মশা নিয়ে অজানা পাঁচ তথ্য

আজ বিশ্ব মশা দিবস। বিশ্বজুড়ে মানুষকে সতর্ক করতে প্রতিবছর ২০ আগস্ট এ দিবস পালিত হয়। ব্রিটিশ চিকিৎসক রোনাল্ড রসের সম্মানে ১৯৩০ সাল থেকে পালিত হচ্ছে দিবসটি। ১৮৯৭ সালের এই দিনে তিনি অ্যানোফিলিস মশাবাহিত ম্যালেরিয়া রোগের কারণ আবিষ্কার করেছিলেন। এ জন্য ১৯০২ সালে প্রথম ব্রিটিশ বিজ্ঞানী হিসেবে নোবেল পুরস্কার পান তিনি। আজ বিশ্ব মশা দিবসে মশাবিষয়ক পাঁচটি তথ্য নিয়ে লিখেছেন বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম

সাধারণত ডিম পাড়ার আগে স্ত্রী মশাদের প্রচুর রক্ত খাওয়ার দরকার হয়।সংগৃহীত

প্রশ্ন :

মশা কামড়ালে ফুলে যায় কেন?

এ ব্যাপার ঘটে মশার নিজস্ব একটি কৌশলের কারণে। সাধারণত ডিম পাড়ার আগে স্ত্রী মশাদের প্রচুর রক্ত খাওয়ার দরকার হয়। তাদের পুষ্টির জন্য এটা জরুরি। রক্ত খেলে একটি মশা প্রচুর ডিম পাড়তে পারে, কিন্তু রক্ত খেতে না পারলে সামান্য কয়েকটি ডিম পাড়ে। বংশবিস্তারের জন্যই তাদের রক্ত খেতে হয়। কিন্তু মশা খুব ভালোভাবেই জানে যে সে হুল ফোটালে মানুষের হাতের চাপড় খেয়ে মরতে হবে। তাহলে কী করা যায়? সে একটা বুদ্ধি বের করেছে। প্রথমে আস্তে করে আমাদের হাতে–পায়ে বসে, এরপর প্রথমে তাদের হুল দিয়ে কিছু ঘন তরল ত্বকের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়।

এটা আসলে একধরনের ব্যথানাশক তরল, যা ত্বকের কিছুটা অংশ কিছুক্ষণের জন্য অবশ করে রাখে। এরপর পেট ভরে রক্ত শুষে নিয়ে উড়ে যায়। কিছুক্ষণ পর আমাদের ত্বকের ওই স্থানের অনুভূতি ফিরে আসে আর আমরা টের পাই, মশা কামড়াচ্ছে। লাগাই চাপড়। কিন্তু ততক্ষণে মশা তো হাওয়া, উড়ে চলে গেছে। এ জন্যই অধিকাংশ সময়ই আমরা হাতে চাপড় দিয়ে মশা মারতে পারি না। এখন আসছি কেন ফুলে যায় এবং ওই জায়গা চুলকায়। ওই যে বললাম, মশা প্রথমেই কিছু ব্যথানাশক তরল ত্বকে ঢোকায়। এই তরলের ঝাঁজটা কিছু সময় পরেই শুরু হয়। ফলে ত্বকের ওই জায়গা একটু চুলকায় ও ফুলে যায়।

তাহলে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, মশার কত বুদ্ধি! আমাদের কীভাবে বোকা বানিয়ে রক্ত শুষে নিয়ে যায়, আর আমরা ওই জায়গা চুলকাই। জ্বালা জুড়াতে যন্ত্রণা ভোগ করি।

রক্ত খেলে একটি মশা প্রচুর ডিম পাড়তে পারে।
সংগৃহীত
আরও পড়ুন

প্রশ্ন :

মশা কামড় দিলে চুলকায় কেন?

