রাসায়নিক বিক্রিয়া: সহজ পাঠ - ৪
রাসায়নিক বিক্রিয়া, বিশেষত জৈব রসায়নের বিক্রিয়া বুঝতে যে বিষয়গুলো ভালোভাবে জানতে হবে, সেগুলো সহজ ভাষায়, একজন রসায়নবিদের কলমে…
এ পর্বে বেশ কিছু রাসায়নিক বিক্রিয়ার উদাহরণের মাধ্যমে আগের আলোচিত ইলেকট্রোফাইল, নিউক্লিওফাইল, ইলেকট্রন দাতা গ্রুপ ও ইলেকট্রন উত্তোলনকারী গ্রুপ সম্পর্কে আবার তুলে ধরব। এতে শিক্ষার্থীরা আরও সহজে বিষয়গুলো সম্পর্কে ধারণা পাবে।
যেকোনো রাসায়নিক বিক্রিয়া বুঝতে ও বিশ্লেষণ করতে হলে আগের আলোচিত বিষয়গুলো স্মরণ রেখে ধারাবাহিকভাবে প্রশ্ন করতে হবে। বিক্রিয়ার ক্রিয়াকৌশল বা মেকানিজম বুঝতে হলে যৌক্তিকভাবে প্রশ্ন করে খুঁজতে হবে উত্তর। রাসায়নিক বিক্রিয়ার ক্রিয়াকৌশল মুখস্থ করার বিষয় নয়; বরং যৌক্তিক বিশ্লেষণ ও চর্চার মাধ্যমে উপভোগের বিষয়।
একটা উদাহরণ দিই। মনে করো, নিচের বিক্রিয়াটি থেকে কী যৌগ বা উৎপাদ (Product) পাওয়া যাবে, সে সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা নেই। একটা বিক্রিয়া থেকে একের বেশি উৎপাদও পাওয়া যেতে পারে বা পাওয়া যায়। শুরুতে আমরা সহজ ও সাধারণ উদাহরণ দেখি।
এ ধরনের একটা বিক্রিয়া দেখার পর শুরুতেই আমরা ধারাবাহিকভাবে কিছু প্রশ্ন করব। তারপর খণ্ড খণ্ডভাবে উত্তর বের করে সেই উত্তরগুলো জোড়া দিলেই পূর্ণাঙ্গ উত্তর পেয়ে যাব।
ওপরের বিক্রিয়ায় একটা অ্যালডিহাইড আছে। আর আছে সোডিয়াম সায়ানাইড। এ দুটি যৌগ বা বিকারক একটি দ্রাবকে মেশানো হলো। তাহলে মিশ্রণের পর আমরা কী পাব? কোন যৌগ বা উৎপাদ পাব?
প্রথমেই প্রশ্ন করব, ইলেকট্রোফাইল কোনটি? এখানে ইলেকট্রোফাইল হলো অ্যালডিহাইড। কার্বন–অক্সিজেন দ্বিবন্ধন, তথা কার্বনিলের কার্বন। কার্বনে ইলেকট্রনের ঘাটতি আছে, তাই এটি ইলেকট্রন গ্রহণের জন্য আগ্রহী বা ইলেকট্রনের প্রতি আসক্ত অথবা ইলেকট্রোফাইল।
আমরা তাহলে ইলেকট্রোফাইল পেয়ে গেলাম। এখন প্রশ্ন করব, নিউক্লিওফাইল কোনটি? কারণ, ইলেকট্রোফাইল থাকলে নিউক্লিওফাইল থাকবেই। এ ক্ষেত্রে যেহেতু শুধু সোডিয়াম সায়ানাইড আছে, তাহলে সোডিয়াম সায়ানাইড হলো নিউক্লিওফাইল। সোডিয়াম সায়ানাইডকে যদি আমরা আরও সহজভাবে প্রকাশ করি, তাহলে এটা বস্তুত সোডিয়াম আয়ন ও সায়ানাইড আয়ন আকারে দেখানো যায়। অনেকটা সোডিয়াম ক্লোরাইড বা লবণের মতো। সোডিয়াম সায়ানাইডে সায়ানাইড আয়নই হলো নিউক্লিওফাইল, যেহেতু এটা ঋণাত্মক চার্জ বা অতিরিক্ত ইলেকট্রন বহন করে।
আমরা ইলেকট্রোফাইল ও নিউক্লিওফাইল চিহ্নিত করেছি। আমরা জানি, ইলেকট্রোফাইল হলো ইলেকট্রন গ্রহীতা এবং নিউক্লিওফাইল হলো ইলেকট্রন দাতা। তাহলে সেভাবেই অঙ্কন করে প্রকাশ করব।
