ইউরি গ্যাগারিনের পরিচয় আলাদা করে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। প্রথম মানুষ হিসেবে এই সোভিয়েত নভোচারী পৃথিবীর সীমা পেরিয়ে গেছেন। দিনটা ছিল ১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল। প্রচণ্ড গোপনীয়তা বজায় রেখেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন গ্যাগারিনের এই মিশনের আগে। এরপর, মাত্র দুই ঘণ্টার মহাকাশ ভ্রমণ শেষে পুরো পৃথিবীর কাছে নায়ক বনে যান তিনি। নিজের শৈশব, পরিবারসহ অজানা গল্প নিয়ে বইও লেখেন। রুশ থেকে সেই বইটি বাংলায় অনুবাদ হয়েছে পৃথিবী দেখেছি নামে।
পৃথিবীর প্রথম এই নভোচারীর অজানা অনেক কিছুই এখন আমাদের জানা। কিন্তু তাঁর মৃত্যু আজও রহস্য হয়ে আছে গোটা পৃথিবীর কাছে।
দিনটা ছিল ১৯৬৮ সালের ২৭ মার্চ। মিগ-১৫ বিমান ওড়ানো যার কাছে প্রাত্যাহিক কাজ, যিনি মহাকাশ ঘুরে এসেছেন নিরাপদে; সেই মানুষটি মিগ বিমান চালাতে গিয়ে অদ্ভুত এক দুর্ঘটনায় পড়ে গেলেন। তাঁর মৃত্যু হলো নিতান্ত সাধারণ এক দুর্ঘটনায়। সেই একই বিমানে ছিলেন রুশ বিমান বাহিনীর কর্নেল ভ্লাদিমির সেরিয়োগিনও। আসলেই কি ছিলেন? দুর্ঘটনাটি কি সত্যিই নিদান্ত সাধারণ এক দুর্ঘটনা ছিল?
বইটি কথোপকথনের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে। এই কথোপকথনের ভঙ্গি, মাঝেমধ্যে স্থূল রসিকতা খানিকটা একঘেয়েমি সৃষ্টি করতে পারে। এর বিপরীতে পাঠক পাবেন চমৎকার সব গল্প
ইউরি গ্যাগারিন এবং ভ্লাদিমির সেরিয়োগিন ছাড়াও আরেকজন মানুষকে নিয়েও আছে অনেক কল্পগাঁথা, কিংবদন্তী, রহস্য। তিনি স্পুটনিক, ভস্টক, সোইয়ুজ, কসমসসহ সোভিয়েত মহাকাশ অভিযানের প্রাথমিক সব রকেটের নকশাকার, মাস্টারমাইন্ড সার্গেই পাভলোভিচ করোলেভ। এই মানুষটিকে হন্যে হয়ে খুঁজেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ শক্তিধর সব দেশের মাথারা। কেমন মানুষ ছিলেন তিনি? কীভাবে করেছিলেন এসব নভোযানের পরিকল্পনা?
তথ্যের গোপনীয়তাই রহস্য সৃষ্টি করে। সোভিয়েত মহাকাশ অভিযানের এই তিন নায়ক আজও তাই বিজ্ঞান জগতে আধো মানুষ-আধো কিংবদন্তী। মৈত্রী রায় মৌলিক সেই কিংবদন্তীর পর্দা মেলে ধরতে গল্পের আশ্রয় নিয়েছেন। এই তিন নায়ক গল্প করছেন, পরস্পরকে শোনাচ্ছেন নিজেদের অজানা কথা—এই অজানা কাহিনিতে আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, আছে লেবার ক্যাম্প, আছে রাশিয়ার প্রচণ্ড লৌহপর্দায় মোড়ানো গোপনীয়তার তত্ত্ব-তালাশ, সোভিয়েত মহাকাশ অভিযানের সূচনা, নভোযানগুলোর নকশা, সোভিয়েত সেনাবাহিনী এবং রাষ্ট্রের কর্মধারা, প্রথম নভোচারী কুকুর লাইকা, প্রথম নারী নভোচারী ভ্যালেন্তিনা তেরেসকোভা, ইউরি গ্যাগারিনের মহাকাশযাত্রাসহ আরও অনেক কিছু। গল্পে গল্পে পাঠক ফিরে যাবেন বিশ শতকের সোভিয়েত ইউনিয়নে। জাঁকিয়ে গল্প শুনতে শুনতে কখন যে দৃশ্যগুলো চোখের সামনে দেখতে শুরু করবেন, টেরও পাবেন না!
মৈত্রী রায় মৌলিক আগেও বিজ্ঞান-সংশ্লিষ্ট চরিত্রদের নিয়ে লিখেছেন। ইউরোপের প্রথম মানচিত্র তৈরির গল্প নিয়ে লিখেছেন মানচিত্রে তাঁর নাম নেই, ইউরোপ ও রাশিয়ায় বিজ্ঞানচর্চার সূচনা নিয়ে লিখেছেন কুমারি রানির ডাক্তার, লিখেছেন চাকা ঘোরার আগে। তাঁর এই রচনাধারায় সাম্প্রতিক সংযোজন শূন্য দৃশ্যমানতা। বিজ্ঞান-সংশ্লিষ্ট চরিত্রদের নিয়ে বাংলায় উপন্যাস লেখার এ প্রচেষ্টা খুব বেশি চোখে পড়ে না। সে জন্য লেখক সাধুবাদ পাবেন।
একনজরে
শূন্য দৃশ্যমানতা
মৈত্রী রায় মৌলিক
প্রকাশক: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড
প্রথম প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ২০২৪
পৃষ্ঠা: ১৪৪
দাম: ৩০০ রূপি
তথ্যের গোপনীয়তাই রহস্য সৃষ্টি করে। সোভিয়েত মহাকাশ অভিযানের এই তিন নায়ক আজও তাই বিজ্ঞান জগতে আধো মানুষ-আধো কিংবদন্তী। মৈত্রী রায় মৌলিক সেই কিংবদন্তীর পর্দা মেলে ধরতে গল্পের আশ্রয় নিয়েছেন।
বইটি কথোপকথনের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে। এই কথোপকথনের ভঙ্গি, মাঝেমধ্যে স্থূল রসিকতা খানিকটা একঘেয়েমি সৃষ্টি করতে পারে। এর বিপরীতে পাঠক পাবেন চমৎকার সব গল্প, অজানা কাহিনি এবং আবহ—ফলে পড়ে যেতে অসুবিধা তো হবেই না, বরং বিজ্ঞানে আগ্রহীদের জন্য এটি হতে পারে অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা।
শুধু একটুখানি আফসোস হতে পারে এই ভেবে যে লেখক সোভিয়েত মহাকাশ অভিযানের কাহিনির আরও গভীরে যেতে পারতেন, আরও খানিকটা মেলে ধরতে পারতেন—তার বদলে তিনি ব্যক্তিগত গল্পের দিকে মনোযোগ দিয়েছেন, সেখানেই এঁকে দিয়েছেন সীমারেখা। আকাশের সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া মানুষটির জীবন নিয়ে জানতে পরিসরটা সম্ভবত একটু ছোটই হয়ে গেল। এ অংশটুকু সমালোচনা নয়, বরং লেখকের গল্প বলার ধাঁচে এই আফসোসটুকু না হওয়াই অস্বাভাবিক হতে পারত।
প্রথম মহাকাশচারীর রহস্যময় মৃত্যু, সোভিয়েত মহাকাশ অভিযানের মাস্টারমাইন্ড এবং মানুষের আকাশ জয়ের কাহিনি নিয়ে আগ্রহীদের জন্য বইটি উপভোগ্য হবে।
