উচ্ছ্বাস-উৎসবে রাজশাহীতে বিজ্ঞান উৎসব

বেলুন উড়িয়ে উদ্বোধন ঘোষণার পর উচ্ছ্বসিত খুদে বিজ্ঞানীরা

নাটোর সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির তিন শিক্ষার্থী এক টেবিলে দেখাচ্ছিল শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা কতটা আধুনিক করা যায়। মানুষবিহীন, স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করবে তাদের এ প্রযুক্তি। সামিত ওয়াসি, সিদ্ধার্থ প্রামাণিক ও নাবিল হাসান নামের এই তিন শিক্ষার্থী এসেছে খুব সকালে। তাদের সঙ্গী হয়ে এসেছেন সামিতের বাবা এনামুল হক। তিনি তাদের পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন। বললেন, ‘ছেলের আগ্রহ থেকেই এখানে আসা। এ ধরনের আয়োজন শিক্ষার্থীদের ওপরে উঠার সিঁড়ি। বড় বড় চিন্তা করতে শেখায় তাদের।’

এই তিন শিক্ষার্থীর মতো রাজশাহী বিভাগের আটটি জেলার প্রায় ৭০০ শিক্ষার্থীর সম্মিলন ঘটে রাজশাহীর সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজে। বিকাশ-বিজ্ঞানচিন্তা বিজ্ঞান উৎসবের রাজশাহী আঞ্চলিক পর্ব তাদের এই সম্মিলনের সুযোগ করে দিয়েছে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত নানা আয়োজনে অংশ নিয়ে বিজ্ঞান জয়ের এক উৎসব উদযাপন করেছে এই শিক্ষার্থীরা। কুইজ প্রতিযোগিতা, নিজেদের তৈরি প্রজেক্ট প্রদর্শন, বিজ্ঞ শিক্ষকদের প্রশ্নের মাধ্যমে জেরবার করা এবং উত্তর জেনে নেওয়া, জাদু ও গান উপভোগসহ অসংখ্য আনন্দ উপলক্ষ ছিল এ আয়োজন ঘিরে।

জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে উৎসব শুরু হয়

উৎসব শুরু হয় সকাল ৯টায়। জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে জাতীয় পতাকা এবং উৎসবের পতাকা উত্তোলন করা হয়। তারপর অতিথি আর শিক্ষার্থীরা মিলে বেলুন উড়িয়ে দেয় আকাশে। শুরু হয় রাজশাহী বিজ্ঞান উৎসব।

উদ্বোধনী মঞ্চে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রাজশাহীর সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অধ্যক্ষ ও ভেন্যু প্রধান বিশ্বজিৎ ব্যানার্জি; বিকাশ লিমিটেডের রেগুলেটরি অ্যান্ড কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স ডিপার্টমেন্টের ভাইস প্রেসিডেন্ট সায়মা আহসান ও ম্যানেজার মাহবুবুর রহমান; প্রথম আলো রাজশাহীর নিজস্ব প্রতিবেদক আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ; রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. আজমাইন ইয়াক্বীন ও মো. জহিরুল ইসলাম; রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক মো. নজরুল ইসলাম, গণিত বিভাগের অধ্যাপক মো. রবিউল হক এবং পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক ইহ্তিশাম ক্বাবিদ; বিজ্ঞানচিন্তার নির্বাহী সম্পাদক আবুল বাসার, সহসম্পাদক উচ্ছ্বাস তৌসিফ ও কাজী আকাশ, রাজশাহী ম্যাথ ক্লাবের সভাপতি মো.মাসুদ রানাসহ আরও অনেকে।

আরও পড়ুন
প্রজেক্ট প্রদর্শনী পর্বে প্রজেক্ট দেখতে ভিড় করেন অনেক দর্শনার্থী। এর ফাঁকেই দেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের খাবার। বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত চলে প্রজেক্ট প্রদর্শন।

এর আগে সকালে নির্ধারিত সময়ের আগে শিক্ষার্থীরা হাজির হয় অনুষ্ঠানস্থলে। দূরের জেলা থেকে তারা আসে বাসসহ বিভিন্ন গাড়িতে। তাদের সঙ্গী হয়ে আসেন অভিভাবক ও শিক্ষকেরা।

রাজশাহী আঞ্চলিক বিজ্ঞান উৎসবের কুইজ পর্বে মনযোগ দিয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে শিক্ষার্থীদের একাংশ

উদ্বোধনের পরে, সকাল সাড়ে ৯টায় দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায় শিক্ষার্থীরা। এক ভাগ অংশ নেয় বিজ্ঞান কুইজে। প্রায় সাড়ে ৫০০ শিক্ষার্থী এতে অংশ নেয়। আরেক ভাগ নিজেদের বানানো প্রজেক্ট টেবিলে সাজিয়ে বসে। প্রায় ৫০টি প্রজেক্টে জমে ওঠে উৎসব। এভাবে রাজশাহী বিভাগের আট জেলার নিম্ন মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় ৭০০ শিক্ষার্থী উৎসবে অংশ নেয়। এতে শিক্ষার্থীদের স্ন্যাকস পার্টনার হিসেবে ছিল ড্যান ফুডস লিমিটেড। সেই সঙ্গে ছিল প্রথমা, বাতিঘর, কিশোর আলো এবং বিজ্ঞানচিন্তার স্টল।

