কার্বন মনোক্সাইড কেন মানুষের জন্য বিপদজনক

প্রতীকী ছবি

কার্বন মনোক্সাইডকে বলা হয় নীরব ঘাতক। গ্যাসটি বিষাক্ত; কিন্তু রং, গন্ধ ও স্বাদহীন। তাই মানুষের পক্ষে শনাক্ত করা কঠিন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই গ্যাসটি আততায়ীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে বড় ধরনের ক্ষতি করতে পারে মানবদেহের। দীর্ঘ সময় গ্যাসটি শ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করলে মৃত্যুও হতে পারে। এ গ্যাসের সঙ্গে মানুষের পরিচয় প্রাচীনকালে, তবে এর সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা ভালোভাবে বুঝতে শিখেছেন মাত্র কয়েক শতক ধরে। ইতিহাস বিশেষজ্ঞদের মতে, কার্বন মনোক্সাইড গ্যাসে বিখ্যাত কজন মানুষ মারা গেছেন। এদের মধ্যে আছেন মিসরের সম্রাজ্ঞী ক্লিওপেট্রা ও মার্কিন লেখক এডগার অ্যালান পো।

কার্বন মনোক্সাইড গ্যাসের নামও আছে প্রায় দুডজন। এর মধ্যে আছে কার্বনিক অক্সাইড গ্যাস, কার্বন প্রোটোক্সাইড, অক্সাইড অব কার্বন, কার্বনিল, ওয়াটার গ্যাস, হাইড্রোকার্বন গ্যাস, পাউডার গ্যাস, কোল গ্যাস, কার গ্যাস ইত্যাদি।

মানুষের তৈরি বিভিন্ন উৎস থেকে কার্বন মনোক্সাইড নিঃসৃত হয়। যেমন অটোমোবাইল বা গাড়ির ইঞ্জিন, বহনযোগ্য জেনারেটর, ত্রুটিযুক্ত কেরোসিন বা গ্যাস হিটার ও বয়লার, ছিদ্রযুক্ত চিমনি ও ফার্নেস ইত্যাদি

জীবাশ্ম জ্বালানি বা কার্বন জ্বালানির উৎসগুলো পুরোপুরি দহন বিক্রিয়ায় বা পুড়ে উপজাত হিসেবে তৈরি হয় কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস। এর রাসায়নিক সংকেত CO2। কিন্তু এই দহন বিক্রিয়া অসম্পূর্ণ হলে তৈরি হয় কার্বন মনোঅক্সাইড গ্যাস (অনেকে একে ‘কার্বন মনো-অক্সাইড’—এভাবেও লেখেন)। এর সংকেত CO। সাধারণত দহনের সময় পরিবেশে অক্সিজেনের অভাব থাকলে এরকম অসম্পূর্ণ দহন বিক্রিয়া ঘটে। সংকেত থেকে সহজেই বোঝা যায়, কার্বন ডাই-অক্সাইড যৌগে থাকে একটি কার্বন পরমাণু ও দুটি অক্সিজেন পরমাণু। অন্যদিকে কার্বন মনোক্সাইডে থাকে একটি কার্বন ও একটি অক্সিজেন পরমাণু। গ্রিক শব্দ ‘মনো’ অর্থ এক এবং ‘ডাই’ অর্থ দুই। অর্থাৎ এ নামের মাধ্যমে যৌগে একটি নাকি দুটি অক্সিজেন পরমাণু, তা বোঝানো হয়। সোজা কথায়, কার্বন ডাই-অক্সাইড থেকে কার্বন মনোক্সাইডে একটি অক্সিজেন পরমাণু কম থাকে। অক্সিজেন কম, এমন পরিবেশে যৌগটা তৈরি হয় বলেই তা হয়।

মানুষের তৈরি বিভিন্ন উৎস থেকে কার্বন মনোক্সাইড নিঃসৃত হয়। যেমন অটোমোবাইল বা গাড়ির ইঞ্জিন, বহনযোগ্য জেনারেটর, ত্রুটিযুক্ত কেরোসিন বা গ্যাস হিটার ও বয়লার, ছিদ্রযুক্ত চিমনি ও ফার্নেস ইত্যাদি। সাধারণত এ কারণেই গাড়ি ও বাড়ির ভেতরে এই উদ্বায়ী গ্যাস নিঃসৃত হয়।

কার্বন মনোক্সাইডে থাকে একটি কার্বন ও একটি অক্সিজেন পরমাণু
কার্বন মনোক্সাইড কয়েক মিনিট একটানা প্রশ্বাসের সঙ্গে দেহে ঢুকলে মৃত্যু অবধারিত। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর প্রায় ৫০০ জনের মৃত্যু হয় এই বিষাক্ত গ্যাসে

