নোবেল ২০২৩
গত বছর রসায়নে নোবেল পেলেন কারা, কেন
কোয়ান্টাম ডট। পৃথিবীর তুলনায় ফুটবল যতটা ছোট, ফুটবলের তুলনায় ততটাই ক্ষুদ্র এসব ন্যানোবিন্দু। আসলে ন্যানোকণা। আকার বদলালেই বদলে যায় যাদের রং। তিন গবেষক এসব ন্যানোকণা তৈরির পদ্ধতি এবং রঙের রহস্য সমাধান করেছেন। তাঁদের গবেষণার সূত্রে বর্ণিল হয়ে উঠেছে ন্যানোর জগৎ। সেই নোবেলজয়ী গবেষণার বিস্তারিত বর্ণনা, গুরুত্ব...
২০২৩ সালে রসায়নে নোবেল গেছে কোয়ান্টাম ডট বা ন্যানোক্রিস্টাল আবিষ্কারকদের ঘরে। কোয়ান্টাম ডট হলো কয়েক ন্যানোমিটার আকারের বস্তু, যার আকার কমিয়ে-বাড়িয়ে তার ধর্ম নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আশির দশকের শুরুতে প্রথম কোয়ান্টাম ডট আবিষ্কার করেন আলেক্সি ইয়াকিমভ এবং লুই ব্রুস। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে এই ন্যানোকণা তৈরির কার্যকর ও সহজ পদ্ধতি আবিষ্কার করেন মুঙ্গি বাওয়েন্ডি। এরপর বিজ্ঞানীরা বিপুলভাবে আকর্ষিত হন ন্যানোপ্রযুক্তির দুয়ার খুলে দেওয়া কোয়ান্টাম ডটের গবেষণায়।
কোয়ান্টাম ডট আবিষ্কার থেকে কীভাবে এবারের নোবেল পুরস্কার পর্যন্ত এল, জানতে প্রথমেই দেখা যাক, ক্ষুদ্র কোয়ান্টাম ডট আসলে কত ছোট। সাধারণ একটা কোয়ান্টাম ডটের আকার হয় মোটামুটি ২ থেকে ১০ ন্যানোমিটার। এক ন্যানোমিটার কতটুকু? মানুষের চুলের গড় প্রস্থ প্রায় ৭ হাজার ৫০০ ন্যানোমিটার। অর্থাৎ একটি চুল নিয়ে যদি লম্বালম্বি কেটে ৭ হাজার ৫০০ ভাগ করা হয়, তাহলে ওই চিকন চুলের প্রস্থ হবে এক ন্যানোমিটার। আমরা খালি চোখে এই চুল দেখতে পাব না, এমনকি সাধারণ শক্তিশালী মাইক্রোস্কোপ দিয়েও এক ন্যানোমিটার দেখা সম্ভব নয়। এ জন্য দরকার ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ।
একটা কোয়ান্টাম ডট কত ছোট, তা অন্যভাবেও ভাবা যায়। আপনি যদি পাশাপাশি পৃথিবী, একটি ফুটবল ও একটি কোয়ান্টাম ডট রাখেন, তাহলে পৃথিবীর তুলনায় একটি ফুটবল যত গুণ ছোট, একটি ফুটবলের তুলনায় কোয়ান্টাম ডট প্রায় তত গুণ ছোট।
একটি কোয়ান্টাম ডটে কয়েক হাজার অণু বা পরমাণু থাকে। কয়েক হাজার অণু বা পরমাণু থাকলে তার বিশেষত্ব কী? বিশেষত্ব বুঝতে প্রথমে দেখা যাক রসায়নবিদেরা কেন রাসায়নিক বিক্রিয়ার জন্য কঠিন বস্তু টুকরা টুকরা করতে চেষ্টা করেন। যেকোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ার জন্য বড় এক টুকরা বস্তুর চেয়ে সাধারণত ছোট টুকরা সুবিধাজনক। কারণ, ছোট টুকরার পৃষ্ঠতল তুলনামূলক বড়। আর রাসায়নিক বিক্রিয়ায় পৃষ্ঠতল বেশি হওয়া ভালো। যেকোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ার জন্য প্রথম শর্ত হলো, বিক্রিয়কগুলো একে অপরের সংস্পর্শে আসতে হবে। পৃষ্ঠতল বেশি হলে এক বিক্রিয়ক আরেক বিক্রিয়কের সংস্পর্শে আসতে পারে সহজে।