ওপরের চিত্রে প্রথম অ্যারো চিহ্ন বা বক্র তির চিহ্ন দিয়ে বোঝানো হচ্ছে, সায়ানাইড এক জোড়া ইলেকট্রন দিচ্ছে কার্বনিল কার্বনে। ফলে কার্বন–অক্সিজেনের একটা বন্ধন ভেঙে যাচ্ছে। সেটা দ্বিতীয় অ্যারো চিহ্ন দিয়ে দেখানো হয়েছে। একটা বন্ধন ভেঙে যাচ্ছে এবং আরেকটা নতুন বন্ধন তৈরি হয়েছে। নতুন বন্ধনকে লাল রং ব্যবহার করে হাইলাইট করা হয়েছে। আগেই বলেছি, এ ধরনের অঙ্কনকে বলা হয় ‘পুশ–পুল মেকানিজম’। সারা বিশ্বের রসায়নবিদেরা এই পদ্ধতি ব্যবহার করেন।
কার্বন–অক্সিজেনের একটি বন্ধন ভেঙে যাওয়ায় অক্সিজেন মূলত অক্সাইড আয়নে পরিণত হয়েছে। সেটা ঋণাত্মক আয়ন। যেহেতু বিক্রিয়ায় সোডিয়াম আছে, যেটি ধনাত্মক আয়ন, তাই অক্সাইড আয়নের সঙ্গে সোডিয়াম আয়ন দেখানো যায়। এ ক্ষেত্রে সোডিয়াম আয়নের কাউন্টার বা বিপরীত আয়ন হলো অক্সাইড আয়ন। কিন্তু অক্সাইড আয়ন তো খুব বিক্রিয়াপ্রবণ বা রিঅ্যাকটিভ। যেহেতু এটাও একটা নিউক্লিওফাইল, সেহেতু বিক্রিয়ায় যে অ্যাসিড ব্যবহার করা হয়েছে, সে অ্যাসিডের প্রোটনকে (হাইড্রোজেন আয়ন) ছিনিয়ে নেবে অক্সাইড। যেটা তৃতীয় অ্যারো চিহ্ন দিয়ে দেখানো হয়েছে।
সুতরাং এই বিক্রিয়া থেকে আমরা যে উৎপাদ পাব, সেটা হলো একটা সায়ানোহাইড্রিন যৌগ। রসায়নবিদেরা সময় বাঁচাতে পছন্দ করেন। তাই ওপরের বিক্রিয়ার মেকানিজমকে আরও সংক্ষিপ্ত, কিন্তু নির্ভুল রেখে নিচের মতো করেও প্রকাশ করা যায়। যদিও চর্চার মাধ্যমে ধীরে ধীরে সংক্ষিপ্ত ও দ্রুত মেকানিজম লেখার পারদর্শিতা তৈরি হয়। কিন্তু প্রধান কাজ হলো, মেকানিজম বুঝতে পারা। লজিক প্রয়োগ করে সমাধান করা।
একই জাতীয় আরেকটা বিক্রিয়া নিয়ে আমরা আলোচনা করব। নিচের বিক্রিয়াটি সম্পন্ন হলে কী যৌগ বা উৎপাদ পাব আমরা?
এখানেও দেখতে পাচ্ছি অ্যালডিহাইড। সুতরাং অ্যালডিহাইড হলো ইলেকট্রোফাইল; সঙ্গে আছে গ্রিগনার্ড বিকারক। কার্বন–ম্যাগনেশিয়ামের যৌগগুলোকে সাধারণভাবে এ নামে ডাকা হয়। বিজ্ঞানী গ্রিগনার্ডের নামে এই নামকরণ করা হয়েছে। কার্বন–ম্যাগনেশিয়ামের বন্ধনকে যদি আমরা বিশ্লেষণ করি, তাহলে বুঝতে বাকি থাকে না যে কার্বন হলো নিউক্লিওফাইল। কারণ, কার্বন ও ম্যাগনেশিয়ামের তড়িৎ ঋণাত্মকতার পার্থক্য অনেক। ফলে কার্বন আংশিক ঋণাত্মক ও ম্যাগনেশিয়াম আংশিক ধনাত্মক চার্জযুক্ত থাকে। ফলে নিউক্লিওফাইলও আমরা পেয়ে গেলাম।
সুতরাং প্রথম ধাপে নিউক্লিওফাইল আঘাত করবে ইলেকট্রোফাইলে। এই বিক্রিয়ায় দুটি বিষয় গুরুত্বসহকারে মনে রাখতে হবে। বিক্রিয়ায় কোন দ্রাবক নির্বাচন করব, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন এখানে আমি টিএইচএফ বা টেট্রাহাইড্রোফিউরানের উল্লেখ করেছি। এই দ্রাবক গ্রিগনার্ড বিক্রিয়ায় ব্যবহৃত হয়। দ্রাবকের ওপর বিক্রিয়ার সফলতা নির্ভর করে এবং দ্রাবক নির্বাচন করতে পারা একটা গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান। এ বিষয়ে এখানে বিস্তর আলোচনায় যাচ্ছি না। শুধু এ বিষয়টা খেয়াল রাখতে হবে।