প্রজেক্টের মাধ্যমে নিজের উদ্ভাবনী চিন্তা তুলে ধরছে এক শিক্ষার্থী

প্রজেক্ট প্রদর্শনী পর্বে প্রজেক্ট দেখতে ভিড় করেন অনেক দর্শনার্থী। এর ফাঁকেই দেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের খাবার। বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত চলে প্রজেক্ট প্রদর্শন। এই পর্বে বিচারকের দায়িত্ব পালন করে একাডেমিক টিমের সদস্যরা। এর মধ্যে ছিলেন রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থী: রুয়েট সিএসই বিভাগের শিক্ষার্থী সৈয়দ সিফাত ই রহমান, শাহরিয়ার রিজভী,  জুবায়ের আবেদীন, আবু শাহাদাত রাব্বি, মো.আবু সুফিয়ান, মো. সিফাত আলম,  তানভীর মাহমুদ, প্রথম অন্তর বণিক, মোসা. রায়না ইসলাম ও  শাহ আহমেদ রাদ; বিজ্ঞানচিন্তার সহসম্পাদক উচ্ছ্বাস তৌসিফ, কিশোর আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক আহমাদ মুদ্দাসসেরসহ আরও অনেকে।

রাজশাহীর নওদাপাড়া এলাকার হামিদুপর-নওদাপাড়া উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির অলি আহমেদ, মো. মুশফিকুর রহমান পানি অপচয় রোধে একটি প্রকল্প নিয়ে হাজির হয়েছিল। তারা বলে, ‘এই প্রযুক্তি ব্যবহারে পানির ট্যাঙ্ক থেকে পানি আর উপচে পড়বে না, অপচয় হবে না।’

রাজশাহীর সরকারি শিক্ষাবোর্ড মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের তিন শিক্ষার্থী ‘জুট প্রটেকশন ফর্ম রেইন’ নামে একটি প্রজেক্ট নিয়ে এসে ব্যাখ্যা দিচ্ছিল। তারা বলছিল, পাট বা শুকনো কিছু বাইরে শুকাতে দেওয়ার সময় বৃষ্টি থেকে এই প্রযুক্তি রক্ষা করবে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় মডেল স্কুলের অষ্টম শ্রেণির তিন শিক্ষার্থী বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে এসেছে। তারা বলে, তাদের এই প্রযুক্তির মাধ্যমে ধরা পড়বে কেউ অনির্দিষ্ট স্থানে বর্জ্য ফেলছে কি না।

শিক্ষার্থীদের একাংশ

চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ৪৩ শিক্ষার্থী এসেছে এই আয়োজনে। তারা বেশ কয়েকটি প্রজেক্ট নিয়ে এসেছে। নাচোল উপজেলা স্কুলের শিক্ষার্থী ইসতিয়াক আহমেদ, জিসান আহমেদ ও আনাফি নিজেদের তৈরি ল্যাম্পপোস্ট নিয়ে এসেছে। ইসতিয়াক বলে, ‘বিদ্যুৎ চলে গেলে সে নিজের বানানো ল্যাম্পপোস্টে পড়াশোনা করে।’

প্রথম আলো ট্রাস্ট পরিচালিত আলোর পাঠশালার পাঁচ শিক্ষার্থী তিনটি প্রজেক্ট নিয়ে এসেছিল উৎসবে। এই শিক্ষার্থীরা হলো মনিকা আক্তার, হাফিজা আক্তার, সুমাইয়া আক্তার, আনিকা আক্তার ও মোসা. পিংকি।

উৎসবে উপস্থিত রুয়েট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজশাহী ম্যাথক্লাবের সভাপতি তাদের প্রশ্নের উত্তর দেন। বিজ্ঞানের জটিল প্রশ্নের ভেতরেও কিছু প্রশ্ন উপস্থিত অভিভাবক ও অতিথি সবাইকে আনন্দ দেয়।

কুইজ পরীক্ষা ও প্রজেক্ট প্রদর্শন শেষে অডটোরিয়ামে শুরু হয় আলোচনা। শিক্ষার্থী খান সাফিনের গাওয়া ‘ও বেহুলা আমি মরলে আমায় নিয়ে ভাসাইও ভেলা...’ ও শেষে শিক্ষার্থী উজান ব্যানার্জীর কণ্ঠে আমার মন বান্ধিবি...’ গান দুটি শিক্ষার্থীদের মন কাড়ে। দুটি গানেই গিটারে ছিল উপান্ত আজিজি। এটি শেষ হতেই জাদুর বাক্স নিয়ে মঞ্চে আসেন জাদুশিল্পী রাজীব বসাক। জাদুর ভেতর দিয়েই তিনি মা-বাবা ও প্রিয় মাতৃভূমিকে ভালোবাসার মন্ত্র ছড়িয়ে দেন শিক্ষার্থীদের মধ্যে।

