জৈব যৌগের গঠন কীভাবে আঁকবে

জৈ ব যৌগের নাম শুনেছ নিশ্চয়ই। যেসব রাসায়নিক অণু বা যৌগ কার্বন ও হাইড্রোজেন পরমাণু দিয়ে গঠিত, সেগুলোকেই আমরা সাধারণভাবে জৈব যৌগ বা অর্গানিক মলিকিউল (Organic Molecule) বলি। কখনো কখনো এগুলোকে হাইড্রোকার্বনও বলা হয়, যেহেতু এগুলোতে হাইড্রোজেন ও কার্বন পরমাণু থাকে।

সব সময় যে শুধু কার্বন ও হাইড্রোজেনই থাকে, তা নয়। এই দুটি পরমাণুর পরিমাণ বা আনুপাতিক সংখ‍্যা বেশি থাকে। তবে অন‍্যান‍্য কিছু পরমাণু, যেমন অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, সালফার ইত‍্যাদিও থাকতে পারে।

জৈব যৌগ নামটির কারণ হলো জীবের যৌগ বা জীবনের যৌগ বা প্রাণের যৌগ। অর্থাৎ যেখানে প্রাণ আছে, সেখানেই জৈব যৌগ আছে। উদ্ভিদে, প্রাণীতে, ব‍্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসে মূলত জৈব যৌগই বেশি। মানুষের শরীরে অসংখ‍্য জৈব যৌগ প্রতিদিন ভাঙে এবং গড়ে। এই ভাঙা-গড়ার বিষয়টাকে বলা হয় রাসায়নিক বিক্রিয়া (Chemical Reaction)। আর রাসায়নিক বিক্রিয়াকে লিখে প্রকাশ ও বোঝানোর জন‍্য ব‍্যবহার করা হয় রাসায়নিক গঠন (Chemical Structure) এবং অন্যান‍্য চিহ্ন। তাহলে রসায়নিক সংকেত (Chemical Formula) ও রাসায়নিক গঠনের মূল পার্থক‍্যটা কী?

মূল পার্থক‍্য হলো, সংকেত শুধু বলে দেয় কোন কোন পরমাণু আছে, কতসংখ‍্যক আছে। কিন্তু রাসায়নিক গঠন বলে দেয় অণুতে পরমাণুগুলো কীভাবে বিন‍্যস্ত। কীভাবে একটা পরমাণুর সঙ্গে অন‍্য পরমাণু যুক্ত। রাসায়নিক গঠন অণু সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানার ও অনুধাবন করার সুযোগ দেয়। একটা উদাহরণ দিই।

তোমরা তো সবাই কমবেশি হ‍্যান্ড স‍্যানিটাইজার ব‍্যবহার করো। অনেক হ‍্যান্ড স‍্যানিটাইজারে একটা জৈব যৌগ ব‍্যবহার করা হয়। এর নাম আইসোপ্রোপাইল অ্যালকোহল। একে ২-প্রোপানলও বলা হয়। এই যৌগের রাসায়নিক সংকেত হলো C3H8O। অর্থাৎ অণুটিতে তিনটি কার্বন, আটটি হাইড্রোজেন ও একটি অক্সিজেন পরমাণু আছে। যৌগটির গঠন নিম্নরূপ:

রাসায়নিক গঠন থেকে প্রথমেই আমরা বুঝতে পারছি, অক্সিজেন পরমাণুটি কার সঙ্গে যুক্ত আছে। সেটি যুক্ত আছে একটি কার্বন এবং একটি হাইড্রোজেন পরমাণুর সঙ্গে। আরও জানতে পারছি, অক্সিজেন পরমাণুটি মাঝের কার্বন পরমাণুর সঙ্গে যুক্ত। যদি মাঝের কার্বন পরমাণুর সঙ্গে যুক্ত না হয়ে পার্শ্ববর্তী কার্বনের সঙ্গে যুক্ত থাকত, তাহলে কিন্তু সেটা আর আইসোপ্রোপানল হতো না। অন‍্য অণু হয়ে যেত। তাহলে বুঝতে পারলাম, রাসায়নিক গঠন থেকে আমরা কী করে বিভিন্ন তথ‍্য জানতে পারি। ফলে রাসায়নিক গঠন আঁকারও কিছু নিয়ম আছে।

জৈব যৌগের গঠন এঁকে প্রকাশের চেষ্টা শুরু হয় প্রায় ২০০ বছর আগে থেকে। তারপর কালের ধারাবাহিকতায়, বর্তমান সময়ে এসে, জৈব যৌগকে অনেক আধুনিক রূপে এঁকে প্রকাশ করা হয়। অণুদের যদিও আমরা খালি চোখে দেখি না, কিন্তু অসংখ‍্য অণুর গঠন আমরা নিশ্চিতভাবে নির্ণয় করেছি বিভিন্ন উন্নত যন্ত্রপাতি ব‍্যবহার করে, অণুদের নিয়ে গবেষণা করে।

