবু হয়ে খড়-বিচালি জ্বালিয়ে আগুনের ওম নিয়ে, ছেড়া কাঁথা মুড়ি দিয়ে কোনোরকমে কাটিয়ে দেয় শীতকাল। এ তো গেল মানুষের কথা। কিন্তু যেসব প্রাণীর এটুকুও করার অবস্থা নেই, তারা কীভাবে পার করে এই হিম ঋতু?

শীত থেকে বাঁচার জন্য জীবজন্তুদের রয়েছে নিজস্ব কিছু পদ্ধতি। একেক প্রাণী শীত থেকে বাঁচতে একেক পদ্ধতির আশ্রয় নেয়। পদ্ধতিগুলোকে মোটামুটি তিন ভাগে ভাগ করা যায়: পরিযান বা মাইগ্রেশন, শীতনিদ্রা বা হাইবারনেশন আর অভিযোজন বা অ্যাডাপটেশন।

নিজ দেশ ছেড়ে দূর দেশে যাওয়ার নাম মাইগ্রেশন বা পরিযান। প্রতিবছর শীতকালে অনেক নাম না জানা পাখিতে ভরে যায় আমাদের খাল-বিল ও জলাশয়। সুদূর উত্তর মেরু, সাইবেরিয়া থেকে এসব যাযাবর পাখি হাজারো মাইল পাড়ি দিয়ে এ দেশে আসে। এদের বলে মাইগ্রেটরি বার্ডস বা পরিযায়ী পাখি। এর মধ্যে আছে বালি হাঁস, খয়রা চকাচকি, কার্লিউ, কাঁদাখোচা, গডউইত। শীতপ্রধান অঞ্চলের হলেও প্রচণ্ড ঠান্ডা ওরা সহ্য করতে পারে না। ওসব এলাকায় এ সময় খাদ্যাভাবও দেখা যায়। তাই পাখিরা দলেবলে কম ঠান্ডার দেশে আসে। বাংলাদেশের মানুষ অতিথিপরায়ন বলে ওদের অতিথি পাখি নাম দেওয়া হয়েছে। অতিথি পাখিরা বসন্ত এলে আবার নিজের দেশে ফিরে যায়।

নিজ দেশ ছেড়ে দূর দেশে যাওয়ার নাম মাইগ্রেশন বা পরিযান। প্রতিবছর শীতকালে অনেক নাম না জানা পাখিতে ভরে যায় আমাদের খাল-বিল ও জলাশয়
কচ্ছপের শীতনিদ্রা

লুকিয়ে চুপচাপ ঘুমিয়ে থাকার নাম হাইবারনেশন বা শীতনিদ্রা। ঠান্ডা থেকে বাঁচতে পাখিরা অনেক পথ পাড়ি দেয়। কিন্তু যারা উড়তে পারে না, ঠান্ডাও সহ্য করতে পারে না, তারা কী করবে! ওদের জন্যই এই ব্যবস্থা। শীতনিদ্রা। হাইবারনেশন বা শীতনিদ্রা হচ্ছে শীতকালে প্রাণীদের লম্বা, গভীর ঘুমের নাম। সুবিধামতো গর্ত খুঁজে নিয়ে একটানা অনেকদিন ঘুমিয়ে থাকে জীবজন্তুরা। এদের কাছে কুম্ভকর্ণও ফেল। এ সময় এদের দেহের তাপমাত্রা, শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি ও রক্ত চলাচল কমে যায়। দেখলে মনে হবে, প্রাণীটি বোধ হয় মারা গেছে। এ সময় ওরা দেহে জমানো চর্বি পুড়িয়ে কোনোরকমে বেঁচে থাকে।

সাধারণত শীতল রক্তের প্রাণীরা (যেমন ব্যাঙ, সাপ) শীতকালে এ পদ্ধতির আশ্রয় নেয়। তাই এ সময় ব্যাঙ বা সাপ দেখা যায় না। এ দলে সরীসৃপ প্রাণী, যেমন গিরগিটি, কচ্ছপ এবং বেশ কিছু পোকামাকড়ও আছে। তবে উষ্ণ রক্তের প্রাণীদের মধ্যে কাঠবিড়াল, বাদুড়, ধেড়ে ইঁদুর, ছোট ইঁদুর, সাদা গলার পোরউইল পাখিও হাইবারনেশনের মাধ্যমে শীত থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখে।

যুদ্ধ করে বাঁচার নাম অ্যাডাপটেশন বা অভিযোজন। অনেকে শীতের সঙ্গে যুদ্ধ করে বাঁচে। গরম পোশাক কেনার পয়সা নেই তাতে কী, যুদ্ধ করার মতো দৈহিক অবস্থা আছে। এদের চামড়ার নীচে চর্বির মোটা স্তর থাকায় সহজে শীতে কাবু হয় না
মেরু ভালুক মানিয়ে চলে শীতের সঙ্গে

যুদ্ধ করে বাঁচার নাম অ্যাডাপটেশন বা অভিযোজন। অনেকে শীতের সঙ্গে যুদ্ধ করে বাঁচে। গরম পোশাক কেনার পয়সা নেই তাতে কী, যুদ্ধ করার মতো দৈহিক অবস্থা আছে। এদের চামড়ার নীচে চর্বির মোটা স্তর থাকায় সহজে শীতে কাবু হয় না। এর মধ্যে আছে মেরু ভালুক, সীল ও তিমি। আবার এদের অনেকের দেহের এক ইঞ্চি জায়গায় গড়ে ১০ লাখ লোম থাকে (মানুষের মাথায় থাকে এরকম—গড়ে এক মিলিয়ন বা ১০ লাখ)। তাহলে সোয়েটার বা জ্যাকেট পরার দরকার কী! মেরু ভালুক আর মেরু শেয়ালের দেহে এমন ঘন লোম দেখা যায়। এদের পায়ের পাতাও লোমে ঢাকা। আবার মেরু শেয়াল ঘুমানোর সময় লম্বা লোমশ লেজ দিয়ে দেহ জড়িয়ে নেয়। অনেকটা মাফলারের মতো। তাই তীব্র ঠান্ডাতেও ওরা দিব্যি আরামে থাকে।

আবার অন্য এলাকার চেয়ে শীতপ্রধান অঞ্চলের প্রাণীর দেহ গঠনও আলাদা। যেমন মেরু শেয়ালের দেহ অন্য এলাকার শেয়ালের চেয়ে একটু গোলগাল ও স্থূলাকার। এ ধরনের দেহ তাপ সঞ্চয় করে রাখতে সাহায্য করে। তা ছাড়া এদের নাক-মুখ একটু ছোটখাটো আর কানটাও ছোট ও গোলাকৃতির। এসব বৈশিষ্ট্যের কারণে তাদের দেহ থেকে তাপ বের হয় কম।

আরও পড়ুন

প্রাণীরা শীতে বাঁচতে প্রকৃতি প্রদত্ত কিছু বৈশিষ্ট্য পেলেও মানুষের তা নেই। মানুষকে তাই শীতে গরম পোষাক পরতে হয়। শীতের পোষাক কেনার সামর্থ্য না থাকায় এ দেশের অনেকে শীতে কষ্ট পায়। ওদের শীতনিদ্রায় যাওয়ার উপায় নেই, কিংবা চামড়ার নিচে পুরু চর্বিও নেই। নেই গরমের দেশে পাড়ি দেওয়ার সামর্থ্যও। তাই অসহায়ের মতো শীতের কামড় সহ্য করতে হয় ওদের। প্রচণ্ড ঠান্ডা সহ্য করতে না পেরে প্রতিবছরই অনেকে মারা যায়। তাদের নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে।