পিয়ার রিভিউর সময় জেনেশুনেই ভুল তথ্য দিচ্ছেন বিজ্ঞানীরা!
বিজ্ঞান মানেই ধ্রুব সত্য, এমনটাই আমরা ভাবি। কিন্তু সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে এক ভয়ংকর তথ্য। প্রতি ৫ জন রসায়নবিদের ১ জন পিয়ার রিভিউয়ারদের খুশি করতে জেনেশুনেই গবেষণাপত্রে ভুল তথ্য যোগ করেন! কেন করেন এমন কাজ?
সাধারণ মানুষেরা বিজ্ঞানীদের কথাকে ধ্রুব সত্য বলে মনে করে। ভাবে, একটা গবেষণাপত্র যখন জার্নালে প্রকাশিত হয়, তখন সেটা নিশ্চয়ই হাজারটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর যাচাই-বাছাইয়ের পরেই আসে। সেখানে ভুলের কোনো জায়গা নেই। আর ইচ্ছে করে ভুল করার তো প্রশ্নই আসে না!
কিন্তু বাস্তবতা এতটা সরল নয়। সম্প্রতি এক গবেষণায় এমন এক তথ্য উঠে এসেছে, যা শুনলে আপনি চমকে যাবেন। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি ৫ জন রসায়নবিদের মধ্যে ১ জন তাঁদের গবেষণাপত্রে জেনেশুনে ভুল তথ্য যোগ করেন! কেন করেন? বিজ্ঞানকে ধোঁকা দিতে? না, শুধু নিজের পেপারটা যেন জার্নালে প্রকাশিত হয়, সেই স্বার্থে।
এই চাঞ্চল্যকর তথ্যটি উঠে এসেছে অ্যাকাউন্টেবিলিটি ইন রিসার্চ জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায়। এই গবেষণায় ৯৮২ জন রসায়ন গবেষকের ওপর জরিপ চালানো হয়েছিল। গবেষকেরা ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে রয়্যাল সোসাইটি অব কেমিস্ট্রি বা আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির মতো বিখ্যাত সব জার্নালে অন্তত দুটি করে পেপার প্রকাশ করেছেন। অর্থাৎ, এরা সবাই রসায়নবিদ।
জরিপে যখন তাঁদের প্রশ্ন করা হলো, আপনারা কি কখনো রিভিউয়ারদের চাপে পড়ে এমন কোনো তথ্য বা লেখা যোগ করেছেন, যা আপনারা জানতেন যে ভুল? উত্তরে ২২ শতাংশ গবেষক বলেছেন—হ্যাঁ, করেছি!
'তাঁরা জনসমক্ষে ভুল না ধরে বরং সহকর্মীদের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলোচনায় এটা সারতে পছন্দ করেন'ফ্রেডেরিক বর্ডিগনন, গবেষণার লেখক
এই গবেষণার লেখক এবং ফ্রান্সের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোল দে পঁত্স প্যারিসটেকের রিসার্চ ইন্টিগ্রিটি অফিসার ফ্রেডেরিক বর্ডিগনন বলছেন, গবেষকেরা এই কাজটা করেন মূলত ঝামেলা মেটানোর জন্য। পিয়ার রিভিউ প্রক্রিয়াটা অনেক দীর্ঘ আর ক্লান্তিকর। রিভিউয়াররা যখন কোনো ভুলভাল পরিবর্তনের আবদার করেন, তখন তর্ক করে পেপার প্রকাশ আটকা পড়ার চেয়ে গবেষকেরা সেই পেপার পাবলিশ করাতেই বেশি মনোযোগ দেন। তাই বাধ্য হয়ে মেনে নেন রিভিউরাদের কথা। বর্ডিগননের মতে, বিজ্ঞানের জন্য এটা সত্যিই উদ্বেগের বিষয়!