আরও পড়ুন

জৈব যৌগ নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, গবেষণা করেন, তাঁদের বলা হয় অর্গানিক কেমিস্ট। জৈব রসায়নবিদ। তাঁরা জৈব যৌগ আঁকার বিষয়ে খুব পারদর্শী। এই পারদর্শিতা অর্জন করতে হয় শিখে ও চর্চা করে। কারণ, ভুল অঙ্কন করলে সবার কাছে সেটা সহজে বোধগম‍্য হয় না। তাই সারা দুনিয়ার অর্গানিক কেমিস্টরা জৈব যৌগ আঁকার জন‍্য কিছু নিয়ম অনুসরণ করেন। এটা একটা ভাষা। কারণ, একটা বিক্রিয়া সঠিকভাবে আঁকতে পারলে বহু শব্দ বলা হয়ে যায়। আলাদা করে ব‍্যাখ‍্যা করতে হয় না। রাসায়নিক গঠন হাতে আঁকা ছাড়াও বর্তমানে অনেক সফটওয়্যার ব‍্যবহার করা হয়। যেমন কেমড্র (ChemDraw)। সারা পৃথিবীর অর্গানিক কেমিস্টদের মধ্যে খুব প্রচলিত একটা সফটওয়্যার এটা। এই লেখার অঙ্কনের জন‍্য আমি সেটিই ব্যবহার করেছি। তবে অর্গানিক কেমিস্টরা হাতেও অঙ্কন করে শেখেন এবং অভ‍্যস্ত।

আজ আলোচনা করব জৈব যৌগ অঙ্কনের কিছু নিয়ম নিয়ে। বাংলাদেশে উচ্চতর পর্যায়েও অনেকে জৈব যৌগ আঁকার সঠিক নিয়ম অনুসরণ করেন না। আন্তর্জাতিকভাবে কীভাবে জৈব যৌগ অঙ্কন করা হয়, তা তুলে ধরা প্রয়োজন বলে মনে হলো। এই চর্চা কলেজ ও বিশ্ববিদ‍্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অনুসরণ করলে উপকৃত হবে। শিক্ষকেরা যদি এভাবে চর্চা করে শিক্ষার্থীদের উৎসাহী করেন, তাহলে শিক্ষার্থীরা সময়মতো সঠিক ও বৈশ্বিকভাবে গ্রহণযোগ‍্য বিষয়টা শিখতে পারবে।

লেখাটা ধারাবাহিকভাবে কয়েকটা পর্বে লেখা হবে। প্রথমে অঙ্কন এবং পরে জৈব যৌগের রাসায়নিক বিক্রিয়া নিয়েও সহজভাবে লেখা হবে।

আরও পড়ুন

আমরা যখন মিথেন (ম‍্যাথেইনও বলা হয়) অণুর সংকেত লিখি, তখন শুধু CH4 লিখি। একটা কার্বন পরমাণুর সঙ্গে চারটি হাইড্রোজেন পরমাণু যুক্ত। কিন্তু এটাকে যদি আরও একটু গভীরভাবে বোঝার জন‍্য আঁকি, তখন আঁকা হয় নিচের ছবির মতো (ছবি ২)। এভাবে এঁকে শুধু অণুটির সংকেতই বোঝানো হয় না; বরং এর জ‍্যামিতিক গঠন সম্পর্কেও ধারণা দেওয়া হয়। মিথেন অণু যে চতুস্তলকীয় (Tetrahedral), সেটা বোঝানো হয়। অণুদের এই নির্দিষ্ট গঠন এদের রাসায়নিক বিক্রিয়ার অনেক কিছু নির্ধারণ করে। এখন যদি ইথেন অণুকে লিখে প্রকাশ করা হয়, তাহলে লেখা যাবে C2H6 অথবা CH3-CH3। তবে অর্গানিক কেমিস্টরা আরও স্বল্প সময়ে এঁকে প্রকাশের জন‍্য সেটাকে ভিন্নভাবেও প্রকাশ করেন। আসলে অর্গানিক কেমিস্টরা সময়কে অনেক গুরুত্ব দেন।

এভাবে যখন কার্বন পরমাণুর সংখ‍্যা বেড়ে যায়, তাখন প্রতিটি কার্বন-হাইড্রোজেন বন্ধন দেখিয়ে রাসায়নিক গঠন লিখতে বা আঁকতে গেলে অনেক সময় লেগে যায়। আবার প্রচলিত নিয়মে অণুকে যেভাবে সরলরৈখিকভাবে দেখানো হয়, বাস্তবে অণুরা সে রকম সরলরৈখিক হয় না।

