নোবেল জেতার সহজ উপায়

নোবেল পুরস্কাররয়টার্স

অক্টোবর মাসটায় নাকি বেশির ভাগ বিজ্ঞানীর মেজাজ খিটখিটে থাকে। অনেকে আবার দুশ্চিন্তায় ঠিকঠাক কাজে মন বসাতে পারেন না। বড় বড় বিজ্ঞানীদের অধীনে অনেক গবেষক কাজ করেন। এই মাসে তাঁরা খুব ভয়ে ভয়ে থাকেন। একটু উনিশ-বিশ হলেই কপালে জোটে কঠিন বকুনি! কেন, তা নিশ্চয়ই পাঠক বুঝতে পারছেন। এই মাসে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। (আর যাঁরা সেটা পান না, তাঁদের মেজাজটা খানিকটা খাট্টা হলে তাঁদের কি দোষ দেওয়া যায়?)

অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার সাধারণত নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। গত বছর, অর্থাৎ ২০২৩ সালে এই সোমবার পড়েছিল প্রথম সপ্তাহে। সে বার তাই ২ অক্টোবর থেকেই নোবেল ঘোষিত হয়েছে। এবার এই সোমবার পড়েছে দ্বিতীয় সপ্তাহে। ফলে ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হচ্ছে ২০২৪ সালের নোবেল পুরস্কার ঘোষণা।

নোবেল পুরস্কার কারা পাচ্ছেন, তা জানতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে গোটা বিশ্ব। কিন্তু আপনি যদি আগে থেকেই ঠিক করেন—ঠিক দ্য বিগ ব্যাং থিওরির শেলডন কুপারের মতো—একটা নোবেল আপনার চাই-ই চাই, তাহলে কী করা যায়? কী করতে পারেন আপনি? সত্যি বলতে, নোবেল পুরস্কার পাওয়ার কোনো নিশ্চিত ফর্মুলা নেই। সমীকরণ মিলিয়ে তাই নোবেল পাওয়ার উপায় নেই। এ ক্ষেত্রে শুধু আলফ্রেড নোবেলের কথাটি বলা যায়—

‘এক ভাগ দেওয়া হবে সেই ব্যক্তিকে যিনি পদার্থবিজ্ঞানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার বা উদ্ভাবন করবেন; এক ভাগ দেওয়া হবে সেই ব্যক্তিকে যিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক আবিষ্কার বা উন্নয়ন করবেন; এক ভাগ দেওয়া হবে সেই ব্যক্তিকে যিনি শরীরতত্ত্ব কিংবা চিকিৎসাবিজ্ঞানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করবেন; এক ভাগ দেওয়া হবে সেই ব্যক্তিকে যিনি কোন আদর্শ স্থাপনের লক্ষ্যে সাহিত্যে সবচেয়ে ভালো কাজ করবেন; এবং এক ভাগ দেওয়া হবে সেই ব্যক্তিকে যিনি দুটি দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব সৃষ্টির লক্ষ্যে, সেনাবাহিনীর বিলুপ্তি বা সৈন্যসংখ্যা কমানোর লক্ষ্যে, শান্তি সম্মেলনের আয়োজন ও প্রচারের লক্ষ্যে সবচেয়ে বেশি কিংবা সবচেয়ে ভালো কাজ করবেন।’ (বিস্তারিত জানতে পড়তে পারেন: আলফ্রেড নোবেলের উইল এবং নোবেল পুরস্কার।)

নোবেল বা কোনো পুরস্কারের জন্য গবেষণা করেন না সত্যিকারের গবেষকেরা। তাঁরা মূলত ভালো কোনো প্রশ্ন বা গুরুত্বপূর্ণ কোনো সমস্যা বেছে নেন। সেটা সমাধানের চেষ্টা করেন। আর ভাগ্য ভালো হলে, এই পথ চলতে চলতেই দারুণ কোনো ইউরেকা মোমেন্ট ধরা দেয়।
আলফ্রেড নোবেল
এআই আর্ট

এইটুকু আসলে জানা কথা। কিন্তু নোবেল জয়ীদের জীবন নিয়ে খুঁটিয়ে গবেষণা হয়েছে। লেখা হয়েছে রীতিমতো গবেষণাপত্র! তা আবার প্রকাশিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন-এর মতো জার্নালে।