প্রশ্নটা খুব সহজ। কিন্তু এর সূত্র ধরে একটু গভীরে গেলে মজার একটা ব্যাপার আমরা জানতে পারব। মশা কামড় দিলে আমাদের ত্বকের স্পর্শানুভূতি মস্তিষ্কে খবর পাঠায় যে কিছু একটা খোঁচা দিচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশ—হাত চলে যাও, দেখো কী হচ্ছে। একটু চুলকে দিলেই হয়তো চলবে। এই হলো ব্যাপার। কিন্তু আসল ব্যাপার একটু অন্য রকম। মশা তো জানে হাত চুলকাতে এলে তো সে রক্ত চুষে নিতে পারবে না। আর তা ছাড়া ত্বক ফুটো করে হুল ফোটানোও কঠিন। তাই প্রথমে সে তার হুল থেকে একধরনের রাসায়নিক পদার্থ বের করে, যা ত্বকের ওই অংশকে কিছুটা তেলতেলে ও নরম করে এবং সাময়িকভাবে অবশ করে। এরপর মশা নিশ্চিন্তে রক্ত চুষে চম্পট দেয়। আমরা টেরও পাই না। কয়েক সেকন্ড পর চুলকানি অনুভব করি। তখন মারি চাপড়। কিন্তু ততক্ষণে মশা হাওয়া। এ জন্যই মশা মারা এত কঠিন।

রক্ত চোষার সময় মশা তার শুঁড়ের সাহায্যে লালা ছড়িয়ে দেয়, যেন রক্ত জমাট না বাঁধে।
সংগৃহীত
আরও পড়ুন

প্রশ্ন :

মশা তাড়াবেন কীভাবে?

মশার জ্বালায় সবাই অস্থির। সিটি করপোরেশন তো রাস্তাঘাট, বাসাবাড়ির ভেতরে পর্যন্ত ওষুধ স্প্রে করেও কূলকিনারা পাচ্ছে না। বাসায় মশার কয়েল জ্বালাই। কত ধরনের স্প্রে করি। তাতে মশার উপদ্রব কমে বটে, কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই ফিরে আসে। তাই মশার হাত থেকে বাঁচার একটি সাধারণ ব্যবস্থা হিসেবে আমরা নিজের গালে, হাতে, মুখে চাপড় মারি। কিন্তু মশা তার আগেই চম্পট দেয়। তবে আমরা যদি সব সময় হাত দিয়ে মশা তাড়াই, তাহলে মশারাও কিন্তু হাল ছেড়ে দেয়। যে ব্যক্তি বেশি হাত নেড়ে মশা মারার চেষ্টা করেন, মশারা টের পেয়ে যায় যে তিনি সাংঘাতিক লোক।

তাই তাঁকে এড়িয়ে চলে। আমরা যেমন বিপদ এড়িয়ে চলি, মশারাও তেমনি বুঝতে পারে কার গায়ে হুল ফোটানো নিরাপদ। মশার আচরণ নিয়ে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁরা হাত দিয়ে অনবরত মশা মারার চেষ্টা করেন, তাঁদের গায়ের গন্ধ ও অন্যান্য খুঁটিনাটি বিষয় মশারা মাত্র ১৫ মিনিটেই বুঝে যায়। তখন আর তাঁকে ঘাঁটায় না। মানে তাঁদের গায়ে হুল ফোটানোর চেষ্টা করে না। বেশি বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ মশাকে আকৃষ্ট করে। অন্তঃসত্ত্বা নারীরা বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ ঘটান। তাই মশারা তাঁদের কামড়াতে বেশি আগ্রহী। মশার কামড়ে ম্যালেরিয়া থেকে চিকুনগুনিয়া, জিকা ভাইরাস—কত বিপজ্জনক অসুখ-বিসুখই না হয়। তাই মশা গায়ে বসলেই চাপড় লাগান। তখন মশারা ওই মানুষটার গায়ের গন্ধ, শরীরের তাপমাত্রা, ঘামের গন্ধ প্রভৃতি চিনে রাখবে।