আলোচনা পর্বে ভেন্যু প্রধান বিশ্বজিৎ ব্যানার্জি

আলোচনা পর্বে অধ্যক্ষ বিশ্বজিৎ ব্যানার্জি বলেন, মুক্তচিন্তা, বিজ্ঞানমনস্ক ও চতুর্থ বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রস্তুতি নিয়ে তোমাদের বড় হতে হবে। সেই সঙ্গে কৃত্রিমবুদ্ধিমত্তার (এআই) প্রযুক্তি প্রস্তুত ও ব্যবহারের উপযোগী দক্ষতা অর্জন করতে হবে। তিনি এই উৎসবের ভেন্যু হিসেবে তার প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করার জন্য বিকাশ ও বিজ্ঞানচিন্তাকে ধন্যবাদ জানান।

আরও পড়ুন

বিকাশ লিমিটেডের রেগুলেটরি অ্যান্ড করর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স ডিপার্টমেন্টের ভাইস প্রেসিডেন্ট সায়মা আহসান বলেন, ‘২০১৯ সাল থেকে তারা এই উৎসব করে আসছেন। এতে সারা দেশে তারা ব্যাপক সাড়া পেয়েছেন। তিনি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, যত প্রশ্ন করবে, তত জানতে পারবে।’

শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানবিষয়ক প্রশ্নের জবাব দেন অতিথিরা

এরপরেই শুরু হয় উৎসবের প্রশ্নোত্তর পর্ব। এই পর্বে শিক্ষকদের মজার মজার প্রশ্ন করে শিক্ষার্থীরা পুরস্কার জিতে নেয়। উৎসবে উপস্থিত রুয়েট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজশাহী ম্যাথক্লাবের সভাপতি তাদের প্রশ্নের উত্তর দেন। বিজ্ঞানের জটিল প্রশ্নের ভেতরেও কিছু প্রশ্ন উপস্থিত অভিভাবক ও অতিথি সবাইকে আনন্দ দেয়। সবাইকে প্রশ্ন করতে দেখে প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী তওসীম প্রশ্ন করে বসে: দুই অঙ্কের ১০ তাড়াতাড়ি আসে, কিন্তু তিন অঙ্কের ১০০ আসতে এত দেরি হয় কেন? চতুর্থ শেণির উৎসব প্রশ্ন করে পৃথিবী কিসের ওপর ভেসে আছে? নগরের মসজিদ মিশন স্কুলের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী রাইয়ানের প্রশ্ন ছিল, ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্ব আছে, আমরা জানি। হোয়াইট হোল বলে কি কিছু আছে? নাচোল উপজেলা স্কুলের মিনহাজুল মাহিমের প্রশ্ন ছিল, ডার্ক এনার্জি কী? এরকম নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে শিক্ষকেরাও বেশ উপভোগ করেছেন।

প্রশ্নোত্তর পর্বে এক শিক্ষার্থী প্রশ্ন করছে

এই আঞ্চলিক পর্বে  কুইজ প্রতিযোগিতায় নিম্নমাধ্যমিকে সেরা ১১জন ও মাধ্যমিকে সেরা ১০ জন সহ মোট ২১ জনকে বিজয়ী নির্বাচিত করা হয়। প্রজেক্টে  সেরা ১০ দলকে দেওয়া হয় পুরস্কার। এতে রাজশাহী শিক্ষাবোর্ড সরকারি মডেল স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরা প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকার করে। তার মধ্যে আবার শুধু ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা প্রথম  ও দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। ‘স্মার্ট হোম সিকিউরিটি’ নামের প্রজেক্টটি নিয়ে মো. মুহতাসিন, তাহমিনুর রহমান ও সাদমান সাকিব জিতে নেয় সেরাদের সেরার পুরস্কার। পুরস্কারের মধ্যে ছিল সনদপত্র, মেডেল, বই, ট্রফি ও টি-শার্টসহ অনেক কিছু। পাশাপাশি বিজয়ীরা ঢাকায় অনুষ্ঠিত জাতীয় পর্বে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাবে। জাতীয় পর্বে বিজয়ীদের জন্য থাকছে ল্যাপটপ, ট্যাবসহ আকর্ষণীয় সব পুরস্কার।

এক মঞ্চে বিকাশ-বিজ্ঞানচিন্তা বিজ্ঞান উৎসবের রাজশাহীর আঞ্চলিক পর্বের বিজয়ী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অতিথি ও স্বেচ্ছাসেবকেরা

সারা দেশের স্কুলশিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানে আগ্রহী করে তুলতে বিকাশ-বিজ্ঞানচিন্তা এই উৎসব আয়োজন করছে। এরই মধ্যে ঢাকা, রংপুর এবং রাজশাহী আঞ্চলিক উৎসব শেষ হয়েছে। এরপর ১৯ সেপ্টেম্বর খুলনা, ২০ সেপ্টেম্বর বরিশাল, ২৬ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম ও ২৭ সেপ্টেম্বর সিলেটে আঞ্চলিক উৎসব অনুষ্ঠিত হবে। সবশেষে জাতীয় পর্বের মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটবে এ আয়োজনের।