মনে করুন, আপনি কোনো রেস্তোরাঁয় বসে খাবারের জন্য অপেক্ষা করছেন। কিছুক্ষণ পর ওয়েটার আপনার সামনে মাংসের সুস্বাদু রান্না পরিবেশন করল। মোহনীয় গন্ধ ছড়াতে শুরু করেছে মাংসের। ক্ষুধার্ত আপনি তাতে কামড় দিতেই নরম মাংসের অপূর্ব স্বাদে মন ভরে উঠলো। রান্নার আগে কিন্তু মাংসের এমন সুন্দর গন্ধ ছিল না। রান্না করলে মাংসের কি পরিবর্তন হয়? এর পেছনেও আছে রসায়ন।
যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের এ এন্ড এম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ওয়েস অসবার্ন। তাঁর মতে, মাংস রান্না মানে একগুচ্ছ জটিল রাসায়নিক বিক্রিয়া সম্পন্ন করা। মাংসের গঠনে প্রোটিন খুব গুরুত্বপূর্ণ। রান্নার সময় মাংসে পানি ধরে রাখা এবং এর গঠন পরিবর্তন করার ক্ষেত্রেও প্রধান ভূমিকা পালন করে প্রোটিন৷
প্রায় ১৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রায় অ্যামিনো অ্যাসিড যখন শর্করার সঙ্গে বিক্রিয়া করে, তখন এই মেইলার্ড বিক্রিয়া ঘটে। এই বিক্রিয়ার ফলে শত শত স্বাদ ও গন্ধের যৌগ তৈরি হয়।
মাংসের প্রোটিনগুলোকে মোটামুটি তিন ভাগে ভাগ করা যায়। মায়োফাইব্রিলস, সারকোপ্লাজমিক প্রোটিন ও সংযোজক টিস্যু। মায়োফাইব্রিলস সংখ্যায় থাকে সবচেয়ে বেশি। আর সংযোজক টিস্যুর মধ্যে থাকে কোলাজেন। মাংসে তাপ দিলে প্রোটিনের বন্ধনগুলো ভেঙে যায়। একে বলা হয় প্রোটিন ডিনেচারেশন। বন্ধন ভেঙে যাওয়ায় বদলে যায় প্রোটিনের আকৃতি।
মায়োফাইব্রিলার প্রোটিনগুলো প্রায় ৪০-৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ভেঙে যেতে শুরু করে। আরও তাপ দিতে থাকলে প্রোটিনগুলো পুনর্গঠিত হয়ে ‘জেল’ তৈরি করে৷ জেল হচ্ছে এক ধরনের ত্রিমাত্রিক প্রোটিন জালক। এটি পানি আটকে রাখে এবং মাংসের স্তরকে শক্ত করে তোলে৷
একবারে বেশি তাপ দিলে মাংস খুব শুষ্ক আর শক্ত হয়ে যায়। কিন্তু ধীরে ধীরে তাপ দিলে ভেঙে যায় আরও প্রোটিন। ফলে মাংস আরও নরম হয়। দীর্ঘ সময় ধরে প্রায় ৭১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপ দেওয়া হলে কোলাজেন একটি জেল গঠন করে। এটি ধীরে ধীরে রান্না করা মাংসকে মসৃণ করে।
তবে রান্না করা মাংসের সেই বিশেষ সুস্বাদু, হালকা পোড়া পোড়া স্বাদ তৈরিতে সাহায্য করে একগুচ্ছ রাসায়নিক বিক্রিয়া। সম্মিলিতভাবে এসব বিক্রিয়াকে বলে মেইলার্ড বিক্রিয়া। প্রায় ১৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রায় অ্যামিনো অ্যাসিড যখন শর্করার সঙ্গে বিক্রিয়া করে, তখন এই মেইলার্ড বিক্রিয়া ঘটে। এই বিক্রিয়ার ফলে শত শত স্বাদ ও গন্ধের যৌগ তৈরি হয়। গবেষকেরা রান্না করা গরুর মাংসে ৮৮০টিরও বেশি যৌগ শনাক্ত করেছেন।
মাংসের মধ্যে ঘটতে থাকা রাসায়নিক বিক্রিয়ার হার এবং বিক্রিয়ার মাত্রা রান্নার পদ্ধতি, সময় এবং তাপমাত্রার ওপর নির্ভর করে। সৌদি আরবের কিং সৌদ বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি প্রকৌশল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও প্রধান সালেহ আল-ঘামদি।
অন্য একটি ধারাবাহিক বিক্রিয়ার কারণে মায়োগ্লোবিন নামে প্রোটিন পরিবর্তিত হয়। তাতে বদলে যায় লাল মাংসের রং। মাংস কম তাপে রান্না করলে মায়োগ্লোবিন আংশিকভাবে অক্ষত থাকে। তাই মাংসের গোলাপি বা লাল রং বজায় থাকে। কিন্তু প্রায় ৭৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় প্রোটিন সম্পূর্ণ ভেঙে যায়। তখন মাংসের রং হয়ে যায় বাদামি।
মাংসের মধ্যে ঘটতে থাকা রাসায়নিক বিক্রিয়ার হার এবং বিক্রিয়ার মাত্রা রান্নার পদ্ধতি, সময় এবং তাপমাত্রার ওপর নির্ভর করে। সৌদি আরবের কিং সৌদ বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি প্রকৌশল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও প্রধান সালেহ আল-ঘামদি। তাঁর মতে, মাংসের রোস্ট বা গ্রিল করলে এর মধ্যে মেইলার্ড বিক্রিয়া দ্রুত হয়। অন্যদিকে, মাংসের স্টু বা কষানো হলে এর মাঝে মেইলার্ড বিক্রিয়া ঘটে ধীরে। এছাড়া পশুর জাত, খাদ্য, লিঙ্গ এবং বয়সের ওপরও মাংসের স্বাদ নির্ভর করে। এমনকি কাঁচা মাংস কাটার আগে দেরি করা বা মৃত্যুর সময় পশুর মানসিক চাপ মাংসের স্বাদ ও কোমলতাকে প্রভাবিত করতে পারে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, মাংস ধীরে ও অল্প আঁচে রান্না করা সবচেয়ে ভালো।