সহজে আর ওদিকে যাবে না। আপনি মশার উপদ্রব থেকে বাঁচবেন। কিন্তু মানুষের শরীরের গন্ধে প্রায় ২০০ ধরনের রাসায়নিক পদার্থের উপাদান রয়েছে। এত বিশাল উপাদানের সংমিশ্রণ মশারা মনে রাখে কীভাবে? এ বিষয়ে পরিষ্কার কিছু জানা যায়নি। তবে গবেষকেরা মনে করেন, এখানে ডোপামিন একটি বড় ভূমিকা পালন করে। এই রাসায়নিক উপাদানটি মানুষ, মৌমাছি ও অন্যান্য পোকামাকড়কে নতুন কিছু শিখতে মস্তিষ্ককে উজ্জীবিত করে। তাই হাত দিয়ে নির্বিচারে মশা মারুন বা মারার চেষ্টা করুন, কয়েক মিনিটেই মশা আপনাকে ছেড়ে অন্য কাউকে হুল ফোটানোর জন্য চলে যাবে।

আরও পড়ুন

প্রশ্ন :

মশা কেন সহজে মারা যায় না?

আপনার হাতে মশা বসেছে। কামড়াচ্ছে। টেরও পাচ্ছেন। কিন্তু যে-ই না হাত দিয়ে মারতে গেলেন, মশা চম্পট! চাপড় দিয়ে মশা মারা যে কত কঠিন তা আমরা প্রায় সবাই জানি। মশার কামড়ে ম্যালেরিয়ার ভয় তো আছেই, আছে ডেঙ্গুরও ভয়। এখন এসেছে জিকা ভাইরাসের ভয়। গত আগস্টে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে যে রিও সামার অলিম্পিক গেমস অনুষ্ঠিত হলো, সেটাও প্রায় অনিশ্চিত হয়ে উঠেছিল এই ভাইরাসের কারণে। অবশ্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সেই আশঙ্কা দূর করেছে। অলিম্পিক ভালোভাবেই হয়ে গেছে। এডিস ইজিপটি (Aedes aegypti) এবং এইডিস আলবোপিকটাস (Aedes albopictus) প্রজাতির মশার মাধ্যমে জিকা ভাইরাস ছড়ায়।

সংক্রমিত ব্যক্তির সঙ্গে কারও শারীরিক সম্পর্কের কারণেও অন্য ব্যক্তির দেহে জিকা ভাইরাস যায়। কোনো সন্তানসম্ভবা নারীর দেহে এই ভাইরাস থাকলে অস্বাভাবিক ছোট মাথা নিয়ে তার শিশু জন্ম নিতে পারে। বাংলাদেশে অবশ্য এখনো জিকা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়নি। কিন্তু সাবধান থাকতে হবে। সাবধান তো হব, ওষুধ স্প্রে করে মশা নির্মূলের কর্মসূচি সিটি করপোরেশন চালাচ্ছে। তারপরও তো কিছু মশা থেকে যায় এবং ওরা নির্দয়ভাবে আপনার শরীরে হুল ফোটায়। আর তখন মারতে গেলে চট করে পালিয়ে যায়। ব্যাপার কী? মশা কামড়ালে আমরা সহজে মারতে পারি না কেন? পারি না, কারণ সে প্রথমেই ত্বকের নির্দিষ্ট অংশ সাময়িক ক্ষণের জন্য সামান্য অবশ করে দেয়। রক্ত চুষে নিয়ে উড়ে যাওয়ার পর আমরা ব্যথা অনুভব করে থাপ্পড় মারি, কিন্তু ততক্ষণে মশা চম্পট দিয়েছে!