এরকম লেখা আদতে কম নেই। এই লেখাগুলোয় দেখানো হয়, অল্প কিছু বিষয় সব নোবেল জয়ীর মধ্যেই দেখা যায়। তা, এসব থাকলে যে আপনি নোবেলটা পাবেনই, সে কথা নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই। তবে এসব না থাকলে আপনার নোবেল পাওয়ার সম্ভাবনা যে কমে যাবে, সেটুকু আপনি বিষয়গুলো পড়লেই বুঝবেন। (এখন কেউ কেউ বলতে পারেন, তা বাপু, তুমি তো ওসব জানোই, কিন্তু তুমি নোবেল পাচ্ছ না কেন? আসলে, যাঁরা নোবেল পান, তাঁরা তো আর এসবে চোখ দেন না। এই লেখকের মতো ঠুঁটো জগন্নাথেরাই এসব করেন বৈকি!)

তাহলে আসুন, দেখে নেওয়া যাক, কোন কাজগুলো করলে নোবেল পাওয়ার পথটা ত্বরান্বিত হয়।

নোবেল পুরস্কারের আশা করবেন না

হ্যাঁ! এ যেন ঠিক অমরত্বপ্রাপ্তির প্রথম শর্তের মতো। চাইলে পাবে না, না চাইলে পাবে! আসলে তা নয়। বিষয়টা হলো, নোবেল বা কোনো পুরস্কারের জন্য গবেষণা করেন না সত্যিকারের গবেষকেরা। তাঁরা মূলত ভালো কোনো প্রশ্ন বা গুরুত্বপূর্ণ কোনো সমস্যা বেছে নেন। সেটা সমাধানের চেষ্টা করেন। আর ভাগ্য ভালো হলে, এই পথ চলতে চলতেই দারুণ কোনো ইউরেকা মোমেন্ট ধরা দেয়। বড় কোনো সমস্যা সমাধান করে মানুষের উপকার করা—এটাই এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় পুরস্কার। তার ওপর উপরি মিলতে পারে নোবেলের মতো পড় পুরস্কারও! তবে সে কথা মাথায় রেখে গবেষণা করা যাবে না। কেউ যদি তা-ই করেন, সম্ভাবনা আছে, এ কুলও যাবে, ও কুলও যাবে।

পরীক্ষণ ব্যর্থ হোক!

নোবেল জয়ী মার্কিন পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইনম্যানের কথা হলো, এক্সপেরিমেন্টে ফেইল করলে, কোনো পরীক্ষণে সমস্যা দেখা দিলে তখন সেটা সমাধানের চেষ্টা করে করেই এগোয় বিজ্ঞান। ফলে আপনার এক্সপেরিমেন্ট বা পরীক্ষণ যদি ব্যর্থ হয়, ‘সবার অঙ্ক মেলে, শুধু আমার অঙ্ক মেলে না’—এমনটা ভাববেন না। বরং তার কারণ খুঁজে বের করুন। তারপর গবেষণাকে এগিয়ে নিন পরের ধাপে। তাহলে গবেষণা শুধু যে আরও পোক্ত হবে, তাই নয়; ত্বরান্বিত হবে আপনার বড় পুরস্কার প্রাপ্তির সম্ভাবনাও।

আরও পড়ুন
ইতিহাসে বারেবারে দেখা গেছে, একজন নোবেল জয়ীর অধীনে কাজ করতে করতেই এসেছে নতুন ইউরেকা মোমেন্ট। গুরুর উপদেশ কখনো মেনে, কখনো অমান্য করে কিংবা গুরুরই গবেষণার পরিমার্জন করেও নোবেল পেয়েছেন অনেকে।

অন্য বিজ্ঞানীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন

নেটওয়ার্কিং ও কোলাবোরেশন—নোবেল প্রাপ্তির এ এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। কারণটা বোঝাও খুব কঠিন নয়। নোবেল পেতে হলে আপনাকে কারো মনোনয়ন দিতে হবে। সেটা দেবেন কে? যাঁদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক ভালো, তাঁরা আপনার কাজটা খুঁটিয়ে দেখে যদি ভালো মনে করেন, সম্ভাবনা আছে, তাঁরাই মনোনয়ন দেবেন আপনাকে আগবাড়িয়ে। আবার ‘ওয়ার্ড অব মাউথ’, মানে তাঁদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়বে আপনার গবেষণার কথা। ফলে সেটা আপনাকে এগিয়ে দিতে পারে আরও দশজনের চেয়ে।