হারবার্ট ফ্রহলিখের তাত্ত্বিক প্রস্তাবের পরে এ বিষয়ে অনেক কাজ হয়েছে, বিশেষ করে কোনো পদার্থের ওপর অন্য আরেক পদার্থের থিন ফিল্ম বা খুব পাতলা প্রলেপ দেওয়ার প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা এগিয়েছে অনেক দূর।
জিনিসটি অন্যভাবে বোঝা সম্ভব। একটি আস্ত ইটের কথা চিন্তা করা যাক। একটি ইটের চারপাশে যদি সিমেন্ট-বালু দিয়ে জোড়া দিতে চাই, বাইরের অংশে সিমেন্ট-বালু লাগবে। এবার ইটটি যদি মাঝবরাবর ভেঙে দুই টুকরা করা হয়, তাহলে আগের পৃষ্ঠতল ঠিকই আছে, নতুন করে দুই টুকরায় নতুন পৃষ্ঠতল তৈরি হলো। এ অংশেও এখন সিমেন্ট-বালু লাগানো যাবে। আমরা যদি দুই টুকরাকে আবারও অর্ধেক করি, তাহলে নতুন আরও পৃষ্ঠতল তৈরি হবে। এভাবে টুকরা করতে থাকলে পৃষ্ঠতলের পরিমাণ বাড়তে থাকবে। টুকরা যত ছোট হবে, পৃষ্ঠতল তত বেশি হবে। বেশি অংশ তখন যেকোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ার জন্য উন্মুক্ত হবে। এ জন্য ছোট মাংসের টুকরা রান্না করা সোজা, পৃষ্ঠতল বেশি থাকে, বেশি অংশ মসলা-ঝোলের সংস্পর্শে আসতে পারে। একই কারণে যেকোনো রাসায়নিক কারখানায় ভালো উৎপাদনের জন্য গ্রাইন্ডিং মেশিন বা টুকরা করার যন্ত্র এক অপরিহার্য অংশ।
প্রশ্ন হলো, কোনো বস্তু ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর করলে কী হবে? ক্ল্যাসিক পদার্থবিদ্যা দিয়ে চিন্তা করলে পৃষ্ঠতল বাড়বে। আর রাসায়নিক বিক্রিয়ার ক্ষেত্রে বাড়বে এফিশিয়েন্সি বা কার্যকারিতা। কিন্তু ছোট করতে করতে যদি কোয়ান্টাম জগতে চলে যাওয়া হয়, যেখানে পদার্থের তরঙ্গধর্ম দেখা দেওয়া শুরু করে, তখন কী হবে? এ বিষয়ের তাত্ত্বিক আলোচনা ১৯৩৭ সালেই হারবার্ট ফ্রহলিখ করে গেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, ক্ষুদ্র ধাতব ক্রিস্টালে ইলেকট্রনের গ্যাস মডেল প্রয়োগ করলে তা বড় আকারের বস্তুর চেয়ে একদম ভিন্ন ফলাফল দেবে। তাঁর হিসাবে এ জন্য ১০ ন্যানোমিটারের চেয়ে ছোট বস্তু প্রয়োজন। ক্ষুদ্র বস্তু ও বিশাল বস্তুর এই পার্থক্য বেশি দেখা যাবে খুব কম তাপমাত্রায়, প্রায় শূন্য কেলভিনের কাছাকাছি।
হারবার্ট ফ্রহলিখের তাত্ত্বিক প্রস্তাবের পরে এ বিষয়ে অনেক কাজ হয়েছে, বিশেষ করে কোনো পদার্থের ওপর অন্য আরেক পদার্থের থিন ফিল্ম বা খুব পাতলা প্রলেপ দেওয়ার প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা এগিয়েছে অনেক দূর। কিন্তু সত্যিকার অর্থে ন্যানো আকৃতির ক্রিস্টাল বা কোয়ান্টাম ডটের সাফল্য দেখা দেয় গত শতাব্দীর আশির দশকে। প্রথম সাফল্যের দেখা পান আলেক্সি ইয়াকিমভ।