গবেষণায় আরও একটা মজার এবং একইসঙ্গে দুঃখজনক দিক উঠে এসেছে। বিজ্ঞানীরা যখন অন্যের পেপার পড়েন, তখন কি তাঁরা ভুল ধরতে পারেন? জরিপে দেখা গেছে, ৮৮ শতাংশ বিজ্ঞানীই অন্যের পেপার পড়ার সময় ভুল খুঁজে পেয়েছেন। অর্থাৎ প্রায় সবাই খুঁজে পান।
কিন্তু ভুল দেখার পর তাঁরা কী করেন? বেশির ভাগ বিজ্ঞানীই কিন্তু অফিশিয়াল বা আনুষ্ঠানিকভাবে সেই ভুল সংশোধনের পথে হাঁটেন না। তাঁরা বরং অনানুষ্ঠানিকভাবে তা সমাধান করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। বর্ডিগনন বলছেন, ‘তাঁরা জনসমক্ষে ভুল না ধরে বরং সহকর্মীদের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলোচনায় এটা সারতে পছন্দ করেন।’
রসায়নবিদদের মধ্যে আরও স্বচ্ছতা দরকার। সমস্যা হলো, কেউ অন্যের সমালোচনা করে খারাপ হতে চান না।
ভুল দেখার পর কে কী ব্যবস্থা নিয়েছেন, তার একটা বিস্তারিত হিসাব নিচে দেওয়া হলো। অনেকে একাধিক ব্যবস্থা নিয়েছেন বলে শতকরা হিসাব ১০০-র বেশি হতে পারে।
কফি ব্রেক: সবচেয়ে বড় অংশটি ভুল দেখার পর সেটা নিয়ে সহকর্মীদের সঙ্গে কফি ব্রেকে বা কনফারেন্সের ফাঁকে ব্যক্তিগতভাবে আলোচনা করেন। অর্থাৎ ভুলটা ভুলই থেকে যায়, শুধু নিজেদের মধ্যে একটু কানাঘুষা হয়। এমন সংখ্যা ৪২ শতাংশ।
ভবিষ্যতের পেপারে উল্লেখ: প্রায় এক-তৃতীয়াংশ গবেষক ওই ভুল পেপারটাকে তাঁদের নিজেদের পরবর্তী পেপারে সাইট করেন এবং সেখানে উল্লেখ করেন যে আগের পেপারে সমস্যা ছিল। এই দলে আছেন ৩৩ শতাংশ গবেষক।
শিক্ষার্থীদের সতর্ক করা: প্রায় ৩০ শতাংশ গবেষক ক্লাসে বা ট্রেনিংয়ের সময় শিক্ষার্থীদের জানান, ওই পেপারটায় ভুল আছে, ওটা থেকে সাবধান।
লেখককে মেইল: ২৮ শতাংশ গবেষক সরাসরি ওই পেপারের লেখককে মেইল করে বা কথা বলে পেপারটি সংশোধন করার পরামর্শ দেন।
পুরোপুরি উপেক্ষা: প্রায় ২২ শতাংশ গবেষক ভুল দেখার পরেও কোনো ব্যবস্থাই নেন না, এমনকি ওই পেপার আর কখনো সাইটও করেন না। চুপচাপ এড়িয়ে যান।
চিঠি বা নোট: মাত্র ১৩ শতাংশ গবেষক জার্নাল কর্তৃপক্ষের কাছে অফিশিয়াল চিঠি, কমেন্ট বা নোট পাঠান।
প্রতিলিপি: মাত্র ৪ শতাংশ গবেষক ওই ভুল প্রমাণ করার জন্য নিজেরা আবার সেই এক্সপেরিমেন্ট প্রজেক্ট শুরু করেন।
আনুষ্ঠানিক খণ্ডন: আরও ৪ শতাংশ গবেষক ওই ভুলের বিরুদ্ধে অফিশিয়াল রেফিউটেশন প্রকাশ করেন।
পাবপিয়ার: ২ শতাংশ গবেষক পাবপিয়ারে কমেন্ট করেন। যেখানে বিজ্ঞানীরা পেপার নিয়ে আলোচনা করেন, তাকে বলে পাবপিয়ার।
