অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহজুড়ে ঘোষণা হবে পাঁচটি বিষয়ে এ বছরের নোবেল বিজয়ীদের নাম। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে সম্মানিত এই পুরস্কার কাদের হাতে যাবে, তা নিয়ে সবার মধ্যেই কম-বেশি কৌতূহল থাকে। নোবেল পুরস্কারের পুরো প্রক্রিয়াটি সর্বোচ্চ গোপনীয়তায় ঢাকা। কোন কোন বিজ্ঞানী মনোনীত হয়েছেন, তা জানতে অপেক্ষা করতে হয় বহু বছর। তবু কৌতূহল থেমে থাকে না। এই লেখায় তাই অনুমান করার চেষ্টা করব সম্ভাব্য কাদের হাতে যেতে পারে এ বছরের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল।
পদার্থবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ যে কাজগুলো এখনো নোবেল জেতেনি, সেগুলো মোটামুটি প্রতিবারই সম্ভাব্য বিজয়ী হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই গত বছরের তালিকার প্রায় সবাই-ই থাকবেন এবারও। পদার্থবিজ্ঞানের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার, যেমন উলফ প্রাইজ, ব্রেকথ্রু প্রাইজ, ডিরাক মেডেল, নিউটন মেডেল ইত্যাদি পুরস্কারও ভবিষ্যত নোবেল বিজয়ী হওয়ার ভালো পূর্বাভাস দেয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৯৭৮ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে দেওয়া ২৬টি উলফ প্রাইজ বিজয়ীর ১৪ জনই পরে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। আবার গবেষণাপত্রের সাইটেশন, এইচ-ইনডেক্স ইত্যাদিও কোন গবেষণাটি গুরুত্বপূর্ণ, তা বোঝার আরেকটি ভালো উপায়। তবে অনেক বছর দেখা যায়, আলোচনার বাইরে কোনো একটা পুরাতন গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারকে নোবেল দেওয়া হয়েছে।
আরেকটি মজার ট্রেন্ড গত দুই দশক ধরে লক্ষ করা যাচ্ছে। দুই-এক বছর বাদে একবার মহাবিশ্ব (জ্যোতির্বিজ্ঞান/কণাপদার্থবিজ্ঞান) তো অন্য বার আলো ও পদার্থ (লাইট-ম্যাটার)—এভাবে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। এই ট্রেন্ডের বাইরে গিয়ে অনেক বছর পরে ২০২১ সালে স্ট্যাটিস্টিক্যাল ফিজিকস বা পরিসংখ্যানগত পদার্থবিজ্ঞান থেকে নোবেল দেওয়া হয়েছিল। ২০২২ ও ২০২৩ সালে আবার যথাক্রমে কোয়ান্টাম মেকানিকস ও আলোকত্ত্বের ওপর নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।
আমার ধারণা, এবারও আলো ও পদার্থ (লাইট-ম্যাটার) শাখা থেকেই নোবেল পুরস্কার দেওয়া হবে, কারণ মহাবিশ্ব সংক্রান্ত বড় বড় প্রায় সব কটি অর্জনই নোবেল পেয়েছে অথবা বিজ্ঞানীরা আর জীবিত নেই (যেমন ভেরা রুবিন)।
কোয়ান্টাম কম্পিউটিং: চার্লস এইচ বেনেট, জিলে ব্রাসা, পিটার শর, ডেভিড ডয়েচ, ইগ্নাসিও সিরাক, পিটার জোলার
গত দশক ও সামনের কয়েক দশকের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিগত আবিষ্কার হতে যাচ্ছে কোয়ান্টাম কম্পিউটার। মার্কিন বিজ্ঞানী চার্লস বেনেট ও কানাডিয়ান বিজ্ঞানী জিলে ব্রাসা মিলে আবিষ্কার করেন কোয়ান্টাম ক্রিপ্টোগ্রাফির বিবিএইটিফোর (BB84) প্রোটোকল। দুজন মিলে ২০১৮ সালে পেয়েছেন উলফ প্রাইজ। ২০১৭ সালে বেনেট পান ডিরাক মেডেল, যাতে তাঁর সঙ্গী ছিলেন মার্কিন গণিতবিদ পিটার শর ও ব্রিটিশ পদার্থবিদ ডেভিড ডয়েচ। পিটার শর তাঁর শর অ্যালগোরিদমের জন্য বিখ্যাত, যা ব্যবহার করে কোয়ান্টাম কম্পিউটার সাধারণ কম্পিউটারের চেয়ে অনেক অনেক গুণ দ্রুত ক্রিপ্টোগ্রাফি ভাঙতে পারে। ডেভিড ডয়েচ কোয়ান্টাম ট্যুরিং মেশিন ও বেল ইনেকুয়ালিটি নিয়ে কাজ করেছেন। এই চারজন একসঙ্গে পেয়েছেন ২০২৩ সালের ফান্ডামেন্টাল ফিজিকস ব্রেকথ্রু প্রাইজ। এই চারজনের মধ্যে দুই বা তিনজনকে একসঙ্গে নোবেল পুরস্কার পেতে দেখা যেতে পারে (সর্বোচ্চ তিনজনকে নোবেল পুরস্কার ভাগ করে দেওয়া হয়)।