আলেক্সি ইয়াকিমভের সাফল্যের বহু আগে কাচশিল্পে অজান্তেই মানুষ কোয়ান্টাম ডট ব্যবহার করে আসছিল। প্রাচীন রোমে তৈরি কাপে ন্যানোপ্রযুক্তি ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। এর মধ্যে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত চতুর্থ শতকের লাইকারগাস কাপ সবচেয়ে বিখ্যাত। এই কাপের বাইরে থেকে আলো ফেললে সবুজ দেখায়, কিন্তু ভেতর থেকে আলো ফেললে কাপটি লাল দেখায়। আধুনিক ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ দিয়ে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এই কাপের কাচের মধ্যে স্বর্ণ ও রৌপ্যের ন্যানোকণা ব্যবহৃত হয়েছে।
শুধু প্রাচীন রোমেই নয়, এরপর মধ্যযুগ, রেনেসাঁ ও আধুনিক যুগেও কাচশিল্পে কারিগরদের অজান্তেই ন্যানোকণার ব্যবহার দেখা যায়। তাঁরা কাচ তৈরির সময় স্বর্ণ বা রৌপ্য যুক্ত করতেন। কত তাপে কাচ গলানো হচ্ছে এবং কীভাবে তা ঠান্ডা করা হচ্ছে, এর ওপর নির্ভর করে কাচের রং পরিবর্তন হয়। এর পেছনে আসল কারণ ছিল, ভিন্ন ভিন্ন তাপে বা ঠান্ডা করার পদ্ধতির ভিন্নতায় কাচের মধ্যকার কণার আকার ভিন্ন হতো। তাই নানা রঙের কাচ তৈরি সম্ভব হতো।
ইয়াকিমভ এরপর লক্ষ করেন, কপার ক্লোরাইড ক্রিস্টালের আকারের ওপর নির্ভর করছে ওই কাচ কোন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো শোষণ করছে। বড় আকারের ক্রিস্টাল আছে যে কাচে, সেগুলো সাধারণ কপার ক্লোরাইড যে আলো শোষণ করে, সেই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো শোষণ করছে।
পদার্থবিদদের নানা কারণে কাচের দরকার। বিশেষ করে এমন কাচ, যা নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো ফিল্টার করতে পারে। এ জন্য কাচশিল্পীদের থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে পদার্থবিদেরা কাচ বানানোর দক্ষতা রপ্ত করেন।
আলেক্সি ইয়াকিমভ সত্তরের দশকে কাচ নিয়ে কাজ শুরু করেন। তাঁর কাছে জিনিসটি অদ্ভুত মনে হয়। ক্যাডমিয়াম সেলেনাইড ও ক্যাডমিয়াম সালফাইডের মিশ্রণ যদি কাচে যুক্ত করা হয়, তাহলে এর রং হতে পারে লাল অথবা হলুদ। লাল বা হলুদ হওয়া নির্ভর করে কাচ তৈরির সময় তা কীভাবে তাপ দেওয়া হয়েছে এবং কীভাবে ঠান্ডা করা হয়েছে, তার ওপর। ইয়াকিমভ ভাবেন, একই বস্তুর কেন ভিন্ন রং হবে? এই মিশ্রণ যদি লাল হয়, সব সময় লাল হওয়ার কথা।
ইয়াকিমভ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শুরু করেন। তিনি কাচের মধ্যে কপার ক্লোরাইড যুক্ত করে গবেষণা করেন। এ ক্ষেত্রে তিনি ৫০০ থেকে ৭০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় কপার ক্লোরাইড যুক্ত কাচকে তাপ দেন। তিনি ১ ঘণ্টা থকে শুরু করে ৯৬ ঘণ্টা পর্যন্ত তাপ দিয়ে পরীক্ষা চালান। ঠান্ডা করে কাচগুলো এক্স-রে পরীক্ষা করে দেখেন, এর ভেতরে কোনো ক্রিস্টাল বা কেলাস আছে কি না। এক্স-রে ডিফ্র্যাকশনের মাধ্যমে ক্রিস্টালের গঠন ও তার আকারের ধারণা পাওয়া সম্ভব। ইয়াকিমভ দেখতে পান, এসব কাচের মধ্যে কপার ক্লোরাইডের ক্রিস্টাল তৈরি হয়েছে। কোনো ক্রিস্টালের আকার ২ ন্যানোমিটার, কোনোটা আবার ৩০ ন্যানোমিটার।
