জোনাকি কেন নিজের আলোয় পুড়ে যায় না

বাল্ব জ্বালালেই গরম হয়, আগুন জ্বালালে তো কথাই নেই। কিন্তু জোনাকি পোকার পেটে আলো জ্বললেও সেটা কেন ঠান্ডা থাকে? কেন ওরা নিজের আলোয় নিজেই পুড়ে ছাই হয়ে যায় না?

জোনাকি নিশাচর পোকা। রাতের বেলাই ওরা চলাফেরা করতে অভ্যস্ত। রাত শেষে দিনের আলো ফুটলে জোনাকিরা গা ঢাকা দেয়। যেখানে-সেখানে নয়, একেবারে ঘন ঝোপের আড়ালে। লোকালয়েও ঝোপজঙ্গল আছে। কিন্তু মানুষেরা ওদের বড্ড বিরক্ত করে সেখানে। তাই দিনের বেলা জোনাকিরা পালায় মাঠপানে। বাঁশবন কিংবা বড় বড় বাগানের আশপাশে অনেক ঝোপজঙ্গল থাকে।

মাঠের ভেতরে থাকে খাল। সেই খালটি চলে গেছে নদী পর্যন্ত। খাল ও নদীর দুই কিনার বুনো গুল্মলতায় ঠাসা। ওসব জায়গায় মানুষের আনাগোনাও কম। জোনাকি ওই সব ঝোপের আড়ালে ঘুমাতে ভালোবাসে। তাই দিনের বেলা লোকালয়ে জোনাকি দেখা যায় না বললেই চলে। দিন শেষে সন্ধ্যা ঘনায়। ধীরে ধীরে রাত নামে। জমাট বাঁধে অন্ধকার, তখন জোনাকিরা আসে দলেবলে।

জোনাকি এক রহস্যময় প্রাণী। সাগরের তলদেশে অনেক প্রাণী আছে, যারা আলো জ্বালতে পারে। কিন্তু স্থলভাগে শুধু জোনাকিরই আছে সেই ক্ষমতা। জোনাকির আলো জ্বলা দেখে মনে একটা প্রশ্ন জাগে না? এই আলো ওরা পেল কোথায়? কীভাবে জ্বলে ওই আলো? আলো মানেই তাপ, জোনাকি কীভাবে সেই তাপ সহ্য করে? কিংবা আলো জ্বালাতে গিয়ে জোনাকি জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে যায় না কেন?

জোনাকির পেটের পেছন দিকে বক্স লাইটের মতো একটা জিনিস আছে। একে বলে ফটোসাইট। ভেতরে থাকে দুই ধরনের রাসায়নিক পদার্থ—লুসিফারেস ও লুসিফারিন। লুসিফারিন হলো জ্বালানি, যা আলো তৈরি করে। তবে এই রাসায়নিকের সঙ্গে অক্সিজেনের জারণ বিক্রিয়া ঘটাতে সাহায্য করে লুসিফারেস এনজাইম। ফলে তৈরি হয় আলো।

বেশির ভাগ জোনাকিই আলো তৈরি করতে সক্ষম। বেশির ভাগ জোনাকিই রাতে আলো জ্বালে। দিনের বেলা এদের আলো উৎপাদন প্রক্রিয়া বন্ধ থাকে।

আরও পড়ুন

জোনাকি কি পুড়ে যায়

যখন কোনো বস্তু থেকে আলো উৎপন্ন হয়, সেখানে উৎপন্ন হয় তাপ। যেমন আগুনের কথাই ধরা যাক। কী পরিমাণ তাপ সেখান থেকে উৎপন্ন হয়! আবার আগুন থেকে আলোও ছড়ায়।

বৈদ্যুতিক বাল্বের কথাও ভাবতে পারেন। আলো জ্বালানোর আধঘণ্টার মধ্যে বাল্বটা ভীষণ গরম হয়ে ওঠে। টিউব লাইট কিংবা এনার্জি সেভিং বাল্বকে সাধারণ চোখে মনে হয় তেমন গরম হয় না। আসলে গরম হয়। বেশ গরম। তবে সাধারণ বাল্বের তুলনায় এনার্জি সেভিং লাইটগুলো কম তাপ উৎপন্ন করে। আলো উৎপন্ন করে বেশি। তাই অল্প বিদ্যুৎশক্তিতে অনেক বেশি আলো পাওয়া যায় এদের থেকে। এ জন্যই এদেরকে এনার্জি সেভার বলে। সাধারণ বৈদ্যুতিক বাল্ব যে পরিমাণ বিদ্যুৎশক্তি নেয়, তার ৯০ ভাগ তাপ উৎপাদনে ব্যয় হয়। বাকি ১০ ভাগ থেকে আসে আলো।

এনার্জি সেভার তাপ উৎপন্ন করে কম। তুলনায় আলো উৎপন্ন করে অনেক বেশি। তাই এদের থেকে অল্প বিদ্যুৎ খরচে বেশি আলো পাওয়া যায়। এনার্জি সেভার বাল্ব মোট শক্তির ৮০ ভাগ আলো উৎপন্ন করে। আর ২০ ভাগ মাত্র তাপ উৎপন্ন করে। জোনাকি পোকার ক্ষেত্রেও এনার্জি সেভিংয়ের মতো ঘটনা ঘটে। তবে জোনাকি পোকার এনার্জি সেভিং ক্ষমতা এনার্জি সেভার লাইটের চেয়ে অনেক অনেক বেশি। আসলে জোনাকির আলো একেবারে ঠান্ডা।

তাহলে কি জোনাকি পোকার আলো থেকে কোনো তাপই উৎপন্ন হয় না? ব্যাপারটা ঠিক এমন নয়। লুসিফারিন বাতাসের অক্সিজেনের সঙ্গে মিশে যে আলো তৈরি করে, তাতে তাপ উৎপন্ন হয় না বললেই চলে। বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে বায়োলুমিনিসেন্স।

সুতরাং জোনাকি পোকা হলো পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ট আলো উৎপন্নকারী প্রাণী। অন্য কথায় বলা যায়, জোনাকি পোকার আলোক উৎস কোনো রকম তাপ উৎপন্ন করে না। তাই জোনাকির আলো একেবারে ঠান্ডা। এই ঠান্ডা আলোর কারণে জোনাকি নিজের আলোয় নিজেই পুড়ে ছাই হয়ে যায় না। জোনাকি ধরলে হাতও পুড়বে না।

লেখক: সাংবাদিক

আরও পড়ুন