আরেকটা বিষয় হলো, এই বিক্রিয়ার শুরুতেই অ্যাসিড যোগ করা যাবে না। প্রথমে অ্যালডিহাইডে ধীরে ধীরে যুক্ত করতে হবে গ্রিগনার্ড বিকারক। তারপর সেই মিশ্রণকে একটা নির্দিষ্ট সময় ধরে নাড়তে হবে। সবশেষে যোগ করতে হবে অ্যাসিডের দ্রবণ। অ্যাসিড দ্রবণের মাধ্যমে বস্তুত এই বিক্রিয়াকে ধ্বংস বা দমন করা হয়।
এই যে সিকোয়েন্স বা ধাপ অনুসারে বিকারক যুক্ত করা, এটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান। অনেক বিক্রিয়ার সফলতা এই ধারাবাহিকভাবে যুক্ত করা বা মেশানোর ওপর নির্ভর করে। সিকোয়েন্স অনুসরণ না করলে বিক্রিয়া সফল হবে না; অর্থাৎ আমরা যে যৌগ প্রত্যাশা করছি, সেটা পাব না। এই বিক্রিয়ায় তাপমাত্রাও দেখানো হয়েছে শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাসায়নিক বিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য মাঝেমধ্যে নিম্ন তাপমাত্রা কিংবা উচ্চ তাপমাত্রা ব্যবহার করা হয়। এ ধরনের বিক্রিয়া অনেক তাপ উৎপাদন করে। তাই নিম্ন তাপমাত্রায় বিক্রিয়া শুরু করলে সফলতার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
সুতরাং ওপরের বিক্রিয়া শেষে আমরা পাব একটি অ্যালকোহল যৌগ। এই যৌগের নাম ডাইফিনাইলমেথানল। মেথানলের দুটি হাইড্রোজেন পরমাণুর পরিবর্তে দুটি ফিনাইল গ্রুপ যুক্ত হলে এই যৌগ পাওয়া যায়। ওপরের বিক্রিয়াকেও রসায়নবিদেরা সময় সাশ্রয় করার জন্য সংক্ষিপ্তাকারে নিচের মতো করে এঁকেও প্রকাশ করেন।
ওপরে যে দুটি বিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে, সে দুটি বিক্রিয়ায় একটা কমন বিষয় আছে। সেটা হলো, একটা কার্বনিল ইলেকট্রোফাইলে একটা নিউক্লিওফাইল আঘাত করেছে এবং পরে যুক্ত হয়েছে। এ ধরনের বিক্রিয়াকে বলা হয় কার্বনিল গ্রুপে নিউক্লিওফিলিক সংযুক্তকরণ বিক্রিয়া বা সংক্ষেপে NAC।
এ ধরনের বিক্রিয়ার মাধ্যমে একটা নতুন বন্ধন তৈরি হয়। ওপরের ক্ষেত্রে তৈরি হয়েছে কার্বন–কার্বন বন্ধন, যেটা লাল রং দিয়ে দেখানো হয়েছে। রসায়নে কার্বন–কার্বন বন্ধন তৈরির বিক্রিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরনের বিক্রিয়ার মাধ্যমে প্রচুর রাসায়নিক যৌগ তৈরি করা হয়। এই শ্রেণির (NAC) আরও কয়েকটা উদাহরণ পরের পর্বে আলোচনা করা হবে।
তবে শেষ করার আগে আবারও বলি, যেকোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ার ক্রিয়াকৌশল বিশ্লেষণের জন্য আমরা শুরুতেই কয়েকটা প্রশ্ন করব। বিক্রিয়ায় ইলেকট্রোফাইল কোনটি? নিউক্লিওফাইল কোনটি? বিক্রিয়াটিতে কি অ্যাসিড আছে? কিংবা ক্ষার বা ক্ষারক? কোন দ্রাবক ব্যবহার করা হচ্ছে? বিক্রিয়াটিতে কি কোনো সিকোয়েন্স বা ধারাবাহিকভাবে বিকারক মেশাতে হবে? এসব প্রশ্নের খণ্ড খণ্ড উত্তর বের করে ক্রিয়াকৌশল আঁকতে হবে এবং বের করতে হবে চূড়ান্ত প্রোডাক্ট বা উৎপাদ। কিংবা ধারণা করতে হবে, বিক্রিয়া শেষে কী উৎপাদ তৈরি হতে পারে?
(চলবে)