সিলেটে জমজমাট বিজ্ঞান উৎসব অনুষ্ঠিত
বন্যার পর ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে দেখা যায়, যে এলাকার সড়কের পাশে যাতায়াত সুবিধা ভালো, সেখানে একাধিকবার ত্রাণ বিতরণ হচ্ছে। আবার একাধিক সংগঠন ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে অংশ নেওয়ায় সমন্বয় থাকে না। ফলে দূরবর্তী এলাকায় ত্রাণ পৌঁছায় না।
ত্রাণ সামগ্রী যাতে সমবণ্টন হয়, সেটির জন্য বন্যা কবলিত এলাকার ম্যাপের মাধ্যমে 'স্মার্ট ফ্লাড ম্যানেজমেন্ট' সিস্টেম নামের ওয়েবভিত্তিক কার্যক্রম তৈরি করেছেন তিন শিক্ষার্থী।
ওই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যে সকল এলাকায় ত্রাণ পৌঁছায়নি, সে সকল এলাকা চিহ্নিত করে সামগ্রী পৌঁছানোর ব্যবস্থাপনা করা যাবে। সেখানকার জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগের সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করবে ওয়েবটি। এতে ত্রাণ সমবণ্টন হবে। পাশাপাশি ওয়েবসাইটটির মাধ্যমে অর্থ সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। রয়েছে দানকৃত অর্থ সঠিক ভাবে হিসাবে যোগ হচ্ছে কি-না, সেটি দেখার সুযোগও।
সিলেটে আজ ২৫ অক্টোবর শনিবার অনুষ্ঠিত বিকাশ-বিজ্ঞানচিন্তা বিজ্ঞান উৎসবের সিলেট আঞ্চলিক পর্বে এমন প্রজেক্ট প্রদর্শন করেছে দশম শ্রেণির তিন শিক্ষার্থী—নাহিয়ান রাফি, প্রজ্ঞা পারমিতা সেন ও অনন্যা শ্রিনিধি।
প্রজেক্টে ত্রাণ ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি বন্যা পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ তাঁদের ঘরে রক্ষিত খাবার এবং মালামাল যাতে সুরক্ষিত জায়গায় রাখতে পারে, সে জন্য ভাসমান গুদামের প্রকল্পও প্রদর্শন করেছে ওই তিন শিক্ষার্থী। মাত্র ৬-৭ লাখ টাকা খরচ করে একটি পুরো গ্রামের খাদ্য সামগ্রী রাখার গুদাম তৈরির ব্যবস্থা করা যাবে। পাশাপাশি বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সেই গুদামটি ক্যাম্প হিসেবে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করা যাবে।
এ ছাড়া প্রজেক্টে সিলেট ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র মুশফিকুর রহমান প্রদর্শন করেছে 'ফায়ার ফাইটিং রোবট'। যার মাধ্যমে মানুষের আগুনের কাছে না গিয়েও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা এবং আগুন থেকে বিভিন্ন সামগ্রী উদ্ধারের কাজ করা যাবে।
মুশফিকুর রহমান জানায়, চট্টগ্রামে রাসায়নিক গুদামে আগুন লেগেছিল। সে সময় রাসায়নিক পদার্থ বিস্ফোরিত হয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মী মারা যান। এমন পরিস্থিতিতে আগুনের কাছে গিয়ে যাতে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজ করতে পারে, সে জন্য এমন রোবট তৈরি করার পরিকল্পনা নিয়েছে। সে অনুযায়ী কাজ করে ফায়ার ফাইটিং রোবট বানিয়েছে সে।
গত শনিবার সিলেটের মেজরটিলা এলাকার স্কলার্সহোম কলেজে বিজ্ঞান উৎসবে এমন সব প্রজেক্ট প্রদর্শন করে মুগ্ধ করেছেন নতুন প্রজন্মের বিজ্ঞানীরা।
হেমন্তের সকালে হালকা শীতের সঙ্গে মিষ্টি রোদে বিকাশ-বিজ্ঞানচিন্তা বিজ্ঞান উৎসবে শিক্ষার্থীরা দল বেঁধে উপস্থিত হয়েছিল বিজ্ঞান উৎসবে। এ সময় অনেকের হাতে ছিল প্রজেক্টের বোর্ড। উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে কলেজ ক্যাম্পাসজুড়ে। সকাল সাড়ে ৯টায় জাতীয় সংগীত পরিবেশন ও জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে 'বিজ্ঞানমনস্ক হওয়ার প্রত্যয়ে' আয়োজিত এই উৎসবের উদ্বোধন করা হয়। পরে শিক্ষার্থীদের নিয়ে অতিথিরা বেলুন উড়িয়ে উৎসবের উদ্বোধন ঘোষণা করেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জাতীয় পতাকা ও উৎসবের পতাকা উত্তোলন করেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য মো. সাজেদুল করিম, স্কলার্সহোম কলেজ মেজরটিলা সিলেট ক্যাম্পাসের অধ্যক্ষ ও ভেন্যুপ্রধান মো. ফয়জুল হক, বিকাশের ইভিপি এবং রেগুলেটরি অ্যান্ড অ্যাফেয়ার্স ডিপার্টমেন্টের প্রধান হুমায়ূন কবির, প্রথম আলো সিলেটের নিজস্ব প্রতিবেদক সুমনকুমার দাশ, বিজ্ঞানচিন্তার সহ-সম্পাদক উচ্ছ্বাস তৌসিফ, কাজী আকাশ প্রমুখ। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সিলেট বন্ধুসভার সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক ফারিহা ফিমা।
শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানে উৎসাহী করতে বিকাশ ও বিজ্ঞান চিন্তার আয়োজনে বিজ্ঞান উৎসব অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের স্ন্যাকস পার্টনার ছিল ড্যান ফুডস লিমিটেড। সহযোগিতায় ছিল সিলেট বন্ধুসভা। উৎসবে সিলেট বিভাগের ৪ জেলার বিভিন্ন স্কুলের মাধ্যমিক ও নিম্নমাধ্যমিক পর্যায়ের ৫৫২ জন শিক্ষার্থী নিবন্ধন করে। এ ছাড়া প্রজেক্টে নিবন্ধন করে ২৭ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে প্রায় চার শতাধিক শিক্ষার্থী অংশ নেয়। উৎসবে তারা বিজ্ঞানভিত্তিক কুইজ প্রতিযোগিতা ও নিজ নিজ বৈজ্ঞানিক প্রজেক্ট প্রদর্শনে অংশ নেয়।
জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র ওয়ারেজ হোসেন বলে, সে মানুষের কাজকে সহজ করতে 'ওয়েটার রোবট' তৈরি করেছে। রোবটটি রেস্তোরাঁয় গ্রাহকদের কাছ থেকে খাবারের অর্ডার সংগ্রহ এবং চাহিদা অনুযায়ী খাবার সরবরাহ করবে।
শাহজালাল জামেয়া ইসলামিয়া কামিল মাদ্রাসার নবম শ্রেণির ছাত্র আব্দুল্লাহ আল ফাহিম 'স্মার্ট ইলেকট্রিক বাস' তৈরি করেছে। বাসটি চলাচলের সময় এর ওপর বসানো সোলার প্যানেল থেকে চার্জ হবে এবং নির্দিষ্ট পয়েন্টে গিয়ে চার্জ নিতে পারবে। যার ফলে কার্বন নিঃসরণ কমে বায়ু দূষণ রোধ হবে। এতে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকবে।
আলোচনা পর্বে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বিকাশের কর্মকর্তা হুমায়ূন কবির বলেন, ভবিষ্যৎ দুনিয়া হবে বিজ্ঞানের দুনিয়া। নতুন প্রজন্ম হবে বিজ্ঞানমনস্কদের। নতুন নতুন আবিষ্কার করতে হবে।
তিনি বলেন, উন্নত বিশ্বের তুলনায় জ্ঞান-বিজ্ঞানে আমরা পিছিয়ে রয়েছি। নতুন চিন্তা ও উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। এ জন্য নতুন প্রজন্মকে উদ্যোগী হতে হবে। বিকাশ মানুষের জীবন মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে, বিজ্ঞানের প্রসারে কাজ করছে বিকাশ।
ভেন্যুপ্রধান মো. ফয়জুল হক বলেন, বিজ্ঞান ও যুক্তিনির্ভর প্রজন্ম দেশ এবং জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। বিজ্ঞানকে জানতে হবে। বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করতে হবে। গবেষণার মাধ্যমে নতুনত্ব আবিষ্কৃত হবে।
আলোচনা পর্ব শেষে সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় গান পরিবেশন করেন শিল্পী লিংকন দাশ। আর ম্যাজিক ম্যাজিক দেখান রাজীব বসাক।
পরে বিজ্ঞান বিষয়ক প্রশ্নোত্তর পর্বে বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদনা দলের সদস্য শিবলী বিন সারওয়ারের সঞ্চালনায় শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান খান, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ফরহাদ রাব্বি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক মো. জাকির হোসেন, বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. নুরশাদ আলী।
এ সময় শিক্ষার্থীরা ‘সাধারণ লোহায় মরিচা ধরে, কিন্তু ব্রিজের লোহায় মরিচা ধরে না কেন?’ ‘পৃথিবীর বিভব শূন্য কেন?’ ‘ওয়্যারলেসের মাধ্যমে কীভাবে তথ্য আদান প্রদান করা হয়?’ ‘মানুষ হাই তোলে কেন, এটি সংক্রামক কি-না?’—বিজ্ঞান বিষয়ে কৌতূহল থেকে এমন সব প্রশ্ন করে। মৌখিকভাবে প্রশ্নের পাশাপাশি লিখিতভাবেও প্রশ্নের উত্তর জানতে চায় তারা।
আঞ্চলিক পর্বে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা একটি ক্যাটাগরিতে অংশ নেয় প্রজেক্ট প্রদর্শনীতে। নিম্নমাধ্যমিক (ষষ্ঠ-অষ্টম) ও মাধ্যমিক (নবম-দশম ও চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষার্থী) দুটি ক্যাটাগরিতে কুইজ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় শিক্ষার্থীরা।
কুইজে দুই ক্যাটাগরিতে সেরা ১০ জন করে এবং প্রজেক্টে ৭টি দলকে পুরস্কৃত করা হয়। পুরস্কারের মধ্যে ছিল সনদ, মেডেল, বইসহ নানা উপহার। বিজয়ীরা ঢাকায় অনুষ্ঠিত জাতীয় পর্বে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাবে। জাতীয় পর্বে বিজয়ীদের জন্য থাকছে ল্যাপটপ, ট্যাবসহ আকর্ষণীয় পুরস্কার। সারা দেশের স্কুলশিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানে আগ্রহী করে তুলতে বিকাশ-বিজ্ঞানচিন্তা এই উৎসবের আয়োজন করছে।
ইতিমধ্যে ঢাকা, রংপুর, রাজশাহী, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও খুলনা বিজ্ঞান উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। সিলেট আঞ্চলিক পর্বের মাধ্যমে বিজ্ঞান উৎসবের আঞ্চলিক পর্ব শেষ হয়েছে। আগামী ৩১ অক্টোবর শুক্রবার বিজ্ঞান উৎসবের জাতীয় পর্বের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটবে আয়োজনের।