ইয়াকিমভ এরপর লক্ষ করেন, কপার ক্লোরাইড ক্রিস্টালের আকারের ওপর নির্ভর করছে ওই কাচ কোন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো শোষণ করছে। বড় আকারের ক্রিস্টাল আছে যে কাচে, সেগুলো সাধারণ কপার ক্লোরাইড যে আলো শোষণ করে, সেই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো শোষণ করছে। কিন্তু ক্রিস্টালের আকার যত ছোট হচ্ছে, সেগুলো তত ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো শোষণ করছে, যা থেকে উদ্ভব হচ্ছে নানা রঙের কাচ। আলেক্সি ইয়াকিমভ কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার সঙ্গে খুব ভালোভাবে পরিচিত ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারেন, তিনি বস্তুর আকারনির্ভর কোয়ান্টাম প্রভাব পর্যবেক্ষণ করেছেন।
কোয়ান্টাম ডট কেন ভিন্ন আকারের জন্য ভিন্ন আলোকধর্ম প্রদর্শন করে? এর কারণ ব্যাখ্যা করা যায় কোয়ান্টাম তত্ত্ব দিয়ে। ক্ষুদ্র আকৃতির কোয়ান্টাম ডটে ইলেকট্রনকে ধরা যায় কোয়ান্টাম তত্ত্বের বিখ্যাত ‘পার্টিকেল ইন আ বক্স’ হিসেবে। এই বক্স বা বাক্সে আটকে পড়া কণার শক্তিস্তর নির্ভর করে বাক্সের আকারের ওপর। আকারের বর্গের ব্যস্তানুপাতে শক্তি পরিবর্তিত হয়। অর্থাৎ আকার ক্ষুদ্র হলে শক্তিস্তরের পার্থক্য বৃদ্ধি পায়। অন্য কথায়, ক্ষুদ্র কণায় ইলেকট্রনকে উচ্চ শক্তিস্তরে পাঠাতে বেশি শক্তির প্রয়োজন পড়ে। এ জন্য যে কণা যত ক্ষুদ্র, সে কণা তত বেশি শক্তির তথা ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো শোষণ করে।
এভাবেই জন্ম হয় কোয়ান্টাম ডট যুগের। ইয়াকিমভ তখন কাজ করছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নে। সোভিয়েত রাশিয়ার এক জার্নালে তিনি এ গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেন ১৯৮১ সালে। তখনো ইন্টারনেটের যুগ আসেনি। কোথাও কোনো আবিষ্কার হলেই সমগ্র পৃথিবীর সব বিজ্ঞানীর কাছে সে খবর পৌঁছানো ছিল দুরূহ কাজ, ইয়াকিমভের আবিষ্কার তাই পশ্চিমের গবেষকদের কাছে খুব একটা পৌঁছায়নি। তাই লুই ব্রুস তখনো জানতেন না আকারনির্ভর কোয়ান্টাম প্রভাব বা কোয়ান্টাম ডটের কথা। তিনি আলাদাভাবে উদ্ভাবন করেন কোয়ান্টাম ডট। কিন্তু তাঁর উদ্ভাবন ছিল ভিন্ন, কাচের ম্যাট্রিক্সের মধ্যে নয়, দ্রবণের মধ্যে তিনি তৈরি করেন কোয়ান্টাম ডট, যা আলাদা করা সম্ভব।
