রসায়নের শতগল্প
পর্যায় সারণিতে ল্যান্থেনাইড মৌল কেন ১৪টি
প্রকৃতির সবখানেই রসায়ন। আমাদের দেহের কথাই বলি বা চারপাশ ঘিরে থাকা বাতাস, ফুলের ঘ্রাণ—সবকিছুতেই আছে রসায়ন। এর মূল কথাগুলো কি সহজে জানা সম্ভব? মহাবিশ্বের মতো বিপুল রসায়নের জগতের মূল বিষয়গুলো সহজ ভাষায় তুলে আনার সেই চেষ্টা করেছেন লেভ ভ্লাসভ ও দ্মিত্রিই ত্রিফোনভ। বাংলায় অনূদিত হয়েছে সরাসরি রুশ থেকে, রসায়নের শত গল্প নামে।
তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) মস্কোয় ছিল প্রগতি প্রকাশন। সেখান থেকে সরাসরি বাংলা অনুবাদটি প্রকাশিত হয়। সেটা ১৯৭৮ সালের কথা। অনুবাদ করেন দ্বিজেন শর্মা। অঙ্গসজ্জা করেছেন লেওনিদ লাম। ক্লাসিক এই বই এতদিন পরও প্রাসঙ্গিক। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য বইটি প্রকাশিত হচ্ছে ধারাবাহিকভাবে।
এদের নাম ল্যান্থেনাইড মালা। ল্যান্থেনামের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্যের জন্যই এই নামকরণ। এরা সংখ্যায় চৌদ্দ, জলবিন্দুর মতোই অবিকল পরস্পরসদৃশ। বিস্ময়কর রাসায়নিক সমতার জন্য এরা সবাই সারণির একটি মাত্র ঘরের বাসিন্দা। এর নাম ল্যাত্থেনাম কক্ষ, সংখ্যাক্রম ৫৭।
কাজটি কি মারাত্মক কোন বিভ্রান্তি নয়? মেন্ডেলিভ নিজে এবং অন্যান্য অনেক বিজ্ঞানীর মতে পর্যায়বৃত্ত সারণির প্রতিটি মৌলের একেকটি স্থান সুনির্দিষ্ট।
অথচ দেখছি চৌদ্দ জন বাসিন্দাকে এখানে একই ঘরে বোঝাই করা হয়েছে। তারা প্রত্যেকেই তৃতীয় দলের ষষ্ঠ পর্যায়ের মৌল।
এদের আলাদা করে অন্য দলের সঙ্গে রাখা হচ্ছে না কেন?
অনেক বিজ্ঞানীই এমন চেষ্টা করেছেন। মেন্ডেলিভও। তাঁরা সিরিয়াম, প্রাসিওডিমিয়াম ও নিওডিমিয়ামকে যথাক্রমে চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ দলে রেখেছিলেন। কিন্তু বিন্যাসটি সব যুক্তিতর্কের ব্যত্যয় ঘটাল। মেন্ডেলিভের সারণির প্রধান ও মাধ্যমিক দলগুলোতে একই ধরনের মৌল রয়েছে। কিন্তু সিরিয়াম আর জির্কোনিয়ামের মধ্যে কোনো মিল ছিল না, প্রাসিওডিমিয়াম ও নিয়োডিমিয়াম কিছুতেই চিনতে পারল না নায়োবিয়াম আর মোলিবডেনামকে। অন্যান্য বিরলমৃত্তিকা মৌলও (ল্যান্থানাম ও ল্যান্থেনাইড মালা এই সাধারণ নামেই পরিচিত) প্রতিসঙ্গী দলে আত্মীয় সন্ধানে বৃথাই ঘুরে মরল। পক্ষান্তরে, এরা নিজে ছিল যমজ ভাইদের মতোই অবিকল, অভিন্নসত্তা।
সারণির কোনো কোনো কোঠা ল্যান্থেনাইড মৌলের জন্য বরাদ্দ করা হবে? প্রশ্নটির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হতবুদ্ধি রসায়নবিদরা অসহায় কাঁধ ঝাঁকালেন। অবশ্য কী আর তাঁরা করতে পারতেন? তাঁরা নিজেরাই তো ল্যান্থেনাইডের আশ্চর্য সাদৃশ্যে হতবুদ্ধি!
কিন্তু শেষে দেখা গেল এর ব্যাখা খুবই সহজ।
পর্যায়বৃত্তে কিছু কিছু দুর্লভ মৌলের দল আছে যাদের পারমাণবিক সংযুতি কিছুটা অদ্ভুত ধরনের। এদের পরমাণুর শেষতম ইলেকট্রনটি প্রত্যন্ত, এমনকি এর আগের কক্ষপথেও অবস্থান করে না, ভৌত নিয়মের আক্ষরিক অনুসরণে তা প্রত্যন্ত কক্ষপথ থেকে তৃতীয় কক্ষপথটি ভেদ করে। জায়গাটি তার পক্ষে খুবই আরামের এবং স্থানত্যাগ তার ভারি অপছন্দ। তারা বিক্রিয়ালিপ্ত হয় দৈবাৎ।
যেহেতু সব ল্যান্থেনাইডেরই প্রত্যন্ত কক্ষপথের ইলেকট্রন সংখ্যা তিন, সে জন্য নিয়মানুসারে এরা ত্রিযোজী।
ল্যান্থেনাইডের সংখ্যা যে ঠিক ঠিক চৌদ্দ তা কিন্তু কোনো আপতিক ব্যাপার নয়। এদের পরমাণুর প্রত্যন্ত থেকে তৃতীয় কক্ষপথের চৌদ্দটি শূন্যস্থানই এর কারণ, আর তাই কক্ষপথটিও ইলেকট্রনলিপ্সু।
তাই ল্যান্থেনামের সঙ্গে সব ল্যান্থেনাইডেরই একই ঘরে রাখা রাসায়নিকদের কাছে যুক্তিসঙ্গত মনে হয়েছে।