সহযোগী একজন হলে ভালো হয়, দুজনের বেশি নয়

জানেনই তো, নোবেল দেওয়া হয় তিনজনকে। কাজেই তিনের বেশি মানুষ মিলে গবেষণা করলে বাদ একজন পড়বেনই! সেই বাদ পড়ার তালিকায় পড়তে না চাইলে আগে থেকেই সর্বোচ্চ দুই বিজ্ঞানীকে নিয়ে দল করলে ভালো। অন্তত এমনটাই বলে বিজ্ঞানের ইতিহাস।

আগের নোবেল জয়ীদের অধীনে কাজ করুন

ইতিহাসে বারেবারে দেখা গেছে, একজন নোবেল জয়ীর অধীনে কাজ করতে করতেই এসেছে নতুন ইউরেকা মোমেন্ট। গুরুর উপদেশ কখনো মেনে, কখনো অমান্য করে কিংবা গুরুরই গবেষণার পরিমার্জন করেও নোবেল পেয়েছেন অনেকে। এর আদর্শ উদাহরণ নীলস বোর। গুরু রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেল পরিমার্জন করে শুধু নোবেলই পাননি, কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অগ্রপথিক হিসেবেও ইতিহাসে খোদিত হয়ে আছে তাঁর নাম।

পরিবার বাছাই করতে হবে সতর্কভাবে

ইতিহাস বলছে, নোবেল জয়ী সাতটি পরিবার আছে। অর্থাৎ অন্তত সাতটি পরিবারে নোবেল জয়ীদের পরিবারের সদস্যরাও পেয়েছেন নোবেল। সেটা কখনো স্বামী-স্ত্রী, কখনো বাবা/মা-সন্তান—যেন তাঁদের ভাগ্যে নোবেলটা লেখাই আছে! (পড়ুন: নোবেলজয়ী সাত পরিবার।) কাজেই আপনিও যদি নোবেল জয়ী কোনো পরিবারের সদস্য হন, তাহলে শিকে ছিঁড়তে পারে সহজেই!

আরও পড়ুন
বিচারকদের স্বীকৃতি পেতে অনেক সময় বিজ্ঞানীদের কয়েক দশক পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করার তাই বিকল্প নেই। তবে শুধু অক্টোবরে খানিকটা ধৈর্যহানি হলে কেউ আপনাকে দোষ দেবে না।

সহকর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করবেন না

আগেই তো বলেছি, মনোনয়ন ছাড়া নোবেল পাওয়া সম্ভব নয়। আপনার সহকর্মীরাই যদি মনোনয়ন দিয়ে থাকেন, তবে তাঁদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করলে কমে যেতে পারে নোবেল পাওয়ার সম্ভাবনা। ইতিহাসেই আছে এর ভুরি ভুরি উদাহরণ। তবে উদাহরণে না গিয়েও বলা যায়, মানুষের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা কোনো ভালো কাজ নয়। মেজাজ গরম হলেও একটু ঠান্ডা থাকুন। কে জানে, ওই ব্যক্তিটিই হয়তো কোনোদিন মনোনীত করতে পারেন আপনাকে নোবেল পুরস্কারের জন্য!

এ ছাড়াও কারণ খুঁজলে পাওয়া যাবে আরও কিছু। কী ধরনের গবেষণাগুলোতে বেশি নোবেল দেওয়া হয়, কোন পদকগুলো পেলে নোবেল প্রাপ্তির সম্ভাবনা বাড়ে—এরকম অনেক ব্যাপার আছে। তবে সবচেয়ে বড় বিষয়টি হলো ধৈর্য। এই একটা জিনিস সবচেয়ে বেশি লাগে নোবেল পুরস্কার জিততে। বিচারকদের স্বীকৃতি পেতে অনেক সময় বিজ্ঞানীদের কয়েক দশক পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করার তাই বিকল্প নেই। তবে শুধু অক্টোবরে খানিকটা ধৈর্যহানি হলে কেউ আপনাকে দোষ দেবে না। মনে মনে সবাই যে আসলে এই ব্যাপারে কিছু না কিছু ভাবেন, আশা করেন—সেটা তো সবারই জানা!

সূত্র: নোবেল প্রাইজ ডটঅর্গ/এফএকিউ;

ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন

বিজ্ঞানচিন্তা

উইকিপিডিয়া

আরও পড়ুন