যেমন প্রোপেইন অণুতে তিনটি কার্বন পরমাণু আছে (ছবি ৩)। বিভিন্নভাবে এর রাসায়নিক গঠন প্রকাশ করা যায়। তবে আধুনিক নিয়মে, শুধু দুটি ছোট সরলরেখা যুক্ত করেই প্রোপেইন অণু বোঝানো হয়। রেখা দুটি যুক্ত করলে একটা কোণ তৈরি হয়, যেটা ১২০ ডিগ্রির মতো করে আঁকা। সে কোণের কার্বন পরমাণুটি হলো ম‍্যাথেলিন গ্রুপ (CH2) আর প্রান্তিক দুটি অংশ হলো ম‍্যাথাইল বা মিথাইল গ্রুপ (CH3)। এভাবে আঁকতে সহজ। সময় কম লাগে এবং ত্রিমাত্রিক গঠনও অনেকটা তুলে ধরা যায়। এখানে বিউটেইন, পেন্টেইন, হেক্সেইন অণুর উদাহরণ দেওয়া হলো (ছবি ৪)। শিক্ষার্থীরা এভাবে অন‍্য অণুগুলোও এঁকে চর্চা করতে পারো।

আরও পড়ুন

ওপরের অণুগুলোকে বলা হয় সম্পৃক্ত হাইড্রোকার্বন। সম্পৃক্ত বলতে কী বোঝানো হয়? কোনো জৈব যৌগে যখন সব কটি কার্বন পরমাণু একক বন্ধনে যুক্ত থাকে, সে যৌগকে বলা হয় সম্পৃক্ত হাইড্রোকার্বন।

এখন আমরা কার্বন পরমাণু গণনার চর্চা করব এবং হেক্সেইন অণুর উদাহরণ ব‍্যবহার করছি। ওপরে হেক্সেইন অণুর গঠন আঁকার পর গণনা করলে ছয়টি কার্বন পরমাণু পাব। চারটি কার্বন পরমাণু হলো অভ‍্যন্তরীণ (Internal; ২-৫) এবং দুটি কার্বন পরমাণু হলো প্রান্তিক (Terminal; ১ এবং ৬)। প্রান্তিক কার্বনগুলো হলো ম‍্যাথাইল বা মিথাইল গ্রুপ (CH3) এবং অভ্যন্তরীণ কার্বন পরমাণুগুলো ম‍্যাথিলিন গ্রুপ (CH2)।

ওপরে যেসব অণুর উদাহরণ দিয়েছি, সেগুলো সবই সরলরৈখিক বা লিনিয়ার অণু। এগুলোকে অচক্রিক বা acyclic অণুও বলা হয়। তার মানে চক্রিক বা cyclic অণুও আছে। সাইক্লোহেক্সেইন যেমন অচক্রিক হয়, তেমনি চক্রিকও হয়। তবে দুটো অণু কিন্তু এক না। আলাদা আলাদা গঠন।

নিচের অণুটি হলো সাইক্লোহেক্সেইন। নামের সঙ্গেই সাইক্লো যুক্ত করে চক্রিক বোঝানো হয়েছে।

সাইক্লোহেক্সেইনে কি কোনো মিথাইল গ্রুপ আছে? একটু চিন্তা করে দেখো। সাইক্লোহেক্সেইনের ত্রিমাত্রিক গঠনও আমরা জেনেছি। সাইক্লোহেক্সেইন মূলত চেয়ারের মতো গঠনে থাকে। অর্থাৎ এই গঠনে সবচেয়ে স্থিতিশীল বা স্টেবল। তাই এটাকে বলা হয় চেয়ার কনফরমেশন (Chair Conformation)। চেয়ার কনফরমেশন নিয়ে এখনই বিস্তর আলোচনা করব না। কারণ, পরে এ বিষয়টা আবারও আলোচনায় আসবে।

কয়েকটা অণু এঁকে এভাবে চর্চা করলেই পুরো বিষয়টি সহজ হয়ে যাবে। মনে রাখতে সমস‍্যা হবে না। রাসায়নিক গঠনের আধুনিক অঙ্কন আমরা শিখে গেলে অনেক কিছু বুঝতে এবং বোঝাতে সহজ হবে। রাসায়নিক বিক্রিয়া বুঝতেও অনেক সহজ হবে। বাংলাদেশের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী রাসায়নিক বিক্রিয়া বোঝে না বা তাদের কাছে কঠিন মনে হয়, তার একটা কারণ কিন্তু রাসায়নিক গঠন সম্পর্কে ভালোভাবে না জানা। পরের পর্বে আরও কিছু চমৎকার বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে।

লেখক: গবেষক ও লেখক

*লেখাটি ২০২৪ সালে বিজ্ঞানচিন্তার ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত