সর্দি লাগলে কানে শুনতে কষ্ট হয় কেন
আবহাওয়া পরিবর্তন হলেই ঘরে ঘরে জ্বর, ঠান্ডা, সর্দি ও কাশি দেখা যায়। এর সঙ্গে নাক বন্ধ, গলাব্যথা বা কফযুক্ত কাশির মতো সাধারণ সমস্যাও থাকে। কিন্তু সর্দি বা ফ্লু হলে প্রায়শই কানে শুনতে অসুবিধা হয়। অনেকের কান বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অনুভূতিও হয়। আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন, সর্দি-কাশি তো শ্বাসতন্ত্রের রোগ, তাহলে কানের সঙ্গে এর সম্পর্ক কী?
এর মূল কারণ হলো, কান ও নাকের মধ্যে একটি সংযোগ রয়েছে। বাইরে থেকে কান ও নাককে সম্পূর্ণ আলাদা মনে হতে পারে। কিন্তু ভেতরে এরা একটি সরু নালীর মাধ্যমে যুক্ত। এই নালীটির নাম ইউস্টেশিয়ান টিউব। এটি মধ্যকর্ণ এবং নাকের পেছনের অংশকে যুক্ত করে। এর প্রধান কাজ হলো কানের ভেতরের বায়ুর চাপ ঠিক রাখা। এই চাপ ঠিক না থাকলেই কানে নানা রকম সমস্যা দেখা দেয়।
কিন্তু সর্দি-কাশি হলে নাক ও গলার মতো এই টিউবটিও ফুলে যায়। অনেক সময় এটি শ্লেষ্মা বা মিউকাস দিয়ে বন্ধও হয়ে যায়। এর ফলে কানের ভেতরের চাপ নিয়ন্ত্রিত হতে পারে না। তখন আমরা কানে কম শুনি বা কান বন্ধ হয়ে আছে বলে মনে হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড মেডিসিনের তথ্য অনুযায়ী, আমাদের কানের ভেতরের ইউস্টেশিয়ান টিউবটি সাধারণত বন্ধ থাকে। এটি একটি ভালভ বা গেটের মতো কাজ করে। আমরা যখন খাবার গিলি বা হাই তুলি, শুধু তখনই এটি খুলে যায়। এর মাধ্যমে দুটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়। প্রথমত, এটি মধ্যকর্ণে তৈরি হওয়া অতিরিক্ত শ্লেষ্মা নাক ও গলার দিকে নামিয়ে দেয়। দ্বিতীয়ত, এটি কানের ভেতরের চাপকে নিয়ন্ত্রণ করে। সঠিকভাবে শোনার জন্য এই চাপ নিয়ন্ত্রণ জরুরি। সর্দি-কাশির কারণে এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেলেই শুনতে সমস্যা হয়।
কিন্তু যখন সর্দি বা অন্য কোনো ভাইরাস আমাদের সংক্রামিত করে, তখন আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে।
বিমান ভ্রমণের সময় অথবা দ্রুত পাহাড়ে ওঠার সময় আমাদের কান ফেটে যাওয়ার মতো যে অদ্ভুত অনুভূতি হয়, সে বিষয়ে অনেকেই জানেন। হঠাৎ করে যখন পরিবেশের চাপ দ্রুত পরিবর্তিত হয়, তখন কানের ভেতরের ইউস্টেশিয়ান টিউব সেই চাপ দ্রুত সমান করতে পারে না। তাই কানে একরকমের চাপ অনুভূত হয়।
নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ ডা. জন ফোরনাডলি বলেন, ‘কানের এই চাপ নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়া শুধু বিশেষ পরিস্থিতিতেই ঘটে না। এটি আমাদের স্বাভাবিক জীবনেও সমান গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও বাইরের বায়ুমণ্ডলীয় চাপ প্রতিনিয়ত সামান্য পরিবর্তিত হয়। আমাদের কান সব সময় এই পরিবর্তনগুলো মোকাবিলা করে। এই প্রক্রিয়াটি নিরন্তর চলতে থাকে বলেই আমরা কানে চাপমুক্ত থাকি ও স্বাভাবিকভাবে শুনতে পাই।’
কিন্তু যখন সর্দি বা অন্য কোনো ভাইরাস আমাদের সংক্রামিত করে, তখন আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। এর অংশ হিসেবে নাক ও সাইনাসের কোষকলা ফুলে যায়। তখন সেখানে দ্রুত শ্লেষ্মা বা মিউকাস তৈরি হতে থাকে। এই অতিরিক্ত শ্লেষ্মা ইউস্টেশিয়ান টিউবের পথে কানেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
এই শ্লেষ্মা কানের পর্দার স্বাভাবিক কম্পনে বাধা দেয়। অর্থাৎ, কানের পর্দা ঠিকভাবে কাঁপতে পারে না। একারণেই আমাদের শুনতে অসুবিধা হয় ও কান বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অনুভূতি হয়।
তবে চিন্তার কোনো কারণ নেই। সাধারণ সর্দিতে শ্রবণশক্তি যেটুকু কমে, তা সাধারণত মারাত্মক হয় না। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভাইরাসকে হারিয়ে দিলে অসুস্থতা সেরে যায়।
সর্দি-কাশির এই জটিলতা শিশুদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অন ডেফনেস অ্যান্ড আদার কমিউনিকেশন ডিসঅর্ডার একটি তথ্য দিয়েছে। তাদের মতে, প্রতি ৬ জন শিশুর মধ্যে ৫ জনই তাদের তৃতীয় জন্মদিনের আগে অন্তত একবার কানের সংক্রমণে ভোগে। প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুদের ইউস্টেশিয়ান টিউব ছোট হয়। একারণে তাদের কান থেকে শ্লেষ্মা বের হওয়া বেশি কঠিন। এটিই সংক্রমণের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।
২০২২ সালে কিউরিয়াস জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় বলা হয়, মধ্যকর্ণের সংক্রমণ সাময়িকভাবে প্রায় ৪০ ডেসিবেল পর্যন্ত শোনার ক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে। এটি অনেকটা কানে ইয়ারপ্লাগ পরে থাকার মতো। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, ‘বারবার কানের সংক্রমণ হলে বা এর চিকিৎসা না করালে কানের পর্দায় ছিদ্র হতে পারে। এমনকি গুরুতর ক্ষেত্রে স্থায়ীভাবে শ্রবণশক্তিও নষ্ট হয়ে যেতে পারে।’
তবে চিন্তার কোনো কারণ নেই। সাধারণ সর্দিতে শ্রবণশক্তি যেটুকু কমে, তা সাধারণত মারাত্মক হয় না। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভাইরাসকে হারিয়ে দিলে অসুস্থতা সেরে যায়। তখন কানের ভেতরের ফোলাভাব এবং শ্লেষ্মাও কমে আসে। ইউস্টেশিয়ান টিউব থেকে বাধা সরে গেলে এটি আবার স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে শুরু করে। ফলে কানের ভেতরের চাপ ঠিক হয়ে যায়। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কান বন্ধের এই সমস্যাটি নিজে থেকেই সেরে যায়।