লুই ব্রুস তখন কাজ করেন বেল ল্যাবরেটরিতে। অসাধারণ সব গবেষণার জন্য বেল ল্যাব বিখ্যাত। ব্রুসের নোবেল পুরস্কার ধরলে এখন পর্যন্ত তাদের ঝুড়িতে নোবেলের সংখ্যা ১০। ব্রুস তখন চেষ্টা করছিলেন সৌরশক্তি কাজে লাগিয়ে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটাতে। এ জন্য তিনি ব্যবহার করেন ক্যাডমিয়াম সালফাইড। ক্যাডমিয়াম সালফাইড এখানে প্রভাবকের কাজ করবে, সৌরশক্তি শোষণ করে বিক্রিয়া প্রদান করবে। ব্রুস এ ক্ষেত্রে বিক্রিয়ার ক্ল্যাসিক পদ্ধতি অনুসরণ করেন। দ্রবণের মধ্যে ক্যাডমিয়াম সালফাইডের ক্ষুদ্রাকৃতির কণা তৈরি করেন। তাঁর উদ্দেশ্য, ন্যানো আকৃতির কণা অনেক বেশি পৃষ্ঠতল দেবে, যা রাসায়নিক বিক্রিয়ার জন্য সহায়ক হবে।
বাওয়েন্ডির পদ্ধতির মূল ব্যাপার হলো, তিনি সরাসরি ক্যাডমিয়াম সেলেনাইড বা যে পদার্থের কোয়ান্টাম ডট বানাতে চান, দ্রবণে তা ইনজেক্ট করেন না। বরং তিনি নির্দিষ্ট কোয়ান্টাম ডট তৈরি করতে পারবে, এমন বিক্রিয়ক ইনজেক্ট করেন, যা শুধু নির্দিষ্ট তাপমাত্রাতেই ক্যাডমিয়াম সেলেনাইড বা অন্য কোয়ান্টাম ডটের ক্রিস্টাল তৈরি করে।
দ্রবণের মধ্যে ক্যাডমিয়াম সালফাইডের কণা রেখে দেওয়ার পরে তিনি লক্ষ করেন, বেশি সময় রেখে দিলে এগুলোর আলোকধর্ম বদলে যাচ্ছে। তিনি ধারণা করেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কণাগুলো একত্রে যুক্ত হয়ে বড় কণায় পরিণত হচ্ছে এবং কোনো একভাবে তা আলোকধর্মের ওপর প্রভাব ফেলছে। এ জন্য তিনি ৪ দশমিক ৫ ন্যানোমিটারের ফ্রেশ কণা প্রস্তুত করেন। কণাগুলো কিছু সময় রেখে দেওয়ার পর সেগুলো জোড়া লেগে আকার বেড়ে হয়েছে ১২ দশমিক ৫ ন্যানোমিটার। দেখা গেল, বড় কণাগুলো স্বাভাবিক বড় ক্যাডমিয়াম সালফাইডের মতো তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো শোষণ করছে। অন্যদিকে ছোট কণাগুলো ক্ষুদ্রতর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো শোষণ করছে। আলেক্সি ইয়াকিমভের মতো লুই ব্রুসও সিদ্ধান্তে আসেন, আকারনির্ভর কোয়ান্টাম ধর্ম আবিষ্কার করেছেন, তবে ভিন্ন একটা অবস্থার জন্য। ব্রুস তাঁর গবেষণা প্রকাশ করেন ১৯৮৩ সালে। জার্নাল অব কেমিক্যাল ফিজিকস-এ প্রকাশিত ব্রুসের নিবন্ধের রেফারেন্স থেকে দেখা যায়, তাঁরা আলেক্সি ইয়াকিমভের গবেষণা সম্পর্কে তখনো জানতেন না।
এরপর ব্রুস ও সহগবেষকেরা আরও নানা পদার্থের কোয়ান্টাম ডট তৈরি করেন। সব ক্ষেত্রে তাঁরা দেখতে পান, কয়েক ন্যানোমিটার আকারের কণা বড় কণার চেয়ে আলাদা আলোকধর্ম দেখায়। ক্ষুদ্র কণা সব সময় ক্ষুদ্রতর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো শোষণ করে। কোয়ান্টাম ডটের এ বিশেষ ধর্ম গবেষকদের জন্য নতুন এক জগৎ খুলে দেয়। পদার্থের চিরপরিচিত ধর্মের বাইরে নতুন সব ধর্ম উন্মোচন হতে থাকে।
সমস্যা বাধে ক্ষুদ্র আকারের কোয়ান্টাম ডট তৈরির পদ্ধতিতে। ব্রুস ও তাঁর সহকর্মীরা যে পদ্ধতিতে ন্যানোকণা তৈরি করছিলেন, তাতে একই আকারের কোয়ান্টাম ডট তৈরি করা ছিল দুরূহ। তাঁরা গড় আকার নির্দিষ্ট একটা সীমার মধ্যে রাখতে পারতেন, কিন্তু তাতে কিছু কণা থাকত বড়, কিছু থাকত ছোট। ন্যানোপ্রযুক্তি গড়ে তুলতে দরকার সব কণা একই আকারের হওয়া। এখানেই অবদান রাখেন মুঙ্গি বাওয়েন্ডি।