একবার ছাপা হয়ে গেল মানেই শেষ নয়। যদি পরে নতুন কোনো ফলাফল আসে বা ভুল ধরা পড়ে, তবে যেন সেটা এডিট বা আপডেট করা যায়।
আসলে নীতিগতভাবে সবাই সাধু সাজতে চান। জরিপে ৫৬ শতাংশ গবেষক বলেছেন, যেকোনো ভুল—তা ছোট হোক বা বড়—নীতিগতভাবেই সংশোধন করা উচিত। আর যখন প্রশ্ন করা হয়েছে নিজের ভুলের ব্যাপারে, তখন এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮২ শতাংশে! অর্থাৎ নিজের ভুল হলে তাঁরা সেটা শুধরে নিতে চান।
অন্যদিকে, এক-তৃতীয়াংশ গবেষক মনে করেন, ভুল যদি পেপারের মূল সিদ্ধান্ত বা কনক্লুশনে কোনো প্রভাব না ফেলে, তবে সেটা সংশোধন করার দরকার নেই। ফ্রান্সের ন্যাশনাল সেন্টার ফর সায়েন্টিফিক রিসার্চের কম্পিউটেশনাল কেমিস্ট ফ্রাঁসোয়া-জেভিয়ার কুডারট অবশ্য দ্বিমত পোষণ করেছেন। তিনি মনে করেন, সব ভুলই সংশোধন করা উচিত। তাঁর মতে, ‘ভুল শনাক্ত করা এবং তার কারণ বের করা অনেক কষ্টের কাজ। তাই ফলাফলটা সবার জানা উচিত। গবেষণায় পুনরাবৃত্তিযোগ্যতা নিশ্চিত করার এটাই একমাত্র উপায়।’
তাহলে এই সমস্যার সমাধান কী? বর্ডিগনন মনে করেন, রসায়নবিদদের মধ্যে আরও স্বচ্ছতা দরকার। সমস্যা হলো, কেউ অন্যের সমালোচনা করে খারাপ হতে চান না। অন্যের ভুল ধরিয়ে দেওয়া বা সমালোচনা করার ফলাফল ভোগ করাটা কঠিন। কিন্তু বিজ্ঞানের স্বার্থে আমাদের গবেষকদের আরও খোলামেলা হতে হবে এবং সমালোচনা গ্রহণ করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে।
এজন্য পাবপিয়ারের মতো প্ল্যাটফর্মে বিজ্ঞানীদের আরও বেশি আলোচনা করা উচিত। কুডারটও এর সঙ্গে একমত। তিনি বলেন, ‘পেপার প্রকাশিত হওয়ার পরেও তার রিভিউ হওয়া দরকার।’
আরেকটা চমৎকার সমাধান হতে পারে গবেষণাপত্রকে জীবন্ত দলিল হিসেবে দেখা। অর্থাৎ, একবার ছাপা হয়ে গেল মানেই শেষ নয়। যদি পরে নতুন কোনো ফলাফল আসে বা ভুল ধরা পড়ে, তবে যেন সেটা এডিট বা আপডেট করা যায়। প্রি-প্রিন্ট পেপারের ক্ষেত্রে ঠিক এটাই হয়। পাঠকেরা জানেন যে এখন যেটা পড়ছেন, সেটাই চূড়ান্ত নয়, এটা পরে বদলাতেও পারে।
আসলে বিজ্ঞান সত্যের সন্ধান করে ঠিকই, কিন্তু সেই সত্যের পথেও যে মাঝে মাঝে রাজনীতি, চাপ আর পাছে লোকে কিছু বলের ভয় বাধা হয়ে দাঁড়ায়, এই গবেষণা সেটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। এক জন গবেষক যখন চাপে পড়ে ভুল তথ্য দেন, তখন সেটা শুধু একটি পেপার নয়, পুরো বিজ্ঞানের বিশ্বাসযোগ্যতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে!