রসায়নের শতগল্প
বিস্ময়কর ধাতু জগৎ
প্রকৃতির সবখানেই রসায়ন। আমাদের দেহের কথাই বলি বা চারপাশ ঘিরে থাকা বাতাস, ফুলের ঘ্রাণ—সবকিছুতেই আছে রসায়ন। এর মূল কথাগুলো কি সহজে জানা সম্ভব? মহাবিশ্বের মতো বিপুল রসায়নের জগতের মূল বিষয়গুলো সহজ ভাষায় তুলে আনার সেই চেষ্টা করেছেন লেভ ভ্লাসভ ও দ্মিত্রিই ত্রিফোনভ। বাংলায় অনূদিত হয়েছে সরাসরি রুশ থেকে, রসায়নের শত গল্প নামে।
তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) মস্কোয় ছিল প্রগতি প্রকাশন। সেখান থেকে সরাসরি বাংলা অনুবাদটি প্রকাশিত হয়। সেটা ১৯৭৮ সালের কথা। অনুবাদ করেন দ্বিজেন শর্মা। অঙ্গসজ্জা করেছেন লেওনিদ লাম। ক্লাসিক এই বই এতদিন পরও প্রাসঙ্গিক। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য বইটি প্রকাশিত হচ্ছে ধারাবাহিকভাবে।
পর্যায়বৃত্তে ধাতুর সংখ্যা ৮০টির বেশি। অধাতুর তুলনায় এদের সাদৃশ্য অবশ্য ঘনিষ্ঠতর। তবু ধাতুরাজ্যে বিস্ময়ের শেষ নেই।
যেমন, ধাতুর রঙের কথাই ধরা যাক। রসায়নবিদদের মতে, ধাতুমাত্রই লৌহঘটিত ও লৌহবিহীন—এই দুই ভাগে বিভক্ত। লৌহ ও লৌহধারীরা লৌহঘটিতের অন্তর্ভুক্ত। বাকি প্রায় সবগুলোই লৌহবিহীনের দলে, ব্যতিক্রম শুধু বড় ধাতুবর্গ—মহামান্য রৌপ্য, স্বর্ণ আর প্ল্যাটিনাম সদলবলে।
বিভাগটি আত্যন্তিক স্থূল আর ধাতু এই বৈষম্যহীনতায় নিজেই ক্ষুব্ধ।
প্রতিটি ধাতুই স্বকীয় বর্ণে বিশিষ্ট। এর গাঢ়, পাংশু অথবা রুপালি ভিতে নির্দিষ্ট আভাযুক্ত। অতি শুদ্ধ ধাতু পরীক্ষাক্রমে বিজ্ঞানীরা এ সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হয়েছেন। অনেক ধাতু বাতাসের সংস্পর্শে অচিরে অথবা বিলম্বে অক্সাইডের পাতলা আস্তরে ঢাকা পড়ে আর এদের আসল রংই তখন আড়াল হয়। কিন্তু বিশুদ্ধ ধাতুর বর্ণক্রম যথেষ্ট প্রসারিত। রক্তিম অথবা হলুদ রঙের খেলা, নীলাভ, হরিৎ-নীল সবুজাভ ধাতু, শরতের মেঘলা দিনের সমুদ্রজলের মতো গাঢ় ধূসর রং, কিংবা আয়নার মতো আলো-ঠিকরানো মসৃণ রূপালী ধাতু অভিজ্ঞ চোখের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে।
ধাতুর রং বহু হেতুনির্ভর এবং তন্মধ্যে এর উৎপাদনপদ্ধতিও অন্তর্ভুক্ত। গলানো অথবা না গলিয়ে জমাট বাঁধানো একই ধাতুর বর্ণভেদ সুস্পষ্ট।
ভর মাধ্যমেও ধাতু ভারি, মাঝারি ও হালকা হিসেবে শনাক্ত করা যায়।
এই ভর শ্রেণির মধ্যে কিন্তু রেকর্ড হোল্ডাররাও রয়েছে। লিথিয়াম, সোডিয়াম, পটাসিয়াম পানিতে ভাসে। এরা পানির চেয়ে হালকা। যেমন, লিথিয়ামের ঘনত্ব পানির প্রায় অর্ধেক। পানির ঘনত্ব একের সমান। তেমন সক্রিয় না হলে লিথিয়াম নানা কাজের চমৎকার উপকরণ হয়ে উঠত। লিথিয়ামের তৈরি একটি পুরো জাহাজ কিংবা গাড়ির কথা কল্পনা করুন। দুর্ভাগ্য, এমন আকর্ষণীয় একটি ধারণা রসায়নসিদ্ধ নয়।
ধাতুরাজ্যে অসমিয়াম ‘হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন’। এই ধাতুটির এক সি.সি.র ওজন ২২.৬ গ্রাম। দাঁড়িপাল্লায় এক সি.সি. অসমিয়ামকে সমান করতে তিন সি.সি. তামা, ২ সি.সি. সীসক অথবা চার সি.সি. ইট্রিয়াম প্রয়োজন হয়। অসমিয়ামের ঘনিষ্ঠতম প্রতিবেশী প্ল্যাটিনাম ও ইরিডিয়াম প্রায় তারই কাছাকাছি। বড় ধাতুগুলো সেরা ভরেরও বটে।
ধাতুর কাঠিন্য প্রবাদতুল্য। আমাদের ধারণায় সদাশান্ত ও স্থিরমস্তিষ্ক লোক লৌহস্নায়ুর অধিকারী। কিন্তু ধাতুরাজ্যে অবস্থাটি ভিন্নতর।
এখানে লৌহ কাঠিন্যের মাপকাঠি নয়। কাঠিন্যের চ্যাম্পিয়ন হলো ক্রোমিয়াম, যেন হীরার ছোট ভাই। কিন্তু অদ্ভুত শোনালেও সত্যি যে, কঠিনতম রাসায়নিক মৌল মোটেই ধাতু নয়। কাঠিন্যের প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী হীরা রূপধর কার্বন আর কেলাসিত বোরনই কঠিনতম মৌল। এখানে লৌহ তো নরম ধাতুরই দলে। সে ক্রোমিয়ামের অর্ধেকমাত্র কঠিন। আর হালকাগুলোর মধ্যে ক্ষারধাতুই সেরা পলকা। তারা মোমের মতো নরম।