মুঙ্গি বাওয়েন্ডি যেভাবে কোয়ান্টাম ডট তৈরি করেন
বাওয়েন্ডি ১৯৮৮ সালে লুই ব্রুসের ল্যাবে পোস্ট ডক্টরাল গবেষক হিসেবে কাজ করেন। তখনই তিনি কোয়ান্টাম ডট তৈরির ভালো উপায় নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। পরে তিনি এমআইটিতে চলে আসেন গবেষক হিসেবে। সেখানে তিনি নতুন উপায় খুঁজতে থাকেন।
১৯৯৩ সালে বাওয়েন্ডির দল কোয়ান্টাম ডট তৈরির এক কার্যকর উপায় খুঁজে বের করতে সক্ষম হন। তাঁরা নির্দিষ্ট দ্রাবকের মধ্যে যে বস্তুর কোয়ান্টাম ডট বানাবেন, তা বানানোর জন্য প্রয়োজনীয় বিক্রিয়ক যুক্ত করে অতিসম্পৃক্ত দ্রবণ তৈরি করেন। বাওয়েন্ডি দেখতে পান, এভাবে অতিসম্পৃক্ত দ্রবণ বানিয়ে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় নিলে ন্যানোকণার ক্রিস্টাল তৈরি হতে শুরু করে। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে এই কণার আকার নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এভাবে তৈরি কোয়ান্টাম ডট অসাধারণ ফলাফল দেয়, সব কণার আকার একই রকম হয়। একই সঙ্গে কণাগুলোর পৃষ্ঠতল হয় মসৃণ। সব কণার আকার একই হওয়ায় আগের যেকোনো পদ্ধতির চেয়ে এই ন্যানোকণার ব্যবহারিক ধর্ম অনেক বেশি কার্যকর।
বাওয়েন্ডির পদ্ধতির মূল ব্যাপার হলো, তিনি সরাসরি ক্যাডমিয়াম সেলেনাইড বা যে পদার্থের কোয়ান্টাম ডট বানাতে চান, দ্রবণে তা ইনজেক্ট করেন না। বরং তিনি নির্দিষ্ট কোয়ান্টাম ডট তৈরি করতে পারবে, এমন বিক্রিয়ক ইনজেক্ট করেন, যা শুধু নির্দিষ্ট তাপমাত্রাতেই ক্যাডমিয়াম সেলেনাইড বা অন্য কোয়ান্টাম ডটের ক্রিস্টাল তৈরি করে। তাপমাত্রা কমিয়ে ফেললে ওই বিক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়, কোয়ান্টাম ডটের আকার বড় হতে পারে না। চাইলে তাপমাত্রা বাড়িয়ে আবারও ক্রিস্টাল তৈরি চালু করা যায়, যাতে আকার আরও বড় হয়। নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় অতিসম্পৃক্ত দ্রবণ যতক্ষণ রাখা হয়, ততক্ষণ কণার আকার বড় হতে থাকে। অর্থাৎ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করেই আকার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়।
কোয়ান্টাম ডট তৈরির এ সহজ ও কার্যকর পদ্ধতি অন্য রসায়নবিদদের বিপুলভাবে আকর্ষিত করে। শুরু হয় ন্যানোপ্রযুক্তির যুগ।
শেষ করার আগে কোয়ান্টাম ডটের কার্যকারিতার দিকটি আরেকটু দেখে নেওয়া যাক। উদাহরণ হিসেবে আমরা চিন্তা করতে পারি, ক্যাডমিয়াম সেলেনাইডই। ক্যাডমিয়াম সেলেনাইড একটি সেমিকন্ডাক্টর ম্যাটেরিয়াল। সেমিকন্ডাক্টর মানে এর বিদ্যুৎ পরিবাহিতা খুব একটা ভালো নয়। তবে অল্প শক্তি প্রয়োগ করলে এর বিদ্যুৎ পরিবাহিতা বাড়ানো যায়। প্রয়োজনীয় এই শক্তিকে বলা হয় ব্যান্ডগ্যাপ। সাধারণ আকারের