ছবি: চার্লস এইচ বেনেট, জিলে ব্রাসা, পিটার শর ও ডেভিড ডয়েচ
এদের বাইরে কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের প্র্যাক্টিক্যাল বা ব্যবহারিক দিক নিয়ে চিন্তা করলে স্প্যানিশ বিজ্ঞানী ইগ্নাসিও সিরাক ও অস্ট্রিয়ান তাত্ত্বিক পদার্থবিদ পিটার জোলারকে যুগ্মভাবে বিবেচনা করা হতে পারে। তাঁরা যৌথভাবে আয়ন, কোল্ড অ্যাটম সিস্টেম ব্যবহার করে কোয়ান্টাম কম্পিউটার ও সিমুলেটর তৈরির তত্ত্ব ও এক্সপেরিমেন্ট বা পরীক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। এঁরা দুজন যৌথভাবে ২০১৩ সালে উলফ প্রাইজ পেয়েছিলেন। পাশাপাশি জোলার ডিরাক মেডেলও পেয়েছেন।
ছবি: ইগ্নাসিও সিরাক ও পিটার জোলার
কোয়ান্টাম মেকানিকস: ইয়াকির আহারোনভ, মাইকেল বেরি
কোয়ান্টাম মেকানিকসের মৌলিক দুটি বিষয় হলো আহারোনভ-বোহম ইফেক্ট এবং বেরি ফেইজ। ইলেকট্রিক ও ম্যাগনেটিক, অর্থাৎ তড়িৎ ও চৌম্বক—দুই ফিল্ড বা ক্ষেত্রই যদি শূন্য হয়, তবে ক্লাসিক্যাল ফিজিকস বা চিরায়ত বলবিদ্যা বলে যে চার্জিত কণার ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না। কিন্তু কোয়ান্টাম মেকানিকস বলে, যদি ইলেকট্রোম্যাগনেটিক পটেনশিয়াল বা তড়িৎ-চৌম্বক বিভব শূন্য না হয়, তবে ওই পটেনশিয়ালের সঙ্গে চার্জিত কণার ওয়েভ ফাংশন কাপলিংয়ের মাধ্যমে কণার ওপর প্রভাব দেখা যাবে—আর পরীক্ষায় তা-ই প্রমাণিত হয়।
এই এক্সপেরিমেন্টের সঙ্গে যুক্ত আরও মৌলিক একটি বিষয় হলো জিওমেট্রিক ফেজ। পঞ্চাশের দশকেই এ বিষয়ে গবেষণাপত্র থাকলেও (পঞ্চরত্নম, লংগুয়ে-হিগিন্স) মাইকেল বেরি ১৯৮৪ সালে এই ধারণাকে সাধারণ গাণিতিক রূপ দেন এবং বেরি ফেইজ হিসেবেই বিষয়টি পরিচিত হয়। এই দুই আবিষ্কারের সঙ্গে যুক্ত বাকিরা মারা গেছেন। আহারোনভ ও বেরি ১৯৯৮ সালে একসঙ্গে উলফ প্রাইজও পেয়েছিলেন এবং অনেক বছর ধরেই নোবেল পুরস্কারের ফেভারিটের তালিকায় ছিলেন। এরকম অনেক বছর ধরে নোবেল না পাওয়া বেল ইনেকুয়ালিটির প্রমাণ অবশেষে ২০২২ সালে এসে স্বীকৃতি পায়। তাই এ বছর আহারোনভ ও বেরিকে নিয়ে আশাবাদী হওয়া যায়।
ছবি: ইয়াকির আহারোনভ ও মাইকেল বেরি
টুইস্টেড বাইলেয়ার গ্রাফিন: রাফি বিস্ট্রিজার, অ্যালান ম্যাকডোনাল্ড, পাবলো জারিয়ো-হেরেরো
একুশ শতকের সবচেয়ে চমকপ্রদ আবিষ্কারগুলোর একটি গ্রাফিন। ২০০৪ সালে আন্দ্রে গাইম ও কন্সট্যানটিন নোভোসেলোভ মাত্র এক স্তরের গ্রাফিন খুব সহজে এবং প্রথমবারের মতো আলাদা করতে সক্ষম হন, যা তাঁদের এনে দেয় ২০১০ সালের নোবেল পুরস্কার। এর পর থেকে গ্রাফিন নিয়ে সারা বিশ্বে গবেষণার জোয়ার চলছে। ২০১১ সালে অ্যালান ম্যাকডোনাল্ড ও রাফি বিস্ট্রিজার তাত্ত্বিক মডেলের মাধ্যমে দেখান, দুই স্তর বিশিষ্ট গ্রাফিন ঠিকভাবে একটার ওপর একটা না রেখে বিশেষ একটি কোণে (মোটামুটি ১ ডিগ্রির মতো) রাখলে ইলেকট্রনের এই দুই স্তরের মাঝে টানেলিং করে চলার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি খুব দ্রুত পরিবর্তন হয়ে যায়।
ছবি: রাফি বিস্ট্রিজার, অ্যালান ম্যাকডোনাল্ড ও পাবলো জারিয়ো-হেরেরো
২০১৮ সালে পাবলো জারিয়ো-হেরেরো এই ভবিষ্যদ্বাণীর পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ দেন। তিনি দেখান, ১.১ ডিগ্রিতে ইলেকট্রন খুব সহজে দুই স্তরে চলাচল করতে পারে এবং সুপারকন্ডাক্টিভিটি প্রদর্শন করে। এই তিনজন মিলে ২০২০ সালে উলফ প্রাইজও পেয়েছেন। ২০২৪ সালে ক্লারিভেট ইনস্টিটিউট সাইটেশনের ভিত্তিতে তাঁদের নোবেল পুরস্কারের জন্য ফেভারিটের তালিকায় রেখেছে।