প্রকৃতি এক উন্মুক্ত রহস্য। এর বিশালতা এত ব্যাপক যে প্রকৃতিকে পুরোপুরি জয় করা অসম্ভব। তবে এই প্রতিকূলতার ভিড়েও মানবজ্ঞানের যে শাখা প্রকৃতির রহস্য উন্মোচনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে তা বিজ্ঞান। আর বিজ্ঞানের এই শক্তিশালী মঞ্চের নির্ভরযোগ্য ভিত্তি পদার্থবিজ্ঞান। কোয়ান্টাম জগত থেকে শুরু করে আপেক্ষিক জগতের সব ক্ষেত্রেই পদার্থবিজ্ঞানের পদচারণার সুবাদে বিজ্ঞানের এ শাখাটি সাধারণ পাঠকের কাছে ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠেছে। তবে আমাদের ধারণার বাইরে মহাবিশ্বের রহস্যগুলো অনুধাবন করতে ওয়াল্টার লুইনের ফর দ্য লাভ অব ফিজিকস পাঠকদের এমন এক রাজ্যে নিয়ে যায়, যেখানে প্রকৃতির এই জটিল ধাঁধাগুলো কেবল বোধগম্য নয়, মনোমুগ্ধকরও বটে।
অধ্যাপক লুইন একজন বিখ্যাত পদার্থবিদ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেট্স ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) অধ্যাপক। এককালে এমআইটির শিক্ষার্থীদের পদার্থবিজ্ঞান শেখাতেন মজা করে। বিভিন্ন তত্ত্ব হাতে-কলমে দেখাতেন। সেটি করতে গিয়ে অনেক সময় জীবনের ঝুঁকি নিতেও দ্বিধা করেননি। ভয়াবহ রেকিং বলের নিচে মাথা পেতে দেওয়া কিংবা তিন হাজার ভোল্টের বিদ্যুতে নিজেকে সুপারচার্জ করতেন অবলীলায়। এসব কারণে বিশ্বজুড়ে শিক্ষার্থীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে তাঁর লেকচারগুলো। ক্লাসের সীমানা পেরিয়ে এমআইটির ওয়েবসাইটের কল্যাণে ছাড়িয়ে যায় দেশ-কালের সীমা।
তিনি বিশ্বজুড়ে সমাদৃত তাঁর চমকপ্রদ অনলাইন লেকচারের জন্য। ফর দ্য লাভ অব ফিজিকস বইটিও লেখা হয়েছে লুইনের সেই প্রাণবন্ত লেকচার অনুসরণ করে। পদার্থবিজ্ঞানের জড় ও জটিল বিষয়গুলো জীবন্ত করে, পাঠককে দিয়েছেন পাঠের আনন্দ। এর মাধ্যমে পাঠকদের দারুণ এক অভিযাত্রায় নিয়ে গেছেন লুইন। সেই অভিযাত্রা পদার্থবিজ্ঞানের বিস্ময়কর রাজ্যে। সামান্য প্রাকৃতিক ঘটনা থেকে যে পদার্থবিজ্ঞানের কত গভীর রহস্যের ব্যাখ্যা মেলে, তা চিরে চিরে দেখিয়েছেন লুইন।
লেখক বইটিকে এতই সাধারণ করে উপস্থাপন করেছেন, যাতে সব শ্রেণির পাঠকই অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে বইটিকে গ্রহণ করতে পারবে। পাঠক এ বইয়ে পদার্থবিজ্ঞানের যে অপরূপ সৌন্দর্য খুঁজে পাবেন, তা এককথায় অপূর্ব।
এ বইয়ে মোট ১৫টি অধ্যায় আছে। প্রত্যেক অধ্যায়ে পদার্থবিজ্ঞানের ভিন্ন ভিন্ন শাখা আলোচনা করা হয়েছে। বস্তুর গতি ও মহাকর্ষ বলের মতো মৌলিক বিষয়গুলো থেকে শুরু করে ইলেকট্রোম্যাগনেটিজম এবং কোয়ান্টাম মেকানিকসের জটিল ধারণাও বর্ণিত আছে। প্রতি অংশেই লুইন একটি সহজ পর্যবেক্ষণ বা প্রশ্ন দিয়ে শুরু করেন—যেমন আকাশ কেন নীল? একটি বেসবল বাতাসে কী করে বাঁক খায়? ৩০০ মিটার উঁচু রেডউড ট্রি কীভাবে অভিকর্ষ বল বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে গাছের সবচেয়ে উঁচু ঢালেও পানি পৌঁছে যায়? শব্দ তরঙ্গকে মিটারে পরিমাপ করা হলেও আলোক তরঙ্গের বেলায় কেন ন্যানোমিটার? অথবা আমাদের জানামতে মহাকাশে বায়ু মাধ্যম নেই বলে শব্দ তরঙ্গের বিস্তার ঘটা যেহেতু অসম্ভব, তবে কি গ্রহ-নক্ষত্রের একে অপরের সাথে সংঘর্ষগুলো একদম চুপিসারেই ঘটে? অথবা ১৪০০ কোটি বছর আগে মহাবিশ্ব সৃষ্টির সময়টা কি পুরোপুরি নিঃশব্দ ছিল? এমন অজস্র প্রশ্ন আর সেই প্রশ্নের সূত্র ধরেই ধাপে ধাপে এর পিছনের পদার্থবিজ্ঞান ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এগুলো আমাদের পাঠ্যবইয়ের পড়াশোনার চেয়ে ভিন্ন, তবে আকর্ষণীয়।