ক্যাডমিয়াম সেলেনাইডের ব্যান্ডগ্যাপ ১ দশমিক ৮ ইলেকট্রন ভোল্ট। কিন্তু ন্যানো আকারের ক্যাডমিয়াম সেলেনাইডের আকার পরিবর্তন করে এর ব্যান্ডগ্যাপ ১ দশমিক ৮ থেকে ৩ ইলেকট্রন ভোল্ট পর্যন্ত কম-বেশি করা যায়। অন্য কথায় ক্যাডমিয়াম সেলেনাইডের ব্যান্ডগ্যাপ কোয়ান্টাম ডটের আকার পরিবর্তন করে আলোক বর্ণালির দৃশ্যমান অংশের যেকোনো তরঙ্গদৈর্ঘ্যের জন্য টিউন করা যায়, যা আলোর মাধ্যমে কোনো সেন্সর বা যন্ত্র নিয়ন্ত্রণের জন্য বিপুলভাবে সহায়ক।
কোয়ান্টাম ডট বিষয়ে কমবেশি পৃথিবীর প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে গবেষণা চলছে। যেকোনো রসায়ন বা পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের করিডরে হাঁটলে কোয়ান্টাম ডটের ওপরে দু–একটি পোস্টার দেয়ালে দেখতে পাওয়া স্বাভাবিক ঘটনা।
ভিন্ন আকারের কোয়ান্টাম ডট ভিন্ন আলোকতরঙ্গ শোষণ করলে সুবিধা কী? নানা রকম সুবিধা আছে। আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যায়। জীববিজ্ঞান গবেষণায় কোয়ান্টাম ডট ব্যবহার করা যায়। কোনো একটি জৈব প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ অণুর সঙ্গে একটি কোয়ান্টাম ডট যুক্ত করে দিয়ে কোষ বা দেহে প্রবেশ করিয়ে ওই অণুর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। যেহেতু নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো শুধু এই ন্যানোকণা শোষণ করবে, তাই সহজে এই পর্যবেক্ষণ সম্ভব। তা ছাড়া বর্তমানে টেলিভিশনের পর্দায় বা এলইডি বাতিতেও এটি ব্যবহার করা হচ্ছে, ব্যবহৃত হচ্ছে আরও অনেক ক্ষেত্রে।
রাসায়নিক শিল্পে ন্যানোকণা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে ক্যাটালিস্ট বা প্রভাবক হিসেবে। প্রভাবক রাসায়নিক বিক্রিয়াকে এফিশিয়েন্ট বা কার্যকর করে। ফলে কম শক্তি খরচ করে প্রয়োজনীয় পদার্থ তৈরি করা সম্ভব হয়। ন্যানোকণা যেহেতু আকার অনুযায়ী ভিন্ন ধর্ম প্রদর্শন করতে পারে, তাই ক্যাটালিস্ট হিসেবে কোয়ান্টাম ডটের ব্যবহার দিন দিন বিপুলভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কোয়ান্টাম ডট বিষয়ে কমবেশি পৃথিবীর প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে গবেষণা চলছে। যেকোনো রসায়ন বা পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের করিডরে হাঁটলে কোয়ান্টাম ডটের ওপরে দু–একটি পোস্টার দেয়ালে দেখতে পাওয়া স্বাভাবিক ঘটনা।
বর্তমান যুগকে বলা যায় ন্যানোপ্রযুক্তির যুগ। ন্যানো আকৃতির ইলেকট্রনিক চিপ এখন সব প্রযুক্তির প্রাণ। তাই কোয়ান্টাম ডট বা ন্যানোক্রিস্টালের উদ্ভাবকদের নোবেল পুরস্কার পাওয়া ন্যানো দুনিয়ার বাস্তবতার একধরনের স্বীকৃতি। এ পুরস্কার ন্যানোবিজ্ঞান ও ন্যানোপ্রযুক্তির লাখ লাখ গবেষক ও শিক্ষার্থীকে অনুপ্রাণিত করবে।