রক্ত চোষার সময় মশা তার শুঁড়ের সাহায্যে লালা ছড়িয়ে দেয়, যেন রক্ত জমাট না বাঁধে। তাদের লালায় যে প্রোটিন থাকে, তা আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থা শনাক্ত করে বহিরাগত শত্রু হিসেবে তাকে আক্রমণ করে। এ কারণে আমরা মশার কামড়ে চুলকানি অনুভব করি। এডিস মশা সহজেই দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। কারণ, ওরা পেছন দিক থেকে এসে হাতের কনুই বা পায়ের গোড়ালিতে হুল ফোটায়। এসব মশা সাধারণত খুব ভোরে বা সন্ধ্যায় কামড়ায়। জোরে ফ্যান চালিয়ে ঘুমালে বা ফ্যানের বাতাসে বসে কাজ করলে মশারা সহজে কাছে আসতে পারে না। বাতাসের তোড়ে দূরে সরে যেতে বাধ্য হয়। আর তা ছাড়া, ফ্যানের বাতাসে আমাদের প্রশ্বাসের সঙ্গে বেরিয়ে আসা কার্বন-ডাই-অক্সাইডও দূরে চলে যায়।

মশা মূলত কার্বন-ডাই-অক্সাইডের গন্ধে ও শরীরের উষ্ণতায় আকৃষ্ট হয়ে কামড়াতে আসে। তাই ফ্যানের বাতাস মশার হাত থেকে বাঁচতে কিছুটা সাহায্য করে। অবশ্য মশারিতেও কাজ হয়। সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গেছে আরেক মজার তথ্য। এসব গবেষণায় দেখা গেছে, চামড়ায় ব্যাকটেরিয়া নির্গত রাসায়নিক পদার্থের ধরনের ওপরও মশা আকৃষ্ট হয়। আবার কিছু রাসায়নিকের প্রতি মশারা মোটেও আকর্ষণ বোধ করে না।

প্রশ্ন :

শীতকালে মশারা কোথায় যায়?

এবার হাড় কাঁপানো শীত পড়েছে। মজার ব্যাপার হলো প্রচণ্ড শীতে মশা উধাও। কেন? শীতের মধ্যে কি মশাদের কিছু না খেলেও চলে? অনেকেই জানি, ইউরোপ–আমেরিকায় বিশেষভাবে শীতকালে মশা থাকে না। মশার কামড়ও তেমন সহ্য করতে হয় না। স্ত্রী মশারা ডিম পাড়ার আগে আমাদের দেহে হুল ফুটিয়ে রক্ত চুষে নেয়।

তাদের ডিমের পুষ্টি সাধনের জন্য রক্ত দরকার। কিন্তু শীতকালে এরা বিপদে পড়ে। এর কারণ, এক প্রজাতির মশা ঠান্ডা রক্তের পতঙ্গ। এর অর্থ হলো এদের শরীরের তাপমাত্রা বাইরের আবহাওয়ার তাপমাত্রার সঙ্গে ওঠানামা করে। ২৬–২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এরা বেশ আরামে থাকে। কিন্তু তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেলে অস্বস্তি বোধ করে। এ সময় ওরা শীত এড়িয়ে চলার ভিন্ন আশ্রয় খুঁজে নেয়, যা হাইবারনেশন নামে পরিচিত।

ঢাকায় অবশ্য খুব কমই এত শীত পড়ে। এ মাসে ১০–১৫ ডিগ্রিতে নেমেছে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে ৪–৫ ডিগ্রি পর্যন্ত হয়। এ সময় মশারা ঘরের কোনা–ঘুপচি বা বাইরের ঝোপঝাড়ে একটু আশ্রয় খুঁজে নেয়। ঠান্ডা বাতাসের প্রবাহ এড়িয়ে চলে। প্রায়ই না খেয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে। অনেক মশা মারা যায়। বাকিরা শীতকালে একটু সরে থেকে গরমকালের জন্য অপেক্ষা করে। কোনোভাবে ফেব্রুয়ারিটা পার করতে পারলেই চলে। তখন আবার বেরিয়ে পড়ে আমাদের গায়ে হুল ফোটাতে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে শীতের দেশেও গড় তাপমাত্রা বাড়ার প্রভাব পড়ছে। এ জন্য ওইসব দেশে মানুষের দুশ্চিন্তা বাড়ছে। মশাসহ বিভিন্ন ধরনের কীটপতঙ্গের উপদ্রব ওইসব দেশে বাড়ছে।

আরও পড়ুন 

আরও জেনে নিন