ফর দ্য লাভ অব ফিজিকস বইয়ে শুধু বাস্তব উদাহরণগুলোকে সহজবোধ্য করে প্রকাশ করা হয়েছে এমন নয়। বরং লেখক পদার্থবিজ্ঞানের জটিল ও দুর্বোধ্য সূত্রগুলোকে সর্বসাধারণের পাঠের উপযোগী করে তুলেছেন। যেমন, গাউস, ফ্যারাডে ও অ্যাম্পিয়ারের বিদ্যুৎ ও চৌম্বকক্ষেত্র এবং এদের পারস্পারিক সম্পর্ক বিষয়ক চারটি সূত্র নিয়ে একত্রে কাজ করতে গিয়ে বিজ্ঞানী ম্যাক্সওয়েল সিদ্ধান্তে আসেন, ‘আলো নিজেই এক ধরণের বিদ্যুৎচৌম্বক তরঙ্গ’। উনিশ শতকের পদার্থবিজ্ঞান জগতে এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের পর অন্য পদার্থবিদেরা প্রকৃতির চারটি মৌলিক বলকে একীভূত করে এক নতুন তত্ত্ব ( ইউনিফায়েড ফিল্ড থিওরি বা একীভূত ক্ষেত্র তত্ত্ব) বিকাশের চেষ্টা করেন। এ চেষ্টায় স্বয়ং আইনস্টাইন তাঁর জীবনের শেষ ত্রিশটি বছর নিয়োজিত করেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনিও ব্যর্থ হন।
একনজরে
ফর দ্য লাভ অব ফিজিকস
লেখক: ওয়াল্টার লুইন
ভাষান্তর: আবুল বাসার
প্রচ্ছদ: আরাফাত করিম
প্রকাশক: প্রথমা
প্রথম প্রকাশ: ২০২৪
পৃষ্ঠা: ৩১৫
দাম: ৬৮৫ টাকা
এই বইয়ে এত তথ্য ও উপাত্ত রয়েছে, যা এই ছোট পরিসরে বলা দুঃসাধ্যই বটে। তবুও পাঠকের আগ্রহের কথা বিবেচনা করে কিছু পরীক্ষণের নাম লিখছি, যা বই সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেবে বলে আশা করি। বইটি পড়ে জানা যাবে, ওজনে ভারী পেন্ডুলামের সাহায্যে শক্তির সংরক্ষণ পরীক্ষা, তড়িৎ ও চৌম্বকের পরস্পর নির্ভরশীলতা; যা জেনারেটর ও ট্রান্সফর্মারের মতো যন্ত্র গঠনের সহায়ক, ডাবল স্লিট এক্সপেরিমেন্ট; আলোর দ্বৈত নীতির প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করে, লেডেনফ্রস্টের প্রভাব; যা থার্মোডাইনামিক্সের রীতি ও প্রকৃতি জানাবে এবং কসমিক রশ্মি পরীক্ষণ; মহাবিশ্বের প্রকৃতি সম্পর্কে তথ্য দেবে।
অধ্যাপক লুইন একজন বিখ্যাত পদার্থবিদ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেট্স ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) অধ্যাপক। এককালে এমআইটির শিক্ষার্থীদের পদার্থবিজ্ঞান শেখাতেন মজা করে। বিভিন্ন তত্ত্ব হাতে-কলমে দেখাতেন। সেটি করতে গিয়ে অনেক সময় জীবনের ঝুঁকি নিতেও দ্বিধা করেননি।
পদার্থবিজ্ঞানের এমন অসংখ্য জানা অজানা অন্বেষণ করতে ফর দ্য লাভ অব ফিজিকস, বিজ্ঞান বিষয়ক বইয়ের ক্যাটাগরিতে আপনার পছন্দের সেরা বইয়ের তালিকায় নিঃসন্দেহে জায়গা করে নিতে পারবে। এ জন্য আপনার বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়া বাধ্যতামূলক নয়। লেখক বইটিকে এতই সাধারণ করে উপস্থাপন করেছেন, যাতে সব শ্রেণির পাঠকই অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে বইটিকে গ্রহণ করতে পারবে। পাঠক এ বইয়ে পদার্থবিজ্ঞানের যে অপরূপ সৌন্দর্য খুঁজে পাবেন, তা এককথায় অপূর্ব। অধ্যাপক লুইনের ভাষায়, এ বইটা পড়ার পর আপনার জগৎ এবং দেখার চোখ আর আগের মতো থাকবে না।
পরিশেষে, ‘বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর, সবার আমি ছাত্র, নানানভাবে নতুন জিনিস শিখছি দিবারাত্র’—সুনির্মল বসুর এই লাইনগুলোর যথোপযুক্ত সংজ্ঞায়ন নিশ্চিত করতেই ফর দ্য লাভ অব ফিজিকস অনুবাদক আবুল বাসার তাঁর সর্বোচ্চ চেষ্টা রেখেছেন, যাতে বাংলাদেশের তরুণদের মননে বিজ্ঞানকে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। তাঁর এই সাহসী উদ্যোগের জন্য তার প্রতি আমার একান্ত ধন্যবাদ রইল।