আগেই বলেছি, মানুষসহ অন্যান্য প্রাণিদেহে এই গ্যাস বিষাক্ততা সৃষ্টি করে। ফলে স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপে বাধার সৃষ্টি হয়। এর প্রাথমিক বিপদ হলো, আমাদের দেহে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রোটিনের প্রতি কার্বন মনোক্সাইডের রাসায়নিক আকর্ষণ শক্তিশালী। সেই প্রোটিনটির নাম হিমোগ্লোবিন। হয়তো জানেন, আমাদের রক্তের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এ প্রোটিন। হিমোগ্লোবিনই ফুসফুস থেকে অক্সিজেন বহন করে দেহের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দেয়। আবার দেহের প্রত্যন্ত এলাকার কোষ বা টিস্যু থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড বহন করে ফুসফুসে নিয়ে আসে হিমোগ্লোবিন। সেটাই নিঃশ্বাসের সঙ্গে আমরা পরিবেশে ছেড়ে দিই। কিন্তু শ্বাসের (বিজ্ঞানের ভাষায়, প্রশ্বাস) সঙ্গে ফুসফুসে কার্বন মনোক্সাইড ঢুকলে কী ঘটে?

আসলে স্বাভাবিকভাবে বাতাস থেকে আমাদের ফুসফুসে শ্বাসের সঙ্গে অক্সিজেন ও কার্বন ডাই-অক্সাইড ঢুকছে। কিন্তু স্বাভাবিক মাত্রার কার্বন ডাই-অক্সাইড দেহের কোনো ক্ষতি করে না। কারণ তা কোনো বিক্রিয়া না ঘটিয়ে আবারও বাইরে বেরিয়ে যায় নিঃশ্বাসের সঙ্গে। কিন্তু কার্বন মনোক্সাইড ফুসফুসে ঢুকলে তা সরাসরি রক্তের সঙ্গে মিশে যায়। মানে রক্তের হিমোগ্লোবিনের সঙ্গে শক্তভাবে আটকে যায়। এই দুই যৌগ মিলে তৈরি হয় কার্বোক্সিহিমোগ্লোবিন (Carboxyhemoglobin)। ফলে হিমোগ্লোবিনের সঙ্গে আর কোনো অক্সিজেন যুক্ত হতে পারে না। পরিণতিতে অক্সিজেন পৌঁছাতে পারে না দেহের কোষগুলোতে। এভাবে অক্সিজেনের অভাবে বিভিন্ন টিস্যুতে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে মস্তিষ্কের নাজুক টিস্যুগুলোতে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। সে কারণেই কার্বন মনোক্সাইড বিষক্রিয়া থেকে কেউ বেঁচে গেলেও তার স্নায়বিক বিকলত্ব দেখা দেওয়ার আশঙ্কা থাকে। এই বিষে আক্রান্ত হলে সাধারণত মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা, দুর্বলতা, পেট খারাপ, বমি, বুকে ব্যথার মতো লক্ষণ দেখা দিতে পারে।

আরও পড়ুন

কার্বন মনোক্সাইড কয়েক মিনিট একটানা প্রশ্বাসের সঙ্গে দেহে ঢুকলে মৃত্যু অবধারিত। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর প্রায় ৫০০ জনের মৃত্যু হয় এই বিষাক্ত গ্যাসে। হিসেবে দেখা গেছে, ৬৬৭ পিপিএম ঘনত্বে দেহের ৫০ ভাগ হিমোগ্লোবিন কার্বোক্সিহিমোগ্লোবিনে পরিণত হতে পারে। দেহে কার্বোক্সিহিমোগ্লোবিনের মাত্রা ৫০ ভাগ হলে খিঁচুনি, কোমা বা মৃত্যু হতে পারে। আর ৫০০০ পিপিএম কার্বন মনোক্সাইড মাত্র মিনিটখানেক ফুসফুসে ঢুকলেই নিশ্চিত মৃত্যু (পিপিএম হলো পার্টস পার মিলিয়ন বা ১০ লাখের কত ভাগ, তার পরিমাপ)।

শুরুতেই বলেছি, গন্ধ ও রংহীনতার কারণে মানুষের পক্ষে বিষাক্ত এই গ্যাস শনাক্ত করা সম্ভব নয়। তাই এ থেকে বাঁচতে এখন অনেকেই বাসা-বাড়িতে কার্বন মনোক্সাইড অ্যালার্ম ব্যবহার করেন।

সূত্র: দেয়ার আর (নো) স্টুপিড কোয়েশ্চেনস…ইন সায়েন্স/ লেহ ইলসন

